ঋতু পরিবর্তণের প্রভাব ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি

cox-pic-1-copy

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ঋতু পরিবর্তনের প্রভাবে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলার ঘরে ঘরে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতালের বহি:র্বিভাগ ও চিকিৎসকদের চেম্বারে। শীতের শুরুতেই সব বয়সী মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ঠাণ্ডাজনিত সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া ও জ্বরে। তবে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এ রোগের প্রবণতা দেখা দেয় বেশি, আর ঝুঁকিও রয়েছে তাদের। কোনো কোনো শিশু আবার আক্রান্ত হচ্ছে ডায়রিয়ায়।

এদিকে মৌসুমি এসব রোগ শিশু আর বৃদ্ধদের বেশি হলেও এতে আক্রান্ত রোগী ও অভিভাবকদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কক্সবাজারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে পাহাড় কাটা, পরিবেশ দূষণ, রাস্তায় ধূলাবালিসহ বাতাসে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের কারণেই বেড়েছে শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রকোপ। তবে সামান্য চিকিৎসায় এসব রোগ সেরে যায় বলেই অযথা আতঙ্কিত না হওয়ার জন্যই বারংবার বলেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

ঋতু পরিবর্তনের কারণে ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগীদের কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ছাড়াও জেলা ও শহরের বেসরকারী ক্লিনিক গুলোতে ভর্তি করানো হচ্ছে। জেলার নিম্নবিত্ত পরিবারের রোগীরা বেশি টাকা খরচ করতে না পারায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।

রবিবার সরেজমিনে সদর হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ড ও ডায়রিয়া ওয়ার্ড ঘুরে এবং অভিভাবক ও চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা যায়, শনিবার শহরের বিভিন্ন বেসরকারী ক্লিনিকে ডাক্তার না থাকায় সদর হাসপাতালে ভিড় জমিয়েছিলেন। এতে শিশু ওয়ার্ডে ৪৮ জন শিশুই ছিল ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত। ডায়রিয়া রোগী ছিল ২০ জন। রোগীদের বেশিরভাগই ১ মাস থেকে ৮ বছরের শিশু। দিন দিন বেড়েই চলছে শিশু রোগীর সংখ্যা। তবে মধ্য বয়সী ও বৃদ্ধদের এ রোগের প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও তারা সাধারণভাবে চিকিৎসা করে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে ভর্তি চান না। নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের সচেতনতা ও সাধারণভাবে চিকিৎসা দিতে না পারার ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করায় বেশি।

চিকিৎসকরা বলছেন, এই রোগে মৃত্যুর হার কম থাকলেও অভিভাবক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

চিকিৎসা নিতে আসা টেকনাফের হ্নীলা এলাকার জয়নব বেগম জানান, তার সন্তানের বয়স ১১ মাস। গত ৩ দিন থেকে তার শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ডায়রিয়া ও ঠাণ্ডাজনিত রোগের কারনে। শুরুর দিকে তার খিঁচুনীসহ শারীরিক অবস্থা খারাপ হলেও এ খানে চিকিৎসা নেওয়ার পর থেকে এখন আমার সন্তান সুস্থ।

মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ার বাসিন্দা আবু হেনা জানান, তার ১৫ মাসের ভাগিনা সৌরভের শ্বাসকষ্ট থাকায় গত ২ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। এ বছর ঠাণ্ডা পড়ার সাথে সাথে তার ভাগিনার সমস্যা হয়। রবিবার সকালে হাসপাতাল থেকে একটু সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে বাসায় চলে গেলে আবার ডায়রিয়া শুরু হয়। পরক্ষনে বিকালে পুন:রায় সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।

অপরদিকে শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে ডায়রিয়া রোগিও ভর্তি হয়েছে চোখে পড়ার মত। শহরের লালদীঘিপাড়ের লেকমি সেলুনের স্বত্বাধিকারী আনিছ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শনিবার রাত থেকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে সীট সংকুলন না হওয়ায় হাসপাতালের বারান্দায় কোনরকম একটি ভাসমান সীটে তার চিকিৎসা চলছে।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আল-ফুয়াদের নিয়মিত চিকিৎসক ডা: নুরুল করিম খাঁন বলছেন, শীতের শুরুতে আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিশু ও নবজাতকরা ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। তবে শিশুদের বেলায় ৩টি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে, যদি কোনো শিশুর সর্দি-জ্বরের সঙ্গে কাশি, বুকে ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ হয় আর যদি শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তবে অবশ্যই ওই শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কারণ ঠাণ্ডাজ্বরের সঙ্গে বুকে ঘ্যাড় ঘ্যাড় ও শ্বাসকষ্ট হওয়াটা নিউমোনিয়ার লক্ষণ। ভাইরাল ইনফেকশন ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে নিউমোনিয়া হওয়ার প্রবণতা বেশি। কারণ শিশুদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড়দের তুলনায় কম।

তিনি আরও বলেন, কক্সবাজার জেলায় শিশুরা এখনও যেসব রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে নিউমোনিয়া। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে দেখা দিতে পারে নানা ধরনের চর্মরোগও। তবে এ সময় হাঁপানি রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ে। বাড়ছে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যাও।

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এন. আলম জানান, ঠাণ্ডার কারণে অ্যালার্জির প্রকোপ বাড়ে। শীতের কারণে বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস ও চামড়ার রোগও বেড়ে যায়। বিশেষ করে বাচ্চাদের মধ্যে ডায়রিয়া দেখা দেয়। ডায়রিয়া হয় রোটা ভাইরাসের কারণে। মায়ের দুধ শিশুর পুষ্টি বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে সর্দি-কাঁশি শিশুকে সহজে আক্রান্ত করতে পারে না এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সহজ হয়। তিনি আরও বলেন, শিশু যখন মায়ের বুকের দুধ পান করে, তখন শিশুকে পানি খাওয়ানোরও প্রয়োজন নেই। কারণ মায়ের দুধে ৮৯ শতাংশ পানি থাকে। আর ১১ শতাংশ থাকে সলিড খাবার। শিশুকে সময়মতো সব টিকা দিতে হবে। টিকা দেয়া হলে শ্বাসতন্ত্রের রোগ থেকে শিশুকে অনেকটাই নিরাপদ রাখা সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীরিক অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়। আর এ সময় দেখা দেয় ‘স্টেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া সেফাইলোকক্কাস নিউমোনিয়া শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ভাবে ধারণ করে। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। দুই তিন দিন পর তা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। বর্তমানে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আর এর কারণ হচ্ছে ঋতু পরিবর্তন। আরও জানা গেছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে এ সময় হাঁপানি রোগীদের কষ্ট অনেক বেড়ে যায়। তাদের ক্ষেত্রেও কমন কোল্ড দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে দেরি না করে রোগীকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা: রেজাউল করিম বলছেন, প্রতিবছরই ঋতু পরিবর্তনের সময় ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এই সময়ে দিনে অসহ্য গরম আর রাতের বিপরীতে ঠান্ডা। এই গরমের সময়ে শিশুদের অভিভাবকদের ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খেতে না দেওয়াটা অত্যান্ত উপকারী। আর আক্রান্ত রোগীদের খেয়াল রাখতে হবে যে স্বল্পমেয়াদি ও সহজ চিকিৎসায় এসব রোগ সেরে যায়। অযথা অ্যান্টিবায়োটিক না নেয়ারও পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। শীত শুরুর এ সময় নিজেকে সুরক্ষিত রাখার পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন