ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের শুনানী : পাহাড়ীরা স্বাগত জানালেও উদ্বিগ্ন বাঙালীরা

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশনে জমা পড়া প্রায় ২২ হাজার  আপত্তি আবেদন যাচাই-বাছাই করে শুনানীর সিদ্ধান্তে পাহাড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এ শুনানীকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে ফের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। আগামী ২৩ ডিসেম্বর থেকে এ শুনানী শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

পাহাড়ী নেতৃবৃন্দ এ শুনানীর মধ্য দিয়ে পাহাড়ে বিরাজিত ভূমি সমস্যার সমাধানে আশাবাদী হলেও বাঙালি সম্প্রদায় বৈষম্যমূলক ভূমি কমিশনের আইনে শুনানী হলে তাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশংকা প্রকাশ করে আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছে। ইতিমধ্যে শুনানীর প্রতিবাদে ২১ ডিসেম্বর(আজ) তিন পার্বত্য জেলায় মানববন্ধন কর্মসূচী দিয়েছে।

১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির আলোকে প্রণীত হয় পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন-২০০১। চুক্তির আলোকে হয়নি এমন অভিযোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান সন্তু লারমা শুরু থেকে এ আইনের বিরোধিতা  ও কমিশন বর্জন করে আসছিলেন। এক পর্যায়ে সন্তু লারমার সাথে সুর মিলিয়ে সার্কেল চিফরাও ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশনের বৈঠক বর্জন শুরু করলে কমিশনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। অপরদিকে আইনটি বৈষ্যমমূলক ও সংবিধান বিরোধী এমন দাবী করে বাঙালি সংগঠনগুলোও হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচী দিয়ে আইনটি সংশোধনের দাবী জানিয়ে আসছে।

এরই মধ্যে ২০১৬ সালের  ১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ভেটিং সাপেক্ষে ‘পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬’ এর খসড়ার নীতিগতভাবে অনুমোদন, ৮ আস্ট সংসদে পাশ ও ৯ আগস্ট তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে গেজেট আকারে প্রকাশের পর গত ৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদের পাশ হলে  বাঙালি সংগঠনগুলো আইন সংশোধনের পর থেকে আইনটি বাতিলের দাবীতে বাঙালি সংগঠনগুলোর আন্দোলন আরো জোরদার হয়।

এদিকে পাহাড়ে ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে ২০১৬ সালের  ৮ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফা ক্ষতিগ্রস্তদের ৪৫দিনের মধ্যে আবেদন চেয়ে জারি করা কমিশনের গণবিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে প্রায় ১৫ হাজার  আবেদনপত্র পড়ে। এতে করে দুই দফায় প্রায় ২২ হাজার ৯০টি আবেদনপত্র জমা পড়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবেদনকারীর অধিকাংশই পাহাড়ি।

চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশনের ৬ষ্ঠ বৈঠক শেষে কমিশনের দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পাওয়া চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত  বিচারপতি আনোয়ার উল হক জানান, ২৩ ডিসেম্বর জমা পড়া ২২ হাজার ৯০টি আপত্তি আবেদন যাচাই-বাছাই করে শুনানীর সিদ্ধান্তে নেওয়া হয়েছে জানান।

এ দিকে ২৩ ডিসেম্বর ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশনে জমা পড়া প্রায় ২২ হাজার  আপত্তি আবেদন যাচাই-বাছাই করে শুনানীর সিদ্ধান্তে পাহাড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ এ সিদ্ধান্তে পাহাড়ে দীর্ঘ দিনের সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে করলেও বাঙালিরা পরিস্থিতি আরো জটিল হবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন। তারা দাবী করছেন, সন্তু লারমা দীর্ঘদিন ধরে পুনর্বাসিত বাঙালিদের সমতলে ফিরিয়ে নেয়ার দাবী করছেন, এই পরোক্ষভাবে সে লক্ষে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে তারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে।

এরই অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ আজ ২১ ডিসেম্বর তারা তিন পার্বত্য জেলায় মানববন্ধন কর্মসূচী দিয়েছে। তাদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মানুষের সাথে আলোচনা না করে ভূমি কমিশন একপেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এতে সমস্যা আরো জটিল হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির(মূল) কেন্দ্রীয় তথ্য প্রচার সম্পাদক নগেন্দ্র চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন থেকে তিনি ভালো কিছু আশা করছেন। তবে এর কার্যক্রম শুরু না হওয়া পর্যন্ত আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির(এমএন) কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। পার্বত্য চুক্তিতে উল্লেখিত ভূমি কমিশনের বিধিমালা ও প্রবিধান হিসেবে কমিশন কাজ করবে বলে আশা করছি। এর বাইরে গেলে আমরা প্রতিবাদ জানানো।

বান্দরবান জেলা জনসংহতি সমিতির সভাপতি জলি মং মারমা ব্যক্তিগত মতামতের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ভূমি কমিশনের বিচারিক কার্যক্রম আদৌ হবে কি-না আমি সন্দিহান। কারণ বিচারিক প্রক্রিয়ার জন্য যেসব বিষয় দরকার তা এখনো হয়নি। সরকারের কার্যক্রম লোক দেখানো মাত্র। নিজের পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, বিচারিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য যেসব লোকবল, বিধিমালা প্রয়োজন তা এখনো অপরিষ্কার। বিচারিক প্রক্রিয়ায় রায় হলেও তা বাস্তবায়ন কারা করবে, কিভাবে করবে তার বিধিমালা হয়নি। এই কারণে পাহাড়ের মানুষের লাভ-ক্ষতির বিষয় ভাবা উচিৎ নয়।

লক্ষ্ণীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুল চৌধুরী বলেন, পাহাড়ি-বাঙালি এক সাথে আছি,এক সাথে থাকবো। ভূমি বিরোধ নিস্পত্তিতে কেউ যাতে আইনে বঞ্চিত না হয়, এটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ভূমি সমস্যা সমাধানে আশাবাদী।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি জুমলিয়াম আমলাই বলেছেন- দেরীতে হলেও ভূমি কমিশনের কার্যক্রম শুরু হতে যাওয়ায় সরকারকে ব্যক্তিগতভাবে সাধুবাদ জানাই। তবে আইন সংশোধন করতে যেভাবে ১৫ বছর লেগেছে সেভাবে যেন সময়ক্ষেপন করা না হয়। আমরা চাই ভূমি কমিশনের কার্যক্রম চলুক, বঞ্চিত মানুষরা সুবিধা পাক, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হউক। তিনি আরো বলেন- ভূমি কমিশন কার্যকর হলে পাহাড়ী হউক বা বাঙ্গালী হউক মূলত ক্ষতিগ্রস্তরা উপকৃত হবে। বিধি-বিধান অজুহাতে থমকে যাওয়ার কোন কারণ নেই। কমিশনকে কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

নাইক্ষ্যংছড়ি জনসংহতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও হেডম্যান মংনু মারমা বলেছেন- ভূমি কমিশন যতদ্রুত বিচারিক কার্যক্রম শুরু করতে পারবে ততো চলমান বিরোধীয় মামলাগুলো নিষ্পত্তি হবে। এতে করে পাহাড়ী-বাঙ্গালীরা ন্যায় বিচার পাবে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি রিন্টু চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কার্যক্রম শুরু হউক সেটি আমরা চাই। তবে পার্বত্য চুক্তির বিধি মোতাবেক কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন করে এর কার্যক্রম শুরু হউক। কমিশনের কার্যক্রম শুরু হলে সবার জন্য ভালো হবে বলে তিনি জানান।

ভূমি কমিশনের শুনানী বাতিল আইন সংশোধনের দাবীতে তৃণমূল পর্যায়ে গণ সংযোগ করে জনমত গঠন করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের নেতৃবৃন্দ

 

খাগড়াছড়ি জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আব্দুল মালেক মিন্টু বলেন, ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। বিচারক মন্ডলীর সংখ্যা অনুপাত  যদি একটি গোষ্ঠীর পক্ষে হয় তাহলে বঞ্চিত অপর পক্ষ কিভাবে প্রতিকার পাবে? মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বিচারাদালত যদি প্রশ্ন বিদ্ধ হয় সেখানে জনগন কি ন্যায় বিচার পাবে?

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ এর স্টিয়ারিং কমিটি সদস্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন এর একাংশের সাবেক মহাসচিব মোঃ মনিরুজ্জামান মনির বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে তিনি স্বাগত জানান। কিন্তু এই কমিশনে তিন পার্বত্য জেলা থেকে কোন বাঙ্গালি প্রতিনিধি না করায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি দাবি জানান, তিন পার্বত্য জেলা থেকে দুইজন করে বাঙ্গালি প্রতিনিধি নিয়োগ করা হউক। যাতে বাঙ্গালিরা তাদের অধিকারের কথা বলতে পারে। এই কমিশনের বেশি সুবিধা ভোগ করবে পাহাড়িরা এবং তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ির চেয়ে বাঙালি বেশি কেন কমিশনে তিন জেলা থেকে কোন প্রতিনিধি রাখা হয়নি? সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ এর স্টিয়ারিং কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং পিবিসিপি কেন্দ্রীয় সাবেক সভাপতি মোঃ আলমগীর কবির বলেন, আসলে ভূমি কমিশন একপেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এভাবে কমিশনের কার্যক্রম চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করবে। তাই পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করে কমিশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক দিয়ে ভূমি কমিশনের কার্যক্রম করলে সুযোগ-সুবিধা অন্য অন্য জাতিগোষ্ঠী ভোগ করতে পারবে না। এই কমিশনের আইন দ্রুত সংশোধন করা দরকার এবং আইন সংশোধন না করা পর্যন্ত কমিশনের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ রাখার  তিনি দাবি করেন।

পার্বত্য নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব এস এম মাসুম রানা পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশনে পাহাড়ি-বাঙালি সকল সম্প্রদায়ের সংখানুপাতে নেতৃত্ব নিয়োগ দেওয়ার দাবী জানিয়ে বলেন, জরিপের মাধ্যমে ভূমি সমস্যার সমাধান করতে হবে। বৈষ্যমমূলক আইন বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক আইন সংশোধন করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ এর স্টিয়ারিং কমিটি সদস্য এবং পার্বত্য গণ পরিষদ এর সাবেক সভাপতি এডভোকেট পারভেজ তালুকদার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সাধারণ মানুষ তাদের ভূমি হারার ভয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন নিয়ে শঙ্কিত।

বান্দরবানের তরুণ আইনজীবি মুহাম্মদ আবু তালেব বলেছেন, ভূমি কমিশনে বাঙ্গালী কোন প্রতিনিধি না থাকার কারনে বাঙ্গালীদের স্বার্থ রক্ষণাবেক্ষণ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তার মতে, উপজাতীয় কোন বাসিন্দা, বাঙ্গালী কারো জমি দাবী করে কমিশনে আবেদন করে এবং কমিশন যদি ওই উপজাতীর পক্ষে রায় দেন তাহলে বাঙ্গালীদের বৈধ কাগজ থাকলেও কোন কাজে আসবে না। এই আদালতে আইনজীবী নিয়োগের বিধান না থাকায় উপজাতীয় বিচারক বা সদস্যরা উপজাতীয়দের পক্ষে বাঙালিকে জেরা করলে বাঙালির পক্ষে জবাব দেয়ার কেউ থাকবে না। এই জন্য প্রথমেই কমিশনে বাঙ্গালী প্রতিনিধি যুক্ত করার দাবী জানান তিনি।

বান্দরবান পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক মুহাম্মদ মিজানুর রহমান আখন্দ বলেছেন- এই কমিশন বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে ধারণা করা হচ্ছে। পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন পাহাড়ি বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক বিরোধ হানাহানি সৃষ্টি করতে বাধ্য।

পাশাপাশি এই কমিশন এর এজেন্ডা বাস্তবায়ন হলে একটি মহল বিশেষ সুবিধা ভোগ করে অপর একটি জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে রসাতলে ডুবানো হবে। এই কমিশন বাস্তবায়িত হলে পুরো বাঙালি জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন এই নেতা।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান, পার্বত্য ভূমি কমিশন, ভূমি কমিশন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন