সম্প্রীতির বান্দরবানে হিংসার দাবানল: ৩ মাসে ১৭ খুন

সম্প্রীতির জেলা বান্দরবানে হিংসা, অশান্তি দাবনরের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ যেন নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এক সময় বান্দরবানকে বলা হতো সম্প্রীতির শহর। শহরের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় সাইনবোর্ডে এখনো চোখে পড়ে লেখা রয়েছে- সম্প্রীতির বান্দরবান।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে একসময় খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে চাঁদাবাজি আর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সবসময় আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলি, অপহরণ আর হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরণের অপরাধ সংগঠিত হলেও পার্বত্য জেলা বান্দরবান ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ জেলা। কিন্তু গত বছর দুয়ের ধরে যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে শান্তিপূর্ণ এ জেলাটি।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের আঞ্চলিক সংগঠনের সদস্যসহ ৭ উপজেলায় মোট খুন হয়েছে ১৮ জন। এর অধিকাংশই হয়েছে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনের চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে।
সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে জানা যায়, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি রাত ১টায় লামার রুপসীপাড়ার অংহ্লা পাড়ায় শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে রাঙ্গামাটির রাজস্থলীর বাঙ্গালহালীয়া এলাকার বাসিন্দা মংক্যচিং মার্মা (৩৫) সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হয়।
৬ জানুয়ারি, ২০২২: বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলায় রেথোয়াই মারমার স্ত্রী সিংয়ানু মারমা(৩০) কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে।
২ফেব্রুয়ারি, ২০২২: বান্দরবানের রুমা জোন (২৮ বীর) এর রাইক্ষিয়াংলেক আর্মি ক্যাম্পের সেনা টহল দলকে লক্ষ্য করে জেএসএস ( মুল) দলের সদস্যরা গুলি চালালে সেনা কর্মকর্তার নাম মো. হাবিবুর রহমান নিহত হয়। পরে সেনাসদস্যরাও জান বাঁচাতে পাল্টা গুলি চালালে জেএসএস মূল দলের তিন সদস্য মারা যায়। এ ঘটনায় আহত হয় আরো এক সেনা সদস্য।
২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২: বান্দরবানের রুমার গ্যালেংগা ইউনিয়নের আবু পাড়ায় সামাজিক কুসংস্কারের জেরে কারবারী ল্যাংরুই ম্রো (৬০) তার ছেলে রুংথুই ম্রো (৪৫), লেংরুং ম্রো (৪২), মেনওয়াই ম্রো (৩৭) ও রিংরাও ম্রো (৩৫) হত্যা করে পাড়াবাসীরা।
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২: বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে পাহাড়ি সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হয় জেএসএস এর সাবেক সদস্য মংচিং শৈ (৪০)।
৩ মার্চ, ২০২২: রোয়াংছড়ির নোয়াপতং এর আলেচু পাড়ায় (মহিলা কারবারি) এলাকায় ঝিরি থেকে এক নারীর গালা কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জুম ক্ষেত থেকে ফেরার পথে মিষ্টি কুমড়া চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
৫মার্চ, ২০২২: রোয়াংছড়ির তারাছা ইউনিয়নের তালুকদার পাড়ার উপরে নয়াপাড়া এলাকায় পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএসের মূল দলের সশস্ত্র গ্রুপের লিডার অনুমং মারমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এবং সর্বশেষ
৫মার্চ, ২০২২: রাতে বান্দরবানের রুমার পাইন্দুতে গোলাগুলির ঘটনায় ৬মার্চ সকাল ১১টায় রোয়াংছড়ির মংবাতং এলাকার সাঙ্গু নদীর তীরে চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
মূলত রোহিঙ্গা সমস্যা শুরু হওয়ার পর থেকেই বান্দরবানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অবনতি ঘটতে থাকে। স্থানীয় প্রভাবশালী একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা প্রতিবেশী একটি দেশের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সহায়তার আশ্বাস লাভে সক্ষম হয়। এরপর বান্দরবানের দূর্গম এলাকা থেকে ওই দলের সমর্থক জনপ্রতিনিধি ও যুবক শ্রেণি বিভিন্ন ব্যাচে সীমান্ত পার হয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। এরসময় তারা বেশ কিছু অস্ত্রের চালানও আনতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের মধ্যে বান্দরবানই একমাত্র জেলা যার সাথে দুইটি দেশের সীমান্ত রয়েছে। উক্ত সীমান্ত অত্যন্ত দূর্গম হওয়ায় সীমানা পেরিয়ে ট্রাই জংশনের ওপারে বাংলাদেশী বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ ছাড়াও অন্য একটি প্রতিবেশী দেশও দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে সক্রিয় হয়েছে। বান্দরবানে সম্প্রতি সংঘটিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের আলামত বিশ্লেষণ করে এ নতিজা পাওয়া গেছে।
অপর একটি সূত্র, পার্বত্যনিউজ জানতে পেরেছে, আগামী বছর ৭ জানুয়ারি শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠা দিবসে এ বাহিনী পুণরুজ্জীবনের লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। ওই দিনের পর থেকে শান্তিবাহিনী সরাসরি চুক্তি পূর্ববর্তী অবস্থায় যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। তার পূর্বে সন্ত্রাসীরা মিডল লাইন ধংস করার লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। বর্তমান হত্যাকাণ্ডগুলো তার অংশ বিশেষ হতে পারে।
বান্দরবানের পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এর জেলা সেক্রেটারি উবামং মারমা বলেন, বান্দরবানের পাহাড় দিনে দিনে অশান্ত হয়ে উঠছে। আমরা এমন পরিবেশ বান্দরবানে দেখতে চাই না। তিনি বলেন, বান্দরবানে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হওয়া খুবই জরুরী।
বান্দরবানের যুবলীগের সভাপতি কেলু মং মারমা বলেন, বান্দরবানের পরিস্থিতি এতই খারাপ যে, আমরা এখন কোথাও যেতে পারি না। যে কোন মূহুর্তে আমাদের উপরও হামলা হতে পারে। আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাই।
এ বিষয়ে বান্দরবান পুলিশ সুপার জেরিন আখতার জানান, বান্দরবানের বর্তমান পরিস্থিতি তেমন ভাল নয়। একসময় বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ছিল। এসময় তিনি যে কোন মূল্যে বান্দরবানের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, সকলের এ পরিস্থিতিতে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে চলতে হবে। এসময় তিনি সকলকে নিরাপদে চলাফেরা করার জন্য অনুরোধ করেন।