পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি অস্তাচলে-১

ইউপিডিএফ ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে গেল আজকের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে

fec-image

 

আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ ২০০৩ সালে দ্বিতীয় বারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের পানছড়ি জোনে যোগদান করি। সূর্য তখন চেঙ্গী নদীর পশ্চিম পাড়ের পাহাড়ে ঢলে পড়েছে। সূর্যের লাল আলোটা পাহাড়ের ওপরে একটা রক্তিমাভ আবহ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু পাহাড়ের এপাশে গাঢ় অন্ধকারের একটা মোটা রেখা নদীর পাড় বরাবর নেমে এসেছে।

পানছড়ির কলেজ গেট বলে খ্যাত চত্বরটি যখন পার হই, তখনই সামনের বাজারের মাইক থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসে। রমজান মাস চলছে, আজান শুনে ফাঁকা রাস্তায় চালক গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। এখান থেকে এক মাইল দূরত্বে পানছড়ির জোন সদর। পানছড়ি সরকারি কলেজটি পাকা সড়কের পূর্বপার্শে প্রায় দু’শ গজ দূরে অবস্থিত। কলেজের সাদা দেওয়ালে লাল কালিতে লেখা রাজনৈতিক শ্লোগানগুলো খুব স্পষ্ট:

‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে’,
‘সকল সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করতে হবে’
‘জুম্মু জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দাও’

এসব শ্লোগান পড়তে পড়তেই এবং আজান শেষ হতে না হতেই পানছড়ি জোন সদরে এসে হাজির হই।

সদর মেসে অপেক্ষমান অধিনায়কের সাথে ইফতারে যোগদান করার মিনিট দশেক পরেই জোন সিকিউরিটির ফিল্ড সোর্স কালাম ছুটে এসে জানালো, ‘স্যার, কলেজ গেট এলাকায় জেএসএস সমর্থক বিধানকে ইউপিডিএফের ক্যাডাররা এই মাত্র গুলি করে মেরেছে।’
আমি সিওকে বললাম, ‘আমার সাথে আসা স্কর্ট এখনো কোতে অস্ত্র জমা দেয়নি, আমি প্রস্তুত আছি, আমি যাই স্পটে।’ অনুমোতি পেয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে টহল দলটিকে নিয়ে রওনা হই।

জেএসএস (জন সংহতি সমিতি) এর অফিসটি পাকা রাস্তার ধারেই। এখানে প্রাক্তন শান্তিবাহিনীর আত্মসমর্পণকারী অনেকেরই ঘর এবং দোকানপাট। বিধান এখানেই একটি দোকান ঘর তুলে ব্যবসা করতো। ওর কাজ ছিলো পাহাড়ের ভিতর থেকে আসা গ্রামীণ লোকজনের উপর নজর রাখা। সামরিক পরিভাষায় এলপি (লিসেনিং পোস্ট বা শ্রবণ চৌকী)।

এই শ্রবণ চৌকীকে নিরব করার জন্য ইফতারের সময়টি বেছে নেয় ইউপিডিএফ ক্যাডাররা। পরিকল্পনাকারীদের ধারণা, এসময়টা সেনাবাহিনী ইফতার এবং নামাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আমাদের বহনকারী শেষ টহল দলটি কলেজ গেট অতিক্রম করার সাথে সাথেই ইউপিডিএফের ক্যাডাররা পানছড়ি কলেজ এলাকা থেকে এসে একে-৪৭ রাইফেলের দুটো গুলি খরচ করে বিধানের বুকে।

আমি যখন এসে পৌঁছাই বিধানের লাশটি রাস্তার ঢালুতে পড়েছিল। শরীর থেকে নিসৃত রক্তের ধারা তখনও ক্রমে নিচের দিকে নামছে। সংলগ্ন অন্য দোকান এবং ঘরগুলো ফাঁকা। রক্তের ধারা অনুসরণ করে পূর্ব দিকে মীর্জা টিলার দিকে এগিয়ে যাই। আততায়ী দল এ পাড়ার উপর দিয়েই পালিয়ে গেছে, তা সাধারণ ধারণাই বলে। কয়েকজন যুবক বয়সী ছেলের দেখা মিললো। তাদের কাছে কিছু ক্ষণ আগে ঘটা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। একেবারে বেমালুম অস্বীকার করে ওরা, কী ঘটেছে তা না জানার ভান করে, এমনকি কোনো গুলির আওয়াজও তারা শুনেনি বলে জানায়।

আমার সাথে থাকা আনসারের ফিল্ড সোর্স বললো, ‘স্যার, এটা ইউপিডিএফ সমর্থক পাড়া ওরা কিছুই বলবে না।’

ফেরত আসার পথে সন্তু লারমা’র পিতার স্মরণে নির্মিত একটা স্মারক চোখে পড়লো। মীর্জা টিলা আর কলেজ গেইট এলাকার মাঝামাঝি স্থানে নির্মিত এই স্মারকটিকে দুই সংগঠনের বিভক্তির প্রতীক বলে মনে হলো।

লাশের পাশে ফিরে এসে দেখলাম, মৃতের সদ্য বিধবা স্ত্রী পাশের দোকানে বসে আছে। উদাস দৃষ্টি তার। তবে তিনি কোনো রকম বিলাপ করছেন না। যা আমরা বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে দেখি, সুর করে বা বিলাপ করে কান্না করা।

তবে তার পাশে থাকা ৮/৯ বয়সী মেয়েটিকে দেখলাম, মায়ের আঁচল ধরে মৃদুস্বরে কাঁদছে আর ক্ষণে ক্ষণে চোখ মুছছে। আসলে বাবার জন্য সব মেয়েই কাঁদে।

কে যেন একটা হাতে বোনা চাদর দিয়ে লাশটিকে ঢেকে দিয়েছে। থানা পুলিশের কাছে লাশটি বুঝিয়ে দিয়ে জোন সদরের দিকে চলছি। আর কী ঘটেছে তারই একটা বিশ্লেষণ মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো।

আমার চিন্তার গতি আরো বেগবান হয় পিছনের সিটে বসা সোর্স কালামের মন্তব্যে, ‘স্যার, আজই জয়েন দিলেন, এসেই লাশ দেখলেন্।’

আমি কিছু বললাম না। তবে সে নিজেই শেষ অংশটুকু বলে দিলো, ‘লাশ আরো পড়বে মনে হয়।’

শান্তি চুক্তির পর দ্বিতীয়বারের জন্য পাহাড়ে আসার সময় ভেবেছিলাম, পাহাড়ের সংঘাত বুঝি কমেছে। কিন্তু আমার ধারণা দ্রুতই বদলে যেতে লাগলো।

বিধান হত্যার দু’দিন পর মীর্জা টীলা পার হয়ে লতিবানছড়ার সরু ব্রিজের গোড়ায় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির লাশ পড়ে থাকার খবর আসে। পুলিশকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি, নিহত ব্যাক্তি আর তাকে বহনকারী সাইকেল। পাশ দিয়ে চলাচলকারী কেউ বলতে পারে না লোকটি কে। জিজ্ঞেস করলে শুধু বলে, ‘মুই ন চিনি।’ সবার একই উওর।

লোকটির সাথে থাকা সাইকেল, বাজারের ব্যাগ বলে দেয় যে, সে আশে পাশের কোনো পাড়ার বাসিন্দা। কিন্তু ভয়ে সবার কাছে সে অজ্ঞাতনামা। পাহাড়িদের এই আচরণ আমাকে সব সময় বিস্মিত করতো। দু’দিন আগে বিধান হত্যার সাথে এর একটা যোগসূত্র অবশ্যই আছে। বিধান হত্যার পর জেএসএস প্রতিবাদলিপি দিয়েছে। কিন্তু এই মৃত্যুর পর ওরা নিরব। স্হানীয় জেএসএস সভাপতি (ভবদত্ত)কে ডেকে এনে লাশ দেখাই। উনি বেশ কয়েকবার লাশের এপাশ ওপাশ ঘুরে দেখে ভুরু কুঁচকে জবাব দেন, ‘নাহ! চিনতে পারছি না!’

উনি চিনতে না পারলেও জেএসএসের প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ তাদের পরবর্তী লক্ষ্য ঠিকই চিনে রাখে। তার প্রতিফলন দেখা দিলো দিন সাতেক পর। রাত সাড়ে দশটার দিকে মেসে ডিনার করছি, এমন সময় পানছড়ি বাজারের পশ্চিমে সূতাকর্ম পাড়ার দিকে কয়েকটি গুলির স্পষ্ট আওয়াজে আশংকা করি, আরেকটি উইকেট বোধহয় পড়লো।দ্রুত পেট্রোল টিমকে মেসের সামনে আসতে নির্দেশ দিয়ে বুট পরা শুরু করলাম।

ভাবছিলাম, কোন দিক দিয়ে অগ্রসর হবো। গুলিবর্ষণের ঘটনাটি আরেকটি কিলিং মিশনের অংশ হবে, তাতে কোনো সংশয় ছিলো না। যারা গুলি করেছে তারা আর স্পটে থাকবে না।
ভাবলাম, ওদের সম্ভাব্য এক্সিট রুটে গিয়ে একটা কন্ট্রাকটের (সংঘর্ষ) আশা করা যেতে পারে। তবে এসব কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীরা সেনাবাহিনীর সাথে একেবারে মুখোমুখি না হয়ে পড়লে গুলিবর্ষণ করে না। পালিয়ে যাওয়াটাই মূখ্য বিষয় হয় তাদের কাছে।

পানছড়ি বাজারে পৌঁছে পিছনে অনুসরণকারী পিক-আপের কমান্ডারকে ঘটনাস্থলের (মানিক্যা কারবারী পাড়ার) দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমি সোজা লতিবান ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাই। কিলিং টিমের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা মোটের উপর ১%। তবুও যদি ওরা বুঝতে পারে আমরা সঠিক ট্র্যাকে আছি তবে একটু হলেও মান্য করবে।

গাড়ির হেডলাইটের আলোতে দূরের কিছু দেখার চেষ্টা করলাম। পাড়ার কুকুরগুলোর ধারাবাহিক শ্লোগান শুনে মনে হলো কেউ হয়তো ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনা স্হলের দিকে যাওয়া শুরু করতেই আগে পৌঁছানো টহল দলের মেসেজ পেলাম: প্রাক্তন শান্তিবাহিনীর আত্মসমর্পণকারী সদস্য লে. কিরন বাবু নিহত হয়েছে। যা ভেবেছিলাম তাই, ইউপিডিএফ ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে গেল আজকের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে।

লে. কিরনের বাড়ির কাছে আসতেই দেখতে পেলাম, কয়েকজন পানি দিয়ে মাটিতে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে ফেলছে। শুনশান নিরবতা পাড়াটিতে। মৃতের স্বজন ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না। এখানেও নিহতের স্ত্রী বেশ সংযত, বিলাপ করছে না। এখানেও একই দৃশ্য শুধু কিরনের কিশোরী মেয়েটিই মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।

লে. কিরন রোজকার মতো বাড়ির উঠানে বসে সান্ধ্যকালীন দারু (মদ) পানে অলস সময় পার করছিলো। তখনই চেঙ্গী নদীর ঢালু পাড় বেয়ে উঠে আসে তিনজনের ঘাতক দল। কিরন বাবু দেখে দৌড়ে ভিতরে পালাতে চেষ্টা করে কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে গুলিতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর ঘাতক দল শুকনো চেঙ্গী নদীর উপর দিয়ে দৌড়ে লতিবান ব্রিজের নিচ দিয়ে পূর্ব দিকে চলে যায়। এসবই জানা যায় লে. কিরনের স্বজনদের কাছ থেকে।

পরদিন জেএসএস রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়। সেনাবাহিনী এবং সরকারের পিন্ডি চটকে অনেক গরম গরম কথাও বলেন তারা, ‘একটি স্বার্থান্বেষী মহল’ শান্তি চুক্তির বিরোধী, পাহাড়ে সামরিক উপস্থিতির যৌক্তিকতা দেখাতে এসব পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।যাহোক দিন দশেকের মধ্যে পানছড়ি কলেজ গেট সংলগ্ন এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে পরপর তিনটি হত্যাকাণ্ডের হেট্রিক প্রত্যক্ষ করি।

অতঃপর দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার জন্য পানছড়ির কলেজ গেট এলাকায় প্রত্যাগত শান্তিবাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য দুটো মোবাইল পেট্রোল নিয়োজিত করা হয়।
চলবে—
(০৩-০২-২০২২)

লেখকের আরো লেখা পড়ুন

পাহাড়ে লাভ জিহাদ এবং ধর্মান্তকরণের ফ্যাক্ট ও মিথের চিত্র

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন