ইইউ প্রতিনিধি দলের কাছে বৈষম্যের অভিযোগ তুললেন বাঙালী নেতৃবৃন্দ

RHDC Picture-09-02-14-04

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:

পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল ক্ষেত্রে বাঙালীরা বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে বলে সফররত ইইউ প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাঙালী নেতৃবৃন্দ। জাতিসংঘ ও ইইউ’র সাহায্যে পরিচালিত প্রকল্পগুলোতেও এই বৈষম্য ব্যাপক। গতকাল বাংলাদেশে ইইউ প্রধান ইউলিয়াম হান্না’র নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সাথে স্থানীয় বাঙালী নেতৃবৃন্দের বৈঠকে এ অভিযোগ করা হয়।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির বর্তমান অবস্থা কিভাবে উন্নয়ন করা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের নির্বাচনসহ পার্বত্যাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও এই অঞ্চলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পসমূহ পরিদর্শনের পাশাপাশি এখানকার স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে দুই দিনের সফরে পার্বত্য শহর রাঙামাটিতে এসেছেন পাচঁ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল। ইইউ এর রাষ্ট্রদূত ও ডেলিগেশন টিমের প্রধান মি. উইলিয়াম হান্না’র নেতৃত্বে তার স্ত্রী মিসেস পাওইয়া ফরনারী হান্না, ঢাকাস্থ ইইউ কার্যালয়ের ফ্রাস্ট কনস্যুলার মি. ফিলিপ্পি জেককুইস, সেকেন্ড সেক্রেটারি মিসেস লিনকা ভিটকোভা ও মি. ফেব্রিজিও সেনেসিসহ পাচঁ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি রাঙামাটিতে এসে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা, রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল, রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়সহ রাঙামাটিতে বসবাসরত উপজাতীয় সমাজের নেতৃবৃন্দ, সরকারি পিপি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ ও পার্বত্য নাগরিক পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে। প্রায় প্রতিটি পক্ষের সাথেই অন্তত এক ঘণ্টা করে চলে ইইউ প্রতিনিধি দলের একান্ত বৈঠক।

সারাদিনব্যাপী চলা এসব বৈঠক সম্পর্কে জানা গেছে আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ও রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এর কার্যালয়ে পৃথক পৃথক বৈঠক শেষে প্রতিনিধি দলটি রোববার দুপুরের পর থেকেই রাঙামাটি শহরের ইউএনডিপি কার্যালয়ে বৈঠকে মিলিত হন সুশীল সমাজ পাহাড়ি-বাঙ্গালী নেতৃবৃন্দের সাথে। এখানে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হওয়া বৈঠকের মধ্যে পাহাড়িদের মধ্যে নেতৃত্ব দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের আহবায়ক সাবেক স্থানীয় সরকার পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, এডভোকেট গুনেন্দু বিকাশ চাকমা, সদস্য সচিব যশেশ্বর চাকমাসহ মোট ছয়জনের একটি প্রতিনিধি দল। এসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলটির সাথে একান্ত বৈঠকে উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের ধীরে চলো নীতি অবলম্বন, পার্বত্য ভূমি সমস্যা, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী স্থানীয় বিভাগগুলোকে জেলা পরিষদে হস্তান্তর না করাসহ আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে ইইউ প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে বিকেলে বেলা পাচঁটার দিকে বাঙ্গালী প্রতিনিধি দলের সাথে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলটি। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারুক আহম্মেদ সাব্বির, রাঙামাটি জেলা কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি সেলিম ও সহ সভাপতি তুহিন। এসময় একই বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন, পার্বত্য নাগরিক পরিষদের জেলা আহবায়ক বেগম নুর জাহান। বৈঠকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাঙামাটি জেলা প্রেসক্লাবে সভাপতি সুনীল কান্তি দে, রাঙামাটি জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট রফিকুল ইসলাম, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মনিরুজ্জামান মহসিন রানা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পাড়া’র নির্বাহী পরিচালক আব্বাস আলী।

বৈঠকের উপস্থিত ছিলেন এমন একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিতে কোনো প্রভাব পড়েছে কিনা এমন প্রশ্ন রেখে উত্তর জানতে চাওয়া হয় বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দের কাছে। উত্তরে এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, নির্বাচনের পরে অতি সম্প্রতি রাজস্থলী উপজেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের একজন প্রথম সারির নেতাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যাসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আশানুরূপ নয়, শুধুমাত্র জেলা সদরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক রয়েছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ যে সকল প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে, সেগুলো চলমান রাখবে কিনা ইইউ প্রতিনিধি দলের এমন প্রশ্নের জবাবে বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানান, পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছে শুধুমাত্র একটি বিশেষ গোষ্টির সাথে এখানে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হওয়ায় অত্রাঞ্চলে বাঙ্গালী সম্প্রদায় এই চুক্তি মানেনি এবং এর বাস্তবায়ন চায় না। এ ছাড়া এসকল প্রকল্পে বাঙালীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলেও তারা অভিযোগ করেন। বৈঠকে জানানো হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এখানে উচ্চ শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করে দেওয়ার পাশাপাশি বিদেশ থেকে যেসকল স্কলারশীপ প্রদান করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বাঙ্গালী শিক্ষার্থীরা এর থেকে পরিত্রাণ দাবি করে এব্যাপারে ইইউ প্রতিনিধি দলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বাঙ্গালী নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা অর্জনে এখানে ভালো মানের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলে হানাহানি অনেকটা বন্ধ হয়ে যাবে উল্লেখ করে বক্তারা ইইউ প্রতিনিধি দলকে জানান একজন লোক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলে সে কখোনো সন্ত্রাসের পথে যাবে না বা যেতে পারে না। এখানে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে এখানে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে এখানের সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে যাবে বলেও প্রতিনিধি দলের কাছে মন্তব্য করেন সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। বৈঠকের সকলের আলোচনা শুনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের মধ্যে যেসব বিরাজমান সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায় কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে বাঙ্গালী নেতৃবৃন্দ পার্বত্যাঞ্চলের সার্বিক মঙ্গলের জন্য সকল প্রকার সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।

পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ নেতৃবৃন্দ প্রতিনিধি দলের কাছে নিম্নলিখিত দাবীসমূহ তুলে ধরেন:
    পার্বত্য শান্তিচুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল জাতি-গোষ্ঠির কাছে গ্রহণযোগ্য নয় ও সংবিধান বিরোধী, তাই স্থায়ী ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চত করা ।
     চুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে শান্তি আসেনি, বরং এখনও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করা হচ্ছে, চাঁদাবাজি করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত যা শান্তির অন্তরায়।
    পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি সমস্যা সমাধানে যে ভূমি কমিশন আইন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা অত্রাঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠির কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় গ্রহণযোগ্য ভূমি কমিশন আইন করা একান্ত জরুরী অন্যথায় ভূমি  সমস্যা কমার পরিবর্তে আরও বাড়বে বলে মনে করে পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ। ।
    উপজাতি জনগোষ্ঠি শিক্ষা, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদেশে স্কলারশীপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পায় অন্যদিকে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি কোন কোটা সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় উপজাতি ও বাঙ্গালীদের মধ্যে বিদ্বেষী  মনোভাব গড়ে উঠছে । যা মাঝে মাঝে উপজাতি-বাঙালী দাঙ্গায় রৃপনেয়।
    পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) নাই  যার ফলে অত্রাঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজিসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হচ্ছে। এবিষয়ে প্রদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তাদের অনুরোধ জানানো হয়।
    পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হচ্ছে না ফলে শিক্ষিতরা বেকার  রয়ে যাচ্ছে এবং সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজীসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হচ্ছে। এসমস্যা সমাধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, ট্যুরিজম সেক্টরকে উন্নত করণে প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।
    যতদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হয় ততদিন পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী বহাল রাখা জরুরী মনে করে পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ।
    পার্বত্য চট্টগামে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের জন্য উপজাতি নেতৃবৃন্দ ও বাঙ্গালী নেতৃবৃন্দের মাঝে সংলাপ করে স্থায়ী ও টেকসই সমাধান বের করা।

অন্যদিকে বৈঠকে পার্বত্য চুক্তি নিয়ে সরকারের আইনগত অবস্থানের ব্যাখ্যা দেন রাঙামাটি জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট রফিকুল ইসলাম। তিনি ইইউ প্রতিনিধি দলকে জানান, পার্বত্য চুক্তির বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট বিচারাধীন রয়েছে। হাইকোর্টে এই রিট মামলায় চুক্তির কিছু কিছু ধারা ও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চুক্তির বিষয়ে এই রিট মামলাটি এখনো চলমান থাকায় সরকার পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে একটু ধীর পলিসি অবলম্বন করছে।

গতবার ক্ষমতায় এসে সরকার বলেছিলো চুক্তি বাস্তবায়ন করবে, এবারো নির্বাচনের আগে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ক্ষমতায় আসলে চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে কিন্তু করা হচ্ছে না কেন ? এমন প্রশ্নের জবাবে পিপি জানান, এই চুক্তি করার সময় উপজাতীয়দের একটি পক্ষ থেকে যেমন বিরোধীতা করা হয়েছে তেমনি বাঙ্গালীদের পক্ষ থেকেও করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য ভূমি কমিশন বিষয়ে বাঙ্গালীদের পাশাপাশি সন্তু লারমাও এই কমিশনের কিছু কিছু কার্যক্রমের বিরোধীতা করেছেন, তাই এই চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার একটু সময় নিয়ে এগুচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বাঙালী, শান্তিচুক্তি
Facebook Comment

One Reply to “ইইউ প্রতিনিধি দলের কাছে বৈষম্যের অভিযোগ তুললেন বাঙালী নেতৃবৃন্দ”

  1. we hate the CHT.Treaty . It is an unpiece and unrest Treaty . Besides, it’s a trade licence of JSS and UPDF .If it becomes fullfill , Bangladesh will lost CHT and 5093 square mile . It is also against our liberation war . we do not like Zumland . We love our motherland Bangladesh .(Shurma Secretary , Shama Adhikar Nari Andolon , Rangamati)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন