যে কারণে পোপা, পোয়া বা পোমা মাছ এত দামী?

fec-image

সম্প্রতি কক্সবাজারে এক জেলের জালে একসাথে অনেকগুলো কালো পোয়া মাছ ধরা পড়ার খবর বেশ আলোড়ন ফেলেছে। স্থানীয়ভাবে এই মাছকে অবশ্য পোপা বা দাঁতিনা মাছও বলা হয়।

শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) মহেশখালী সমুদ্র উপকূলে একটা জালেই ১৫৯টি পোপা মাছ ধরা পড়ার খবর চাউর হতেই এর দাম নিয়ে নানা গুঞ্জনও ডালপালা মেলে। কারণ জানা গেছে, শুরুতে জেলে মাছগুলোর দাম হাঁকিয়েছিলেন দুই কোটি টাকা।

তবে মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ বাচ্চু বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন, মাছগুলো চট্টগ্রামে ৩৬ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে লোকপ্রিয় মাছের তালিকায় খুব একটা শোনা যায় না এই মাছের নাম। ফলে জেলের হাঁকানো দাম এবং যে দামে ওই মাছ বিক্রি হয়েছে, তা খানিকটা বিস্ময়ই তৈরি করেছে।

কেন এত দামী এ মাছ?

ঢাকার বাজারে সাধারণত প্রতি কেজি পোপা বা পোয়া মাছের দাম আড়াইশো টাকা থেকে শুরু হয়। তবে আকৃতির ওপর ভিত্তি করে দামের ওঠানামা নির্ভর করে।

জানা যাচ্ছে, মহেশখালীতে যে কালো পোপা ধরা পড়েছে সেগুলোর একেকটির ওজন ছিল পাঁচ থেকে ১০ কেজির মধ্যে। এর মানে হচ্ছে এই মাছগুলো বেশ বড় আকারের ছিল।

কক্সবাজার মেরিন ফিশারিজ ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, দামটা আসলে নির্ভর করে মাছের এয়ার ব্লাডারের উপর।

এয়ার ব্লাডার বা সুইম ব্লাডার মাছের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এটি মাছকে পানিতে ভাসিয়ে রাখে।

ভেতরে বাতাসে ফাঁপা সাদা রংয়ের এই বস্তুটিকে কক্সবাজারের স্থানীয় ভাষায় ফদনা বলা হয়ে থাকে। কারো কারো কাছে এর পরিচয় ফ্যাপড়া বা ফটকা নামেও।

শফিকুর রহমান বলেন, “যে সমস্ত মাছে ফটকা বড় হয় তাদের মূল্যও বেশি হয়। বিভিন্ন কোম্পানি এখন সব মাছের এয়ার ব্লাডার সংগ্রহ করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা আছে, এগুলো বিদেশে রপ্তানি হয়।”

এই এয়ার ব্লাডার থেকে সার্জারির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং কসমেটিকস তৈরি হয় বলে জানান এই মৎস্য কর্মকর্তা।

“জাপানে এর গুরুত্ব বেশি, সেলাইয়ের সুতা, বিভিন্ন মেডিসিন এ থেকে উৎপন্ন হয়,” বলেন মি. শফিকুর।

পোয়া বা পোপা মাছ সম্পর্কে কী জানি আমরা

স্থানীয় বাজারে পোপা মাছের আট থেকে ১০ রকমের প্রজাতি আছে। তবে বাজারে মূলত লোনা পানি এবং মিঠা পানির পোয়া মাছ হিসেবেই লোকে আলাদা করেন একে।

তবে বাজারে যে পোয়া মাছ পাওয়া যায়, সেটা মিঠা পানির পোয়া মাছ।

এটি আকারে কিছুটা ছোট। সাধারণত দক্ষিণাঞ্চলের ভোলা বা পটুয়াখালীর দিকে নদীতে পাওয়া যায় এটি। এছাড়া চিংড়ি ঘেরেও এই জাতের পোয়া মাছের চাষ হয় এখন।

কিন্তু কালো ও লাল পোয়া গভীর সমুদ্রের মাছ। এগুলো লবণাক্ত পানিতে থাকে এবং আকারেও অনেক বড় হয়।

ট্রলার মালিক এবং মৎস্য ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের চোখে দেখার মধ্যে এই মাছটা দামী মাছ।

“সুন্দরবনের হরিণের মতো হঠাৎ এক ঝাঁক পাওয়া যায়। এটা বিভিন্ন জাতের হয়।”

মি. আবেদীন দাবি করেছেন, গভীর সমুদ্রের এই জাতের ৪০ বা ৫০ কেজি ওজনের মাছ কেজিতে এক লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

মহেশখালীতে যে কালো পোপা ধরা পড়েছে সেগুলোর একেকটি ওজন ছিল ১০ কেজির মধ্যে।

এছাড়া এই মাছের কিছু উপকারিতার কথাও বলেন মৎস বিজ্ঞানীরা।

শফিকুর রহমান জানান ডায়েবেটিস বা উচ্চরক্তচাপের ক্ষেত্রেও এই মাছ উপকারী। এছাড়া এটি কোলস্টেরল মুক্ত বলেও জানান তিনি।

এমনিতে এই মাছ খেতেও অনেক সুস্বাদু।

আর এসব কারণেই এ মাছটি এত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন মি. রহমান।

দেশের আরো সব দামী মাছ

পোপা বা পোয়া মাছের মতোই দামী আরেকটা মাছ হল ভোল মাছ। এ বছরের শুরুতেই খুলনায় প্রায় ২৪ কেজি ওজনের একটি ভোল মাছ বিক্রি হয় আট লাখ টাকায়।

আর এই মাছটির ওজন ৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

কক্সবাজারের সাংবাদিক আহসান সুমন বলছিলেন, “বড় ভোল মাছ গরুর মত জবাই করা হয়। এরপর শহরে মাইকিং করে মাংস বিক্রি হয়।”

তিনি বলেছেন, মহেশখালীতে ধরা পড়া পোপা মাছগুলোর আকার আরেকটু বড় হলে এর দাম আরও বেশি হত।

মৎসবিজ্ঞানী শফিকুর রহমান বলেছেন, মোট কথা যেসব মাছের আকার বড়, তাদের এয়ার ব্লাডার বড় হয় এবং দামও বেশি হয়। আর এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

“এখন কক্সবাজারে মাছ কিনলে জিজ্ঞেস করে এয়ার ব্লাডার রেখে দেবে কি-না। এয়ার ব্লাডার ছাড়া নিলে দাম কম পাওয়া যায়। আগে এগুলো জানতাম না।”

এছাড়া স্যামন মাছ যা স্থানীয়ভাবে তাইল্যা মাছ নামে পরিচিত সেটি এবং কামিলা মাছ সমুদ্রের দামী মাছগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে জানান মি. রহমান।

দামী এখন মাছের আঁশও

বাংলাদেশে এখন অন্যতম কয়েকটি অভিনব ব্যবসার একটি মাছের আঁশের রপ্তানি।

যদিও মাছে-ভাতে বাঙালি হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশের মানুষের কাছে মাছ বরাবরই জনপ্রিয় থাকলেও, মাছের আঁশের কোন কদর ছিল না।

কিন্তু সেই ফেলে দেয়া পণ্যটিও এখন রপ্তানি আয় আনতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মাছের আঁশ সাত-আটটি দেশে রপ্তানি হয়।

রপ্তানিকারক জুলফিকার আলম গণমাধ্যমকে বলেছেন, বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতিটি বাজারে যারা মাছ কাটেন, তারা সবাই আর আঁশ ফেলে না দিয়ে সংগ্রহ করে রেখে দেন।

“সারা দেশ থেকেই আমরা আঁশ সংগ্রহ করি। এক সময় যে পণ্যটি ফেলে দেয়া হতো, সেটি থেকে আমরা এখন রপ্তানি আয় করছি।”

তাদের কাছ থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসব আঁশ সংগ্রহ করে ময়লা দূর করে ধুয়ে শুকিয়ে নেন। এরপর রপ্তানিকারকরা সেগুলো প্রক্রিয়া করে বিদেশে রপ্তানি করেন।

যদিও মাত্র ১০-১২ জন ব্যক্তি আঁশ রপ্তানি করেন, কিন্তু সব মিলিয়ে এই ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ।

এখন বাংলাদেশ থেকেই প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার টন আঁশ রপ্তানি হয় জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোয়।

সেখানে মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন ও জিলেটিন তৈরি করা হয়। ওষুধ, প্রসাধন সামগ্রী, ফুড সাপ্লিমেন্ট তৈরি মাছের আঁশ ব্যবহৃত হয়।

এছাড়া কোলাজেন ও জিলেটিন মাছের আঁশ দিয়ে তৈরি হয়, যা ওষুধ ও প্রসাধন সামগ্রীতে কাজে লাগে।

এখন মাছের এয়ার ব্লাডার বা ফটকা যাই বলি না কেন সেটাও হয়ে উঠতে পারে রপ্তানি আয়ের উৎস।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, পোপা, পোয়া
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন