ফটিকছড়ির সাতটি চা বাগান থেকে বছরে অর্ধ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা
কর্ণফুলীর দুই কর্মকর্তার উপর হামলার ঘটনায় ১৭টি চা বাগানে ক্ষোভের সৃষ্টি
রামগড় প্রতিনিধি, পার্বত্যনিউজ:
খাগড়াছড়ি পাবর্ত্য জেলা লাগোয়া ফটিকছড়ির সাতটি চা বাগান থেকে বছরে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনের সন্ত্রাসীরা। বাৎসরিক নির্ধারিত চাঁদা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ‘বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠান’ উপলক্ষেও ঐ সন্ত্রাসী গ্রুপ বাগানগুলো থেকে চাঁদা আদায় করে। চা বাগানগুলোর সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে রবিবার ফটিকছড়ির ব্র্যাকের মালিকানাধীন কর্ণফুলী চা বাগানের দুই সিনিয়র কর্মকর্তা(ম্যানেজার)র উপর উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় ফটিকছড়ির ১৭টি চা বাগানের শ্রমিক, কর্মচারি কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এ হামলার ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট বাগান কর্তৃপক্ষ ইউপিডিএফকে দায়ী করেছেন।
সন্ত্রাসীরা রবিবার গভীর রাতে কর্ণফুলী চা বাগানের প্রায় ১৫একর রাবার বাগানে অগ্নিসংযোগ করে গাছগুলো পুড়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। সেনা বাহিনীর বাইন্যেছোলা ক্যাম্পের কর্পোরাল সরোয়ার বলেন, চা বাগানের ম্যানেজারের উপর সন্ত্রাসী হামলা, উপজাতিদের ঘর পুড়ানো এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনীর টহল টিম জোরদার করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়, মানিকছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি সীমানা ঘেঁষে ফটিকছড়ির দাঁতমারা, নিউ দাঁতমারা, নাছেহা, আছিয়া, নেপচুন, ডলু কৈয়াছড়া ও কর্ণফুলী চা বাগান অবস্থিত। দুর্গম ও গভীর বনাঞ্চল ঘেরা পার্বত্য এলাকা লাগোয়া হওয়ায় চা বাগানগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায় পাবর্ত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংগঠনগুলো এসব বাগান থেকে নিয়মিত মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে থাকে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বাগানের এক ব্যবস্থাপক জানান, বাগানের আয়তন ও অবস্থা ভেদে তারা চাঁদার হার ধার্য্য করে দেয়। বছরের প্রথম দিকেই চাঁদার টাকা পরিশোধ করতে হয়। ঐ ব্যবস্থাপক আরও বলেন, নির্দিষ্ট করা চাঁদার বাইরে পার্টির বিশেষ কোন প্রোগ্রাম উপলক্ষেও চাঁদা আদায় করা হয় বাগানগুলো থেকে।
অন্য একটি সূত্র জানায়, চাঁদা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ইতিপূর্বে নেপচুন বাগানের ব্যবস্থাপক অপহৃত হয়েছিলেন ঐ সংগঠনের সন্ত্রাসীদের হাতে। সূত্র জানায়, পাবর্ত্য এলাকা লাগোয়া বাগানের বিস্তীর্ণ এলাকায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যেই টহল দেয়। তাদের নিয়োগ করা কালেক্টর চাঁদার টাকা আদায় করে। সংগঠনের এরিয়া কমান্ডার সব কিছু মনিটরিং করে।
সূত্র জানায়, দুর্গম ও জনশূণ্য হওয়ায় এলাকাগুলো তাদের কাছে অনেকটা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। জানা যায়, অন্য বাগানগুলোর মত কর্ণফুলী চা বাগান কর্তৃপক্ষও পাহাড়ি সংগঠনগুলোকে নিয়মিত চাঁদ দিয়ে থাকেন। ঐ এলাকাটি ইউপিডিএফ ও জেএসএস(সংস্কার) এর নিয়ন্ত্রণে থাকায় বাৎসরিক চাঁদা তারাই আদায় করে।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, লক্ষ্মীছড়ির সীমানা লাগোয়া কর্ণফুলী চা বাগানের বিশাল এলাকা তারা জোরপূর্বক দখল করে সেখানে কিছু নিরীহ উপজাতি পরিবারকে ঘর বানিয়ে বসিয়েছে। বাগানের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় সেখানে কমপক্ষে ৫শ একর জমি তারা বেদখল করেছে। এরমধ্যে জাফরাবাদ, দুইদ্যেখোলা, ট্যোক বাড়িয়া, সরকারী ডেবা, রক্তছড়ি, মানিকপুর এলাকা রয়েছে। সরকারের কাছ থেকে লীজ নেয়া এ জায়গাগুলোর ভূমি কর পরিশোধ করলেও সন্ত্রাসীদের বাধারমুখে সেখানে চা আবাদ করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান ও আছিয়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক মমতাজুল হাসান মন্টু পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের চাঁদা আদায় সম্পর্কে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘেঁষা বাগানগুলো নিয়মিতই তাদের চাঁদা দিতে হয়। তবে কে কত টাকা চাঁদা দেয় কেউ তা প্রকাশ করেন না। তিনি বলেন, সমতল জেলায় হলেও ভৌগলিক কারণে বাগানগুলোর কর্তৃপক্ষ পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাতে অনেকটা জিন্মি।
এদিকে রবিবার কর্ণফুলী চা বাগানের দুই কর্মকর্তা মো: ্শাহনেওয়াজ ও মো: ইলিয়াছ পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় ফটিকছড়ির ১৭টি চা বাগানে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
হালদা ভ্যালী চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক ও বাংলাদেশীয় চা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফটিকছড়ির ১৭টি চা বাগানে প্রায় ২৫-৩০ হাজার ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী শ্রমিক নিয়োজিত। তারা চা বাগানের কর্মসংস্থানে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। কর্ণফুলী চা বাগানের দুই সিনিয়র কর্মকর্তাকে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা অমানুষিক নির্যাতন করে আহত করার ঘটনায় এসব শ্রমিকরাও বিক্ষুদ্ধ।
তিনি বলেন, বাগানগুলোর কর্তৃপক্ষ সরকারকে কোটি কোটি টাকার ভ্যাট ও ভূমি কর দিচ্ছে। নিরাপদে ও অবাধে বাগানগুলোতে চা উৎপাদনের পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সরকার চা সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে দেশের জাতীয় এ চা শিল্পের প্রসার বাধাগ্রস্ত হবে।
এদিকে, কর্ণফুলী চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো: শাহ নেওয়াজ ও মো: ইলিয়াছের উপর পাহাড়ি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বাংলাদেশীয় চা সংসদের কর্মকর্তারা গতকাল সোমবার ফটিকছড়িতে এক জরুরি বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ঘটনার জন্য তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। বৈঠকে বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান মমতাজুল হাসান মন্টু, সাবেক চেয়ারম্যান সরওয়ার কামাল, ভাইস চেয়ারম্যান মো: জাহাঙ্গীল আলম প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।