সাজেক পর্যটনকেন্দ্রকে পুণরায় বস্তিতে পরিণত করা ঠিক হবে না


ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা না মানায় আগুনের তীব্রতা
দেশের পর্যটনপ্রেমীদের প্রিয় সাজেক এখন অনেকটা বিরানভূমি। সম্প্রতি এক ভয়াবহ আগুনে সাজেকের রিসোর্ট মালিকদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় লুসাই ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ৩৫টি পরিবার। আর এ আগুনের ক্ষয়ক্ষতির জন্য অনেকে দায়ী করছে মুনাফালোভী রিসোর্ট ও হোটেল মালিকদের। যারা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সাজেককে বস্তি বানিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা ও সুরক্ষা মানেননি ব্যবসায়ীরা। রিসোর্ট ও হোটেলে নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় আগুনে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। প্রশাসন সাজেকের প্রকৃত সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সাজেক হবে পরিকল্পিত, বস্তি হিসেবে নয়। এর জন্য সাজেকে পানি ব্যবস্থা, ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশন স্থাপন, হাসপাতাল স্থাপনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মেঘ-পাহাড়ের উপত্যকা পর্যটন কেন্দ্র সাাজেক। দেশের পর্যটনপ্রেম মানুষের কাছে সাজেক পছন্দের শীর্ষে। ২০০১ সাল থেকে হাতেগোনা কিছু পর্যটক সাজেকে সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেড়াতে যেতেন। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ২০১৩ সালের দিকে সাজেকে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকায় গত প্রায় ১২ বছরে সাজেকে ব্যক্তি উদ্যোগে রিসোর্ট, কটেজ ও হোটেলসহ প্রায় ২৪৯টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারণে সাজেক তার প্রকৃত রূপ হারিয়ে বস্তিতে পারণত হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারী দুপুরে রুইলুইপাড়ার ইকো বেলী রিসোর্টে হঠাৎ এক আগুনে ‘অগ্নিপুরীতে পরিণত প্রিয় সাজেক। আগুনের ঘটনায় ৯৬টি স্থাপনা পুড়ে যায়। তারমধ্যে লুসাই ত্রিপুরাদের ৩৬টি বসতঘর পুড়ে তারা এখন নি:ম্ব। এছাড়া রিসোর্ট ও কটেজ ৩৪টি, হোটেল ৭ এবং দোকান ১৯টি।
সাজেক রিসোর্ট মালিক সমিতির যুগ্ন সম্পাদক মো: ইব্রাহিম বলেন, সাজেকের অধিকাংশ রিসোর্ট ও কটেজ ও হোটেলে নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। যাদের আছে তারাও ব্যবহার জানে না। অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণের কারণে পুরো সাজেকে বস্তিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন,প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এ বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চাই। সাজেককে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাই।
খাগড়াছড়ি ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জাকের হোসেন বলেন, সাজেকে আগুন লাগার খবর পেয়ে খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলা ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট মুভ করে। তার মধ্যে ৬টি ইউনিট প্রায় সাড়ে ৩ ঘন্টা চেষ্টা করে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করি।
মোহাম্মদ জাকের হোসেনের অভিযোাগ, সাজেক পর্যাক্রমে বড় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠলেও ছিল না যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা।স্থাপনাগুলোও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। রির্সোটগুলোতে অগ্নিনির্বাপনের নিজস্ব ব্যবস্থা ছিল না। রির্সোটগুলো কাঠের তৈরি হওয়ায় বাতাসে তীব্রতায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।
পাহাড়ের প্রবীণ সাংবাদিক তরুণ কুমার ভট্টাচার্যের মতে, পুরো সাজেক অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এখনই সতর্ক না হলে আগামীতে আরো বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তিনি অভিযোগ করেন, খাগড়াছড়ির সাংবাদিকরাই ২০০১ সাল থেকে সাজেক নিয়ে লিখেছে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সাজেক পরিপূর্ণ পর্যটক কেন্দ্র হিসেবে রূপ পেয়েছে। সে সুবাধে সেখানে অনেকে রিসোর্ট, কটেজ ও হোটেলের মালিক বনে গেছেন। খাগড়াছড়ির সাংবাদিকরা সাজেককে বিশ্বের কাছে উপস্থাপনের জন্য চেষ্টা করেছে। অথচ সাজেকের কিছু কিছু রিসোর্ট মালিক সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ ভাবছে। সাজেকে কোন দুর্ঘটনার নিউজ হলে কতিপয় মালিক সমিতির নেতা সাংবাদিকদের উপর চড়াও হন। এরা এখন প্রশাসনের সিদ্ধান্তও মানতে চান না।
এদিকে সাজেকে সাম্প্রতিক আগুনের পর প্রশাসনও ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতার পাশাপাশি কঠোর হচ্ছেন। রিসোর্ট ও কটেজ মালিকদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন সাজেক আর বস্তি হবে না।
খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শরীফ মো: আমান হাসান বলেছেন, সাজেককে আর বস্তি হিসেবে দেখতে চাই না। পরিকল্পিত সাজেক হিসেবে আমরা দেখতে চাই। সাজেক বললে পর্যটকরা যাতে ভাবে আমরা বিদেশে আসছি। এমন সুন্দর করে সাজেককে সাজানো যায় সে চেষ্টাই করছি। সাজেকের বাসিন্দারা এখানকার ভূমির মালিক। আমরা শুধু বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করবো।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনী সাজেকের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ক্ষতি এড়ানো যায়, তার জন্য সাজেকে ফায়ার ষ্টেশন স্থাপন, ১০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ, পানির সুবিধা নিশ্চিত করা। সম্মিলিত প্রকল্প নেওয়ার চেষ্টা করছি। সকলের সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্তরা ঘুরে দাঁড়ানো সুযোগ পায়। হয়তো একটু সময় লাগবে।
প্রশাসনের সহযোগিতায় সাজেকের ক্ষতিগ্রস্তরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে প্রত্যাশা সকলের।