অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র ঠেগামুখ সীমান্তে

fec-image

ভারতের মিজোরামের ব্লু মাউন্টেন বা নীল পাহাড়ের কিংবা লুসাই পাহাড়ের স্রোতোধারা এসে মিশেছে রাঙামাটির বরকল উপজেলার ঠেগামুখ সীমান্তে। মিজোরামের সীমান্তঘেঁষা ঠেগা হয়ে বয়ে আসে কর্ণফুলীর মূল স্রোত। এক বাক্যে এ এলাকাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি বলা যায়। এলাকাটি যেনো আল্লাহ তায়ালার নিজ হাতে গড়া স্বপ্নশৈলী। যতদূর চোখ যায় মন ভেসে যায় স্বপ্নলোকে। নদীর দুই পাশে, দুই দেশেই চাকমাদের বসতি। তাই সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট। ছোট কর্ণফুলীর দূরত্ব এখানে বাধা হতে পারেনি।

নীলকণ্ঠ পাখির মতো সীমান্তে তেমন কড়াকড়ি নেই। সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফ পারস্পরিক বন্ধুত্ব রয়েছে। জোন অধিনায়কের সহযোগিতা ও আন্তরিকতায় মিলল ঠেগামুখ দেখার সুযোগ।

বড় হরিণা, মরা থেগা, থেগাসহ একাধিক সীমান্তচৌকিতে বিজিবি জওয়ানদের উপস্থিতি। দিন-রাত টহল চলে এখানকার সীমান্তে। কর্ণফুলীর উজানে নদীর মাঝ বরাবর ‘শূন্যরেখা’। ভারত-বাংলাদেশের পতাকাবাহী নৌকা চলছে নদীপথে। বছরের পর বছর ধরে এখানে দুই দেশের মানুষ বসবাস করছে। তবে ছোট হরিণার পর নিরাপত্তার জন্য বাঙালিদের চলাচল করার অনুমতি নেই।

ছোট হরিণা থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে ঠেগামুখ সীমান্ত। সীমান্তের পাশেই ঠেগামুখ বাজার এবং ঠেগামুখ বিওপি। পরিপাটি ঠেগামুখ ক্যাম্প। ক্যাম্পের গোলঘরে বসেই চোখে পড়ে মিজোরামের নীল পাহাড়, মিজো গ্রাম আর সবুজ দৃশ্যপট।

বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় নৌবন্দরের তালিকায় রয়েছে ঠেগামুখ। রয়েছে এর বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা।

রাঙামাটি থেকে যাত্রা
কান্ট্রি বোট ইঞ্জিনের শব্দ তুলে ছুটে চলে রাঙামাটি থেকে বরকল। রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা ৭৬ কিলোমিটারের দীর্ঘ জলপথ। এই পথে কেবল অচেনা পাখি, পাহাড় আর জলের মিলনের সুর। বরকল বাজার থেকে ছোট হরিণের পথে রওনা দিতে বিকেল ছুঁই ছুঁই। ক্লান্তিহীন প্রায় ১০ ঘণ্টার ভ্রমণ। কাপ্তাই লেকের কোল ঘেঁষে থাকা পাহাড়, দলছুট বাড়ি, কোথাও কোথাও পাখির ঝাঁক। বরকল বাজার পাড়ি দিতে না-দিতেই চোখ ধাঁধানো সব দৃশ্যপট।

শেষ বিকেলে ছোট হরিণের আগেই ভূষণ ছড়ায় নামতে হলো। পানি কম হওয়ায় ওদিকটায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ভূষণ ছড়ায় নেমে ভাড়ায় চালিত বাইকে ছোট হরিণা ঘাট। তারপর নৌকায় পার হলেই ছোট হরিণা বাজার। দিনের আলো ফুরিয়ে যাওয়ায় এক দিন এখানে থাকতে হলো।

ঠেগামুখ
পরদিন সকালে বিশেষ ইঞ্জিনচালিত দ্রুতগতির বার্মিজ বোটে ভূষণ ছড়া থেকে ঠেগামুখ। সামনে যেতেই সুউচ্চ টারশিয়ান যুগের পাহাড়। এর ভাঁজে ভাঁজে পাহাড়িদের বসতি। বড় হরিণা ক্যাম্পে ক্ষণিকের বিরতি। ক্যাম্পের উল্টো দিকে জিরার খামার। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর দেখা মেলে মিজোরাম সীমান্ত।

বিএসএফের নিরাপত্তাচৌকি। সুদূরে উঁচু পাহাড়ের সীমানা। পথে পথে মিজোদের যাতায়াত। কর্ণফুলীর পাড় ঘেঁষে অচেনা মিজো গ্রামের নান্দনিক বসতবাড়ি। ওপারে সীমান্তে মেলে নাগরিক জীবনের সব সুবিধা। মিজোরামে পাকা সড়ক, বিদ্যুৎ—সবই আছে। কোথাও কোথাও ভারতীয় পতাকাবাহী নৌকায় মিজোদের যাতায়াত। ঠেগামুখ বাজারে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা।

মিজোরামের সীমান্তঘেঁষা শিলচরহাটে বাংলাদেশ থেকে পাহাড়িরা গিয়ে সদাই করে আবার ফিরে আসে ঠেগামুখে। ওপারের বাসিন্দারাও ঠেগামুখ থেকে বাজার করে নিয়ে যায়। মাঝখানে কেবল একটি নদীর দূরত্ব।

বাজারটি সরকারি করা হয় ২০০৩ সালে। সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০টি দোকান। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার হাট বসে। সেদিন দূর-দূরান্তের বাসিন্দা এবং দুই দেশের মানুষের উপস্থিতিতে সরগরম থাকে ঠেগামুখ হাট।

এখানকার দোকানদার রুমা চাকমা (৩২) জানান, আট বছর ধরে এখানে দোকান করছেন তিনি। ভালোই বেচাকেনা হয়। দুই পারের মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। ঠেগামুখ বাজার থেকে নিত্যপণ্য কিনে আবার ফিরে যাচ্ছে মিজোরামের নাগরিকেরা। বছরে পর বছর এখানে এভাবে চলে লেনদেন।

দীর্ঘ সময় ঠেগামুখ বাজারে কাটিয়ে আবার রওনা হলাম ছোট হরিণ। এবার ফিরতি পথ। দিন শেষে পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে যাচ্ছে শেষ বিকেলের সূর্য। পূর্ব আকাশে পাহাড়ে হেলান দিয়েছে পূর্ণিমার ঝকঝকে চাঁদ। চাঁদের আলোয় ডুবে থাকে চিত্রপটের মতোই সুন্দর হরিণ, শ্রীনগর, নীলকণ্ঠ, মিজোরামের পাহাড় ও ঠেগামুখ।

প্রয়োজনীয় তথ্য
অনুমতি ছাড়া ঠেগামুখ যাওয়া যায় না। সব সময় অনুমতিও পাওয়া যায় না। অনুমতি পেলে প্রথমে জলযানে রাঙামাটি থেকে বরকল। সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। বরকল থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ ছোট হরিণা। তবে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় সময় আরও বেশি লাগতে পারে।

ছোট হরিণায় থাকার তেমন ভালো আয়োজন নেই। থাকতে হবে দোতলা বোর্ডিংয়ে। শৌচাগারের সুবিধা নেই। তবে খাবারের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। বাজারের বাথুয়ায় রাখাইন খাবারের ষোলো আনা স্বাদ পাওয়া যায়। বার্মিজ বোটে সময় লাগবে দুই ঘণ্টা। সূত্র: আজকের পত্রিকা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন