ফলোআপ: কেএনএফ-শান্তি কমিটি মুখোমুখি বৈঠক

নিরাপত্তা বাহিনীকে সহযোগিতা ও সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনা না করার অঙ্গীকার কেএনএফের

fec-image

শান্তি প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম চলমান থাকাকালে আর কোনো সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনা না করার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছে কেএনএফ। এ ছাড়াও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সহযোগিতারও অঙ্গীকার করেছে সংগঠনটি।

আজ ৫ নভেম্বর রবিবার বেলা ১১টায় রুমার মুনলাই পাড়ায় বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত শান্তি কমিটির সাথে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট(কেএনএফ) এর প্রথম মুখোমুখি বৈঠকের পর দুপক্ষের মধ্যে সাক্ষরিত সমঝোতা পত্রে এ অঙ্গীকার করেছে কেএনএফ নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়াও উদ্ভূত যে কোনো সমস্যা উভয়পক্ষ সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছে ওই সমঝোতাপত্রে।

বৈঠক শেষে শান্তি কমিটির মুখপাত্র কাঞ্চন জয় তঞ্চঙ্গা জানান, বৈঠকে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লার নেতৃত্বে ৮ সদস্য এবং কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের প্রধান উপদেষ্টা লাল এন লিয়ান বমের নেতৃত্বে ৫ সদস্য বৈঠকে অংশ নেয়। এছাড়াও প্রশাসনের তরফে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহ আলম ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, এর আগে কেএনএফের সাথে ভার্চুয়াল যেসব বৈঠক হয়েছে সেখানে প্রশাসনের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলো না।

এদিকে বৈঠককে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ওই এলাকায়। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

দু’পক্ষের মধ্যে এর আগে কয়েকবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও সামনাসামনি এটিই প্রথম বৈঠক। স্থান নির্ধারণ ও বেশকিছু বিষয় নিয়ে সামনাসামনি অনুষ্ঠিত এই বৈঠকটি এর আগে কয়েকবার পিছিয়েছে। বৈঠকে কেএনএফ’র পক্ষ থেকে পূর্বে উত্থাপিত ৬ দফা দাবিসমূহ শান্তি কমিটির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পৌঁছানোর পাশাপাশি বম সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার-সদায় ক্রয়ে বিধি নিষেধ তুলে নেওয়া, কেএনএফ সদস্যের নামে আটককৃত ৬১ জনের নিঃস্বার্থ মুক্তির দাবি জানিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ক্যা শৈ হ্লা জানান, কেএনএফের সাথে স্বশরীরে প্রথম বৈঠক খুবই আন্তরিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসে আরো একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠকের মাধ্যমে চলমান সমস্যা নিরসন হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

যে চার শর্তে কেএনএফের সাথে সমঝোতা হয়

১. উদ্ভূত যেকোনো সমস্যা সংলাপের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে উভয় পক্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শান্তি প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে কেএনএফ কোন প্রকার সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত হবে না এবং আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্ট অব্যাহত রাখবে। এই উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীলতা রক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখা হবে।

২. সকল কুকি সম্প্রদায়ভুক্তদের নিজ আবাসস্থলে ফেরত আসার ব্যাপারে অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য সরকার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৩. কেএনএফ’র পক্ষ থেকে কুকি সম্প্রদায়ের ভাগ্যোন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য সহায়তা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থান বিষয়ে প্রস্তাবনা প্রেরণ করবে যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনা করা হবে।

৪. শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরবর্তী সংলাপ আগামী ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখ অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকের তারিখ উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে। পরবর্তী সংলাপ পর্যন্ত কেএনএফ সকল প্রকার সশস্ত্র তৎপরতা থেকে বিরত থাকবে।

শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি এবং কেএনএফের মধ্যে সম্পাদিত উক্ত সমঝোতা স্মারকে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা এবং কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সিনিয়র উপদেষ্টা এবং টিম লিডার কেএনএফ রিপ্রেজেন্টেটিভ ফর পিস ডায়লগ এন্ডার লালএং লিয়ান স্বাক্ষর করেন।

বৈঠকে কেএনএফের তরফে শাস্তি কমিটির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নিকট ৬ দফা দাবীনামা পেশ করা হয়।

কেএনএফের ছয় দফা দাবী হলো

১. প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর বিলীয়মান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষাসহ শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সার্বিক উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে “কুকি-চিন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল” (সংক্ষেপে ‘কেটিসি’) নামে স্বায়ত্তশাসিত পরিষদ গঠন করা।

২. ভূমি ও পর্যটন বিষয়ক সংক্রান্ত সকল কর্মকাণ্ড সমূহের সর্বময় ক্ষমতা কেটিসি’র উপর সম্পূর্ণভাবে অর্পণ করা।

৩. উক্ত অঞ্চলে পুলিশ বাহিনীর নিয়োগ প্রদানসহ সকল ক্ষমতা কেটিসির উপর অর্পণ করা।

৪. কেএনএফ’র সশস্ত্র আন্দোলনকালীন কেএনএফ’র সশস্ত্র সদস্যসহ অন্যান্য নিরীহ ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, হুলিয়া জারি অথবা অনুপস্থিতিকালীন সময়ে বিচারে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, অস্ত্রসমর্পণ ও স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের পর শীঘ্রই সম্ভব তাদের বিরুদ্ধে সকল মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, হুলিয়া প্রত্যাহার করা এবং অনুপস্থিতকালীন সময়ে প্রদত্ত সাজা মওকুফ করা। কেএনএফ’র কোন সশস্ত্র সদস্য বা কেএনএফ-এর নামে নিরীহ ব্যক্তিরা জেলে আটক থাকলে তাদেরকেও বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করতে হবে।

৫. ৭১ সালের পর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে কুকি-চিন অঞ্চলে ব্যাপক সেনা অভিযানের ফলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহে তথা ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমারের পালেতুয়া এলাকায় পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় গ্রহণ করা কুকি-চিন শরণার্থীদেরকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে এনে পূণর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৬. কুকি-চিন আর্মড ব্যাটেলিয়ন (কেএবি) নামে সশস্ত্র পদাতিক ব্যাটালিয়ন গঠন করতে হবে ।

দেশের ভূখণ্ডের স্পর্শকাতর সীমান্ত অঞ্চলের নিরীহ জনগণ তথা পাহাড়ি-বাঙালির জানমাল রক্ষা, সন্ত্রাস দমনসহ নিরপেক্ষভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বার্থে এই অঞ্চলে বিশেষ প্রয়োজনে কুকি-চিন জনগোষ্ঠীদের নিয়ে পৃথকভাবে “কুকি-চিন আর্মড ব্যাটেলিয়ন” বা কেএবি গঠন করা। কেএবি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার (জিওসি)’র তত্ত্বাবধানে থাকবে।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্বত্যনিউজের একটি রিপোর্টের মাধ্যমে পাহাড়ে কেএনএফ এর অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পর থেকেই পাহাড়ে কেএনএফ তৎপরতা শুরু করে। এদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে এ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ৫ সদস্যসহ ২২ জন নিহত হয়। কেএনফের ১৭ সদস্যকে আটক করা হয়। এই সশস্ত্র সংগঠনটির সাথে নতুন গজিয়ে ওঠ জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিদ্দা‌ল শারক্বিয়ার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। জঙ্গিদের টাকার বিনিময়ে কেএনএফ প্রশিক্ষণ দিত বলেও অভিযোগ ছিল। কেএনএফ এর এই তৎপরতায় বান্দরবানে পর্যটন শিল্পের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বান্দরবানের কয়েকটি উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয় প্রশাসন থেকে। পাহাড়ে চলমান এই সংঘাত নিরসনে গঠিত বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত শান্তিপ্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে এই প্রথম কেএনএফ সরাসরি বৈঠকে বসেছে। শুরুতে এই বৈঠকে প্রশাসনের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকলেও এই প্রথম প্রশাসনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন