পার্বত্য এলাকায় প্রকল্পের নামে শত শত টন খাদ্যশস্য লুটপাট

 
ফজলুর রহমান রাজন:
রাঙামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের নামে পার্বত্য এলাকায় শত শত খাদ্যশস্য দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
 
বিভিন্ন সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হলেও বরাদ্দের বিপরীতে কাকে কত টন দেয়া হবে মন্ত্রণালয় থেকে একটা আন অফিসিয়ালি তালিকাও দেয়া হয়।
 
১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন পার্বত্য জেলার আর্থ-সামাজিক ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নসহ দারিদ্র্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে প্রতিবছর বর্ষা ও শুস্ক মৌসুমে হাজার হাজার টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়।
 
পার্বত্য শান্তিচুক্তি-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং জেলা প্রশাসনের কাছে এসব খাদ্যশস্য সরকার বরাদ্দ দেয়। তার আগেও সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া হতো প্রচুর খাদ্যশস্য।
 
বর্তমানে বরাদ্দপ্রাপ্ত খাদ্যশস্য দ্বারা এলাকার অবকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ এবং জেলা প্রশাসন উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবিশেষে প্রকল্প চেয়ারম্যানদের অনুকূলে ছাড়পত্র প্রদান করে।
 
গত বিএনপি এবং আ্ওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়ার সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা এমপি সুপারিশ করতেন কিন্তু কাকে কত টন দিবেন তার কোনো তালিকা দেয়া হতো না।
 
বর্তমান প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর কাকে কত টন দিবে তার একটা তালিকা মন্ত্রণালয় থেকে সংযুক্ত করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙামাটিতে প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দের চিঠি পর্যন্ত কর্তাব্যক্তিরা সরিয়ে ফেলেন ভাগবাটোয়ারার পর ফাইলে আবার বরাদ্দের চিঠি আসে।
 
চলতি অর্থবছরে পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে চার দফায় পার্বত্য জেলা পরিষদে গম এবং চাল মিলিয়ে ছয় হাজার টন এবং পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদে দুবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
 
বরাদ্দে অল্প কিছু দলীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোকে দিলেও বরাদ্দের সিংহভাগই সংশ্লিষ্ট এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ভাগবাটোয়ারা করেছেন বলে সাধারণ নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন।
 
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর রাঙামাটি সফরকালে নেতাকর্মীরা নিজেরাই চাঁদা তুলে জনসমাবেশ সফল করতে পোস্টার, ব্যানার ও লোকসমাগম করলেও পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে রাঙামাটি জেলা পরিষদে এপ্রিলে দেয়া ১৪০০ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দের সবটাই প্রধানমন্ত্রী সফরের খরচ দেখিয়ে ভাগ করে নেন সংশ্লিষ্টরা।
 
বিষয়টি নিয়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ব্যস্ততার অজুহাতে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সর্বশেষ জুন মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভায় ২০০ টন, উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১০০ টন, জুরাছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১০০ টন, বিলাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১০০ টন, কাপ্তাই উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১০০ টন, কাউখালী উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১০০ টন, রাজস্থলী উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১০০ টন করে উন্নয়নের নামে নির্বাচনী বরাদ্দ দিয়েছে।
 
বাঘাইছড়ি পৌরসভার ২০০ টন বরাদ্দ মেয়রের নামে দেয়ার কথা থাকলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্যানেল মেয়র এবং আ্ওয়ামী লীগ নেতা আবদুস শুক্কর ওরফে মিয়ার নামে। অভিযোগ উঠেছে, ওই নেতা ডিও ব্যবসায়ী হওয়ায় নিজের ইচ্ছামতো বরাদ্দ ভাগবাটোয়ারা করেন এবং যাদের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন তাদের কাছ থেকে অল্প মূমুল্যে ডিও কিনে নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
 
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্যানেল মেয়র আবদুস শুক্কর জানান, মন্ত্রী তার নামে খাদ্যশস্য বরাদ্দ দিয়েছেন। বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য ঠিকমতো প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আরো ৫০০ টন দিবেন, সামনে নির্বাচন তাই।
 
যেসব প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেগুলোর কোনো কাজ হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন কাজ হবে। কিন্তু জুন মাস তো চলে গেছে এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।
 
তিনি আরো বলেন, “আমি ডিও বেচাকেনা করেনি তাই কাউকে কম দাম দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না।”
 
বাঘাইছড়ি পৌরসভার মেয়র ও পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি আলমগীর হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি শুনেছি পৌরসভার প্যানেল মেয়রের নামে পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে ২০০ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ওখান থেকে আমার প্রকল্পের বিপরীতে অন্যান্য কমিশনারের মতো ১২ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মেয়রকে ডিঙিয়ে এসব বরাদ্দের বিপরীতে প্রকল্পগুলো আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না আমি সন্দিহান।”
 
অপরদিকে পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিমন্ত্রীর আন অফিসিয়ালি তালিকার প্রতিবাদ জানিয়েছে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগ। সম্প্রতি বান্দরবানে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবাদ জানানো হয়।
 
জেলা সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান প্রতিবেদককে জানান, প্রতিমন্ত্রী তিন পার্বত্য জেলায় আধিপত্যে বিস্তারকে করতে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি তালিকা করে বরাদ্দ পাঠান যা বিধি ও নিয়মবহির্ভূত। 
 
পার্বত্য জেলাগুলোয় ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর, টিআর, কাবিখা, গুচ্ছগ্রাম, ভারত প্রত্যাগত, জেএসএস সদস্যদের রেশন ইত্যাদি খাতের খাদ্যশস্যের বরাদ্দ খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং পুনর্বাসন অধিদফতর থেকে সরাসরি জেলা প্রশাসনকে দেয়া হয়।
 
অপরপক্ষে বিশেষ প্রকল্পের খাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়া হয়।
সৌজন্যে নতুন বার্তা ডট কম।
Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন