পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্প পুনঃস্থাপন কী পাহাড়ের সন্ত্রাস দমনের একমাত্র সমাধান?

fec-image

(পূর্ব  প্রকাশিতের পর)
বর্তমানে তারা খুব গভীর জঙ্গলে স্থায়ী ক্যাম্প করে সেনাবাহিনীর সাথে পূর্ন উদ্দ্যমে আরেকটা ‘১৯৭৫-১৯৯৭’স্টাইলে যুদ্ধে যেতে এখনই প্রস্তুত তা আমি মনে করি না। তাদের সংগ্রামের কৌশল বহুবিধ:

(১) আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যাপকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুটিকে আলোচনায় রাখা। যা তারা প্রতিবছর জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামের সম্মেলনে অংশ গ্রহনের মাধ্যমে করে থাকে।

(২) বিদেশে উপজাতি /পাহাড়ি বাংলাদেশী বংশদ্ভূত ছেলে মেয়েদের সংযুক্ত করে পাহাড়ের ইস্যুটিকে সব সময় সব মহলে সচল রাখা। এবং বিদেশি অর্থ সংগ্রহ করা।

(৩) বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাংস্কৃতিক কর্মী সাংবাদিকদের মধ্যে পাহাড়ি ইস্যূর প্রতি সহানুভূতিশীল ও সমর্থকে পরিনত করা। সকল ধরনের মিডিয়ায় পাহাড়ি ভয়েস কে প্রতিষ্ঠিত করা। উদাহরণ খাগড়াছড়ির কথিত ধর্ষণ কান্ডে মারমা মেয়েটি ধর্ষণ হয়নি এটা কোন পএিকাই উল্লেখ করেনি। প্রথম আলোর রিপোর্টটিতে একজন পাহাড়ি নারীর ছবিসহ পোড়া বসতবাটি দেখানো হয়েছে কোন বাঙালী ঘর দোকান এবং মসজিদ আক্রমণের উল্লেখ নেই।

৪) পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড এখন শহর ভিওিক, মূল সড়কের আশেপাশেই  তাদের অবস্থান।  যে কোন প্রয়োজনে হঠাৎ তারা একএিত হয় এবং কাজ করে দ্রুত মিলিয়ে যায়। তারা ফাইটিং ইন বিল্টআপ এরিয়ার মত রনকৌশলে কাজ করে। এটা অনেকটা আইরিশ ইনসারজেন্সীর মত।

৫) পাহাড়ি সংগঠন গুলো কোন নির্দিষ্ট স্হানে কনসেন্ট্রেটেড ( Concentrated)  থাকে না প্রতিপক্ষের আক্রমণের ভয়ে। বা  তথ্য সেনাবাহিনীর কাছে চলে যেতে পারে সে ভয়ে। এরা এখন আগের মত এরিয়া ডিস্ট্রিক্ট কোম্পানিতে বিভক্ত হয়ে কোন সীমানাজুড়ে থাকে না। এরা আগের চেয়ে এখন অনেক ফ্লুইড। এখানে ক্যাডার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে প্রয়োজনে একএিত হয়।

৬) তারা কাজ করে ঢাকা চট্টগ্রাম সহ বড় বড় শহরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাএাবাসে শহরের নির্দিষ্ট এলাকার পাহাড়ি মেসে বাসাবাড়িতে।  এরা এখন শাহবাগে টিএসসিতে চেরাগীপাহাড় মোড়ে সরব।

৭) এরা সাংবাদিকদের ৯৫% কে নিজেদের মুখপাত্র বানিয়ে ফেলেছে।  যে কোন টকশো তে এরা যে মতামত দেয় তাতে সন্তুলারমা বা প্রসীত খীসাকে আর কষ্ট করে কিছু বলতে হয় না। ‘দুই দিনের বৈরাগী ভাতকে বলে অন্ন’ এমন জ্ঞান নিয়ে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর কয়েকদিন ঘুরে এসে শান্তি বাহিনীর উপর এক বীর গাঁথা লিখেছেন গোলাম মর্তুজা। যার প্রতিটি কথায় শান্তি বাহিনীর উপর আবেগ উপড়ে পড়ে তিনি এখন বাংলাদেশের  প্রেসমিনিস্টার যুক্তরাষ্ট্রে। মেসবাহ কামাল তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ কে চাকমা মুখপাত্রে পরিনত করেছেন।

৮) বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের কর্মকর্তারা  পাহাড় সম্পর্কে খুবই কম জ্ঞান রাখেন। তারা বেশির ভাগের মনোভাব দেশের সার্বোভৌমত্বের আশংকাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। তারা থাকেন কিভাবে কলাগাছের ছাল দিয়ে শাড়ি বানিয়ে হাসিনাকে মুগ্ধ করা  যায় সেই তালে। তারা একান্ত আলাপের সময় সেনাবাহিনীর সমালোচক, সেনাবিদ্বেষী মন্তব্য করেন, নিজেদের সুপ্রিমেসী বজায় রাখতে নিরাপত্তা ইসূগুলো হালকা করে দেখেন।

৯) বাংলাদেশের তরুণ ছাএসংগঠনের মধ্যে পাহাড়ি ছাএসংগঠন গুলো প্রভাব বিস্তার করে আছে। সমতলের বাঙ্গালীর পাহাড় সম্পর্কে জানাশোনা সাজেক ভ্রমনের অভিজ্ঞতা  আর পাহাড়িদের বয়ান শুনে যা মনে স্হান পায় তাই। কচুক্ষেতের সেনাবাহিনী খারাপ তাই পাহাড়ের সেনাবাহিনীও খারাপ এমন সহজ সমীকরণে চলে তারা। জুলাই বিপ্লবের সার্বভৌমত্বের চেতনা পাহাড়ে সম্প্রসারিত হয়নি।পাহাড়িরা এখনো নির্যাতিত অবহেলিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এই ধারণা উওর বঙ্গের ‘বোদা’ উপজেলার বাঙালী ছাএের ধারণা। এসবের পিছনে পাহাড়ি সংগঠন গুলো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করেছে।

১০) পাহাড়ি সংগঠন গুলো রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল রাজকর্মচারী, আন্তর্জাতিক অংগনে যোগাযোগে পারদর্শী মুখপাএ দেশের অভ্যন্তরে সকল মিডিয়া হাউসে চাকমাশ্লোক বলা তোতাপাখি , বুদ্ধিজীবিদের লেখনীতে বাঙালী শিল্পীদের কণ্ঠে চাকমাপ্রীতি প্রতিষ্ঠায় সফল, সেখানে দূর্গম ছত্রা ছড়ার পরিত্যক্ত ক্যাম্পে পুনরায় সেনা বসিয়ে আপনি কি অর্জন করবেন?

ক্যাম্প  বাড়ানোর যৌক্তিকতা পর্যালোচনা

১। একটা ব্যাটালিয়নের অধীনে ৮ /১০ টি ক্যাম্প থাকে। আরো থাকে আনসার পুলিশ ও বিজিবির ক্যাম্প। এসব গুলো কাউন্টার ইনসারজেন্সী অপারেশনে সেনাবাহিনীর অপারেশনাল কমান্ড মেনে চলে। বিজিবি’র সিআইও ক্যাম্প না হলে তাদের বিওপি গুলো বিওপি’র বিধির অধীনে নির্ধারিত টাস্ক পালন করে। তারা ডীপ লেভেল কোন কাউন্টার ইনসারজেন্সী অপারেশন করে না। তারা সীমানা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত।

২) একটা সেনা ক্যাম্পে জনা এিশ সৈনিক থাকে। তার ক্যাম্পের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার কাজেই তার ১৮ জন সৈনিক লাগে:

৪টি সেন্ট্রী পোস্টে ৩ জন করে ১২ জন। দুইজন গার্ড কমান্ডার, একজন কুক, দুই জন সিগনাল অপারেটর, একজন ক্যাম্প কমান্ডার

৩) ১২ জন(৩০-১৮) সৈনিকের একটি টহল দল যা ‘সি টাইপ’ পেট্রোল নামে পরিচিত তার  অপারেশনাল রেডিয়াস এবং টাইম ডিরেশন যথাক্রমে ৩ কিলোমিটার ও ১০ ঘন্টা। সকালে বের হলে সন্ধ্যায় ফেরত আসে। এরা স্বল্প মাএার একটা ডমিনেশন পেট্রোল টীম। রাতের বেলায় খুব কম ক্ষেত্রেই এতো ছোট কোন দলকে কোন আভিযানিক মিশন দেওয়া হয়।

৪) নূন্যতম ১৫/২০ জনের নীচে ( যা বি টাইপ পেট্রোল) কোন পেট্রোল দলকে অফিসার লিডারশীপ ছাড়া বাইরে পাঠানো হয় না। এক্ষেত্রে আমরা তরুণ লেফটেন্যান্ট/ ক্যাপ্টেনের পরিবর্তে জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার ব্যবহার করি। কোন এনসিও’র হাতে কখনও কোন বি টাইপ পেট্রোল দেওয়া হয় না।

৫) একটা পদাতিক ব্যাটালিয়নে ৬৫০/৭০০ সৈনিক থাকে। তার এক তৃতীয়াংশ থাকে বাৎসরিক ছুটিতে। বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষন, ইউনিটের বাহিরে নিয়োগ, কেপিআই পাহারা দেওয়া, গেমস এন্ড স্পোর্টসে অংশগ্রহণে থাকা অসুস্থতা জনিত কারনে অসামর্থ্যতা, পারিবারিক প্রয়োজনে ছুটি এসব বাদ দিলে একটা ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের কাছে ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য ৩০০’শ সৈনিকের বেশি থাকে না।

এখন এই ৩শ’ সৈনিককে ১০ টি ক্যাম্পে ভাগ করলে ৩০ জনের বেশি থাকে না। আর কোন বড়সড় অপারেশনে সমস্ত ইউনিট থেকে ১৫০ থেকে ১৮০ জনের বেশি ‘বেয়নেট স্ট্রেংথ’ বা কার্যকরী সৈনিক পাওয়া যায় না। এতো গেল সৈন্য সংখ্যার দিকটি।  লজিস্টিক দিক বিবেচনা করলে সেনাবাহিনীর নৌপথে অপারেশন করতে ট্রলার ভাড়া করতে হয়, রসদ বয়ে নেওয়ার জন্য পোর্টার বা কুলি লাগে। সব মিলিয়ে কোন বড় সড় অপারেশন দীর্ঘ সময় ধরে চালানোর ক্ষেএে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়েনি। আমাদের যথেষ্ট এটাকিং হেলিকপ্টার নেই।  কোন অপারেশনে গেলে এয়ার সাপোর্ট থাকে না, হেলিকপ্টার দিয়ে অপারেশনে আহতদের দ্রুত মেডিক্যাল সাপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

এখন অপারেশন কে সাইবার যুদ্ধ মোকাবিলা করার জন্য তৈরি করতে হবে। সন্ত্রাসী সংগঠন গুলোর শত শত ওয়েব সাইট রয়েছে।  তারা সেনাবাহিনী কোন অপারেশন শুরু করার সাথে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। সিএমএইচে আহত সৈনিকের ছবি সহ নিহত আহতদের সংখ্যা দিয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য ‘ সংবাদ সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। অপারেশন শেষ হওয়ার আগেই ঢাকায় রিপোর্টার্স ইউনিটে বসে ‘সেনা নির্যাতনের ‘ প্রতিবাদ করে।

সোজা কথা মিডিয়া ব্যাটেলে সেনা কর্তৃপক্ষ অনেক স্লো। সেনাবাহিনীর পক্ষে অন্য কেউ প্রক্সি দিবে এমন প্ল্যাটফর্ম নেই।

তা হলে কি করনীয়?
পার্বত্য চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নতি হয়েছে। আমাদের নৌ আকাশ ও স্হলপথে আরো দ্রুত চলাচলের জন্য আর্মাড কার, আর্মাড বোট, আর্মাড হেলিকপ্টার বাড়াতে হবে।

ছোট ছোট ক্যাম্প করে সৈন্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ ( পিসমিল এমপ্লয়মেন্ট)  না করে খুব দ্রুত কনসেনট্রেশান অফ ফোর্স করতে পারলে অপারেশনের সাফল্য বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করি:

২০০৫ সালে শেষ অক্টোবরের জেএসএস এর একজন সশস্ত্র ক্যাডারকে তার বাড়ি থেকে তুলে আনি। আমি দীর্ঘদিন তক্কে তক্কে ছিলাম তার গতিবিধি নিয়ে। তাকে পেয়ে আমি ১০০% নিশ্চিত সে আমাকে তার সশস্ত্র দলের গোপন আস্তানায় নিয়ে যেতে পারবে। যাদের পাহাড়ে আভিযানিক  অভিজ্ঞতা আছে তারা বুঝবেন ক্যাম্পের লোকেশন জানে এমন গাইড ছাড়া রাতের বেলায় গহীন জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের আড়ালে কোন আস্তানায় পৌঁছানো অসম্ভব।

আমার ক্যাম্পে তখন রেইডে নেওয়ার মত সৈনিক মাএ ১৭/১৮ জন। ব্রিগেড কমান্ডার অনুমতি দিলেন না। এতো অল্প সৈনিক নিয়ে ওদের আস্তানার ১০/১২ জনের সাথে লড়তে যাওয়া সুইসাইডাল। কারন নীচ থেকে উপরে উঠতে গেলে ওরা লাইন ধরে আমাদের ফেলে দিবে।

ব্রিগেড কমান্ডারের অনুমোদন ও পর্যাপ্ত সৈনিক যোগাড়যন্ত্র করতে করতে  ৪৮ ঘণ্টা

পার হয়ে শত্রুর সাথে কন্টাক্ট পসিবিলিটি প্রায় শূন্যে নেমে আসে। তারপরও শত্রুকে একটা মেসেজ দিতে (যে সেনাবাহিনী খবর পেলে তোমার পিছনে ধাওয়া করবেই)  অপারেশন লন্চ করি এবং ব্যর্থ হই।

আমাদের সেনাবাহিনী যে সব যানবাহন ব্যবহার করে তা সফট স্ক্রীন ভেহিকাল তার আর্মড প্রটেকশন নেই।  আমাদের আর্মড প্রটেক্টর এপিসি থাকলে হঠাৎ পাহাড়ের চূড়া থেকে গাড়ি লক্ষ্য করে ছোঁড়া গুলিতে সেনাবাহিনীর প্রানহানি হতো না।

চলবে…

লেখক : পার্বত্য গবেষক ও সামরিক বিশ্লেষক

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য, প্রবন্ধ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন