ভারতে রোহিঙ্গাদের আবাসন বিষয়ে সকালের সিদ্ধান্ত পাল্টে গেল বিকেলে

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বয়হীনতার প্রমাণ প্রকাশ পেল বুধবার (১৭ আগস্ট)। কেন্দ্রীয় নগর উন্নয়ন ও আবাসনমন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী বুধবার সকালে ফলাও করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করলেন। তিনি এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকারের সমালোচকদের একহাত নিলেন। কিন্তু বিকেলেই তাঁর কথা নস্যাৎ করে দিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অমিত শাহর মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিল, এমন কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীতই হয়নি!
হরদীপ পুরী বুধবার সকালে টুইট করে জানান, দিল্লিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সরকারের তৈরি করা আবাসন প্রকল্পে নিয়ে যাওয়ার এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ওই আবাসন প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য। সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখা হবে। জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার রক্ষা কমিশনের প্রশংসাপত্রও দেওয়া হবে। ওই আবাসনে চব্বিশ ঘণ্টা নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। এ ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিকেলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়ে দেয়, আবাসনমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোনো সিদ্ধান্ত আদৌ গৃহীত হয়নি। অবৈধভাবে চলে আসা রোহিঙ্গাদের ফ্ল্যাট দেওয়ার কোনো নির্দেশও দেওয়া হয়নি।
বিবৃতিতে বলা হয়, দিল্লি সরকার রোহিঙ্গাদের সরাতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের বলা হয়েছে, এখন তারা যে যে এলাকায় রয়েছে, সেখানেই থাকবে। তাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাক্যালাপ জারি রয়েছে। রোহিঙ্গারা যেখানে রয়েছে, সেই এলাকাকে ‘বন্দী শিবির’ ঘোষণা করতেও দিল্লি সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরকারি হিসেবে দিল্লিতে বর্তমানে ১ হাজার ১০০ রোহিঙ্গার বাস। বেসরকারি মতে সংখ্যাটি দেড় হাজারের বেশি।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের এই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার কারণ কী, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। হরদীপ পুরী সকালে ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা জানিয়ে সরকারের শরণার্থী নীতির সমালোচকদের একহাত নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে যাঁরা সরকারের শরণার্থী নীতির বিরোধিতা করছেন, দুর্নাম করছেন, এ সিদ্ধান্ত তাঁদের হতাশ করবে। ভারত আশ্রয়প্রার্থীদের কখনো নিরাশ করেনি। জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের শরণার্থী সনদকে ভারত সম্মান করে, মানে। জাত, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে আশ্রয় দেয়।
মন্ত্রীর এই গর্বিত ঘোষণা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নস্যাৎ করে দেওয়ার কারণ ঠিক কী সরকারিভাবে বলা হয়নি। হরদীপ পুরী জানিয়েছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি তেমন কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি।
সত্য যা–ই হোক, সকালের ঘোষণার পর উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) তোপের মুখে পড়ে মোদি সরকার। সংগঠনের সভাপতি অলোক কুমার বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন, ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন রোহিঙ্গাদের ভারতে কখনো থাকতে দেওয়া হবে না। তাঁদের শরণার্থী বলেও মেনে নেওয়া হবে না। পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা হিন্দু শরণার্থীরা দিল্লির মজনু-কা-টিলা এলাকায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন, অথচ সরকার মুসলমান রোহিঙ্গাদের ফ্ল্যাট দিচ্ছে? এটা মানা যায় না। সংগঠনের দাবি, রোহিঙ্গাদের ঘর দেওয়ার বদলে তাদের বাড়ি পাঠানোর বন্দোবস্ত করা হোক। সরকার সেই কাজে মন দিক।
ভিএইচপির আপত্তির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে দিল্লির আম আদমি পার্টিও। দলের মুখপাত্র সৌরভ ভরদ্বাজ বলেন, ‘দেশের নিরাপত্তা নিয়ে বিজেপি যে গভীর এক চক্রান্ত করছে, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিজেপি এখন রোহিঙ্গাদের পাকাপাকিভাবে দিল্লি থাকার বন্দোবস্ত করে দিতে চাইছে। পাকা ঘর দিচ্ছে। এরপর দোকান করার অনুমতি দেবে। নিরাপত্তার স্বার্থে দিল্লির জনগণ এ হতে দেবে না। তিনি বলেন, দিল্লি সরকারের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা না করেই কেন্দ্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিজেপি রোহিঙ্গাদের ঢুকিয়েছে। এখন তাদের ফেরত না পাঠিয়ে দিল্লিতে পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থা করছে।
সিদ্ধান্ত ঘোষণা ও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা বদল করার মধ্য দিয়ে আর যা–ই হোক কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বয়হীনতার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।