চন্দ্রপাহাড় ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প
আকাশের মেঘগুলো যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪০০ ফুট ওপরে পার্বত্য চট্টগ্রামের চন্দ্রপাহাড়। ওপরে বিস্তৃত নীল আকাশ। নিচে সবুজের গালিচা। সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং থেকে শুরু করে যেদিকে চোখ যায় দিগন্তরেখা পর্যন্ত শুধু ছোট-বড় পাহাড়।
গোধূলির আলো-আঁধারিতে সূর্যাস্তের লাল আভার সঙ্গে ভেসে উঠে সাগরের ঢেউ, নোঙর করা জাহাজের সারি। সূর্যোদয়ের সময় তাকালে চোখে পড়ে সাঙ্গু নদীর আঁকাবাঁকা স্বচ্ছ জলের ধারা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন এক অপার সৌন্দর্য অবগাহনের স্থান চন্দ্রপাহাড়; যাকে ঘিরে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প।
শুধু ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের হাতছানি দেয়। কোভিড-১৯ মহামারীর কালেও পাহাড়ে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। হালকা শীতের আমেজে আনন্দ উপভোগের ব্যাকুলতা থাকলেও পর্যটকদের জন্য হোটেলসহ আধুনিক পর্যটন সুবিধার অভাব প্রকট।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটলে পর্যটকদের কাছে এ অঞ্চলের মানুষ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও পোশাক বিক্রি, পর্যটনভিত্তিক ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, পর্যটকদের চলাচলে পরিবহনখাতে কর্মসংস্থানসহ নানাভাবে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হতে পারে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নতি হতে পারে।
তবে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, শিল্পের কারণে অঞ্চলটির পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আগুন দিয়ে গাছ পুড়িয়ে জুম চাষে সমস্যায় পড়তে পারেন। এ কারণে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা; বিশেষ করে হোটেল ও রিসোর্টে তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন শিল্পের বিকাশসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কোনো কোনো মহল বিরোধিতাও করছে। যারা আগে এ অঞ্চলে মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিরোধিতা করেছিলেন; এবার তারা পর্যটনের জন্য পাঁচ তারকা হোটেল নির্মানেও বিরোধিতা করছেন।
নিরাপত্তা বাহিনীগুলো মনে করে, পাহাড়ে উন্নয়ন হলে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে তারা নিজেরা এ কাজে বিরোধিতার পাশাপাশি মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। কোনো কোনো বিশিষ্ট ব্যাক্তি তাদের সঙ্গে সুর মেলালেও মাঠ পর্যায়ের বাস্তব চিত্রের ত্রের সঙ্গে পর্যটন বিরোধীদের তথ্যের মিল পাওয়া যায় না।
নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এও বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবছর ৪০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। অঞ্চলটির উন্নতি হলে এসব চাঁদাবাজির পথও রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। উন্নয়ন বিরোধিতার সঙ্গে এরও যোগসূত্র থাকতে পারে।
সরকার ২০১৫ সালে বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে চন্দ্রপাহাড়ে ২০ একর জায়গাজুড়ে বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণের অনুমতি দেয়।
২০১৬ সালের ১২ জুন আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সঙ্গে আরএনআর গ্রুপ পাঁচ তারকা ম্যারিয়ট হোটেল স্থাপনে চুক্তি করে। সম্প্রতি হোটেলটির নির্মাণ কাজ শুরু হলে পাহাড়ি গ্রুপগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে।
বিরোধিতাকারীদের দাবি, ম্রো সম্প্রদায়ের প্রায় ১০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে চন্দ্রপাহাড়ে গিয়ে জানা গেল, পাহাড়টি কিংবা তার আশেপাশে কোনো বসতি কখনও ছিল না। এটি শুধু একটি পাহাড়। জায়গাটি নীলাচল রিসোর্ট থেকে তিন কিলোমিটার দূরে।
চন্দ্রপাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে পাশ্ববর্তী কালেঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নং সদস্য অর্জুন ম্রো বলেন, এখানে কোনো বসতি ছিল না। পাহাড়টি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে একটি ম্রো পল্লী আছে। সেখানে ৩০টি পরিবার আছে। তাদের কোনো উচ্ছেদের প্রশ্নই আসে না।
অর্জুন মনে করেন, পাঁচ তারকা হোটেল হলে তাদের লাভ হবে। এখন এক মণ পেঁপে তারা ৫০০ টাকায় বিক্রি করেন। কিন্তু এ অঞ্চলে পর্যটকরা এলে প্রতিটি বড় আকারের পেঁপে তারা ১০০ থেকে ১৩০ টাকা বিক্রি করতে পারবেন। তবে তিনি আশঙ্কা করেন, দূরে বাস করলেও জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দিলে ধোঁয়া ও উত্তাপ আসতে পারে।
তিনি জানান, হেডম্যান ও কারবারীরা নিরীহ ম্রো সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে জুম চাষের জন্য পাহাড় ভাগ করে দেন। হোটেল থেকে দূরবর্তী কোনো পাহাড়ে আগুন জ্বালানোর সুযোগ দিলে ওই পরিবারগুলোর সুবিধা হবে।
ইউপি মেম্বার অর্জুন আরও বলেন, পাঁচতারা হোটেল ও রাস্তা হওয়ায় তারা খুশি। এতে তাদের এলাকার গরিব মানুষের উপকার হবে। তবে হোটেলটির জন্য ২০ একর জায়গা লিজ দেয়া হলেও ভবিষ্যতে যেন জায়গার পরিমাণ বাড়ানো না হয়।
তিনি জানান, ম্রো সম্প্রদায় খুবই গরিব। তিনি নিজেও দরিদ্র মানুষ। তাই সন্তানদের লেখাপড়া করানোর জন্য মিশনারিদের সাহায্য পেতে বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন অর্জুন।
ম্যারিয়ট হোটেল ও রিসোর্টের সাইট ম্যানেজার রাজু গত ১০ মাস ধরে স্থাপনা নির্মাণের জন্য স্থানটিকে প্রস্তুত করছেন। তিনি পশ্চিম দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, ওই দেখুন সাগর, সাগরে জাহাজ। দক্ষিণ পাশে লামা, থানচি ও আলীকদম। আলীকদমের পাহাড়গুলো দেখা যায়। পর্যটকরা মেঘ ছুঁয়ে দেখতে পারবেন। অনেক সময় আমাদের শরীরও মেঘের মধ্যে ঢাকা পড়ে। পূর্ব পাশে সাঙ্গু নদীর ভিউ আছে। তাজিংডং ও কেওক্রাডং পাহাড় দেখা যায়। পর্যটকরা কোথাও যেতে চাইলে কর্তৃপক্ষ তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করবে।
তিনি আরও জানান, পাঁচ তারকা এই হোটেলে স্টাফসহ ৩০০ থেকে ৪০০ পর্যটক থাকতে পারবেন। ২৫টি কটেজ হবে। প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট থাকবে। ৫টি বড় ভবন হবে। গেমিং জোন হবে। ক্লাব ঘর, ফুড কর্নার ও বিলিয়ার্ড থাকবে। বাচ্চাদের গেমিং সুবিধা থাকবে। পর্যটকদের জন্য হেলিকপ্টারসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
ম্যারিয়ট হোটেলের জন্য প্রায় ৮০০ একর জায়গা নেয়া হয়েছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন। তবে হোটেলের সার্ভেয়ার মো. বিল্লাল হোসেন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ২০ একর জায়গাজুড়ে হোটেল ও রিসোর্ট হবে।
সাইট ইঞ্জিনিয়ার শহীদুজ্জামান বলেন, নীলগিরি থেকে চন্দ্রপাহাড় পর্যন্ত ক্যাবলকার করতে অস্ট্রিয়া থেকে প্রকৌশলী আনা হবে।
চন্দ্রপাহাড় থেকে থানচির পথে ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পর লোকালয়ের দেখা পাওয়া গেল। সেখানে বলিবাজারে রাস্তার পাশে মুদি দোকানি পুচিং মারমার (৫১) সঙ্গে কথা হয়; যিনি শান্তিবাহিনীতে ছিলেন।
জানতে চাইলে পুচিং মারমা বলেন, হোটেল হলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে জুম চাষে ক্ষতি হবে। আমরা চাই- এলাকার শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা হোটেল ও রিসোর্টে যেন চাকরি পায়।
সূত্র: যুগান্তর