পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও অবদান

মাহের ইসলাম

পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বিচার করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ‌‌’বাঙালি হইয়া যা’ বক্তব্যকে রীতিমত অনুঘটক হিসেবে বিবেচনা করেন – এমন লোকের সংখ্যা মোটেও কম নয়, বিশেষত উপজাতিদের মতে । পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর পরবর্তী সময়কাল, এমনকি বর্তমানে চলমান সহিংস এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পিছনে দায় খুঁজতে গিয়েও অনেকেই উপরোক্ত বক্তব্যকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিতবোধ করেন না, যার মধ্যে মূল জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত এবং জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গও রয়েছেন। । এতসব বিবেচনায় ইবরাহিম (২০১৮) যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “বঙ্গবন্ধু তাঁর কথাতে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন এবং পার্বত্য জনগোষ্ঠী কী বুঝেছিলেন সেটি ইতিহাসের অন্যতম একটি বিতর্কিত উল্লেখযোগ্য বিষয়।” (ইবরাহিম, ২০১৮, পৃ-২৫৫)।

ঘটনার দুই যুগের বেশী সময় পার হয়ে যাওয়ার পরে, এই বিতর্ক অবসানে গ্রহনযোগ্য সমাধান পাওয়া যতটা দুষ্কর, ‘বঙ্গবন্ধু কী বুঝাতে চেয়েছিলেন’ আর ‘পার্বত্য জনগোষ্ঠী কী বুঝেছিলেন’ – সেটা নির্ণয় করা অতটা দুষ্কর নয়। বরং নিঃসন্দেহে দাবী করা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে জ্ঞান রাখেন এমন কিছু শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির প্রকাশিত মতামতের সুত্রেই এই বিতর্কের উপসংহার টানা সম্ভব।  তবে উপসংহার টানার পূর্বশর্ত হিসেবে বঙ্গবন্ধুর এহেন উচ্চারণের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।


এ বিষয়ে আরো পড়ুন


বঙ্গবন্ধু মোট তিনবার পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তন্মধ্যে তাঁর প্রথম ভ্রমণই সর্বাধিক আলোচিত।  অবাক হওয়ার ব্যাপার হল এই যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও এমন ব্যক্তি আছেন, যারা পরের দুই ভ্রমণের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নয়। প্রথমবার এসেছিলেন ১৯৭৩ সালে এবং এর পরে ১৯৭৫ সালে দুই বার রাঙামাটি এসেছিলেন।

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের আলোকে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৭৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবার পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক শেখ মুজিবের কথা শুনতে পাহাড়ের অগনিত মানুষ সেদিন ভীড় জমিয়েছিল রাঙামাটি স্টেডিয়ামে। সেই ভাষণের পুরো বিষয়বস্তু সম্পর্কে তেমন তথ্য না পাওয়া গেলেও, দু’টো বিষয়ের উপর যে তিনি আলোকপাত করেছিলেন, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায় একাধিক নির্ভরযোগ্য সুত্রের মাধ্যমে। একটি ছিল ত্রিদিব রায় সংক্রান্ত আর অপরটি ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একটা খণ্ড চিত্র পাওয়া যায় প্রদীপ্ত খীসা (১৯৯৬)  রচিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা’ বইয়ে।  জাতীয়তাবাদের সঙ্কট ও জুম্ম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ১৯৭৩ সালের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অবতারণা করেন।  ত্রিদিব রায়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি উল্লেখ করেছেন,

“তিনি (বঙ্গবন্ধু) চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালনের অভিযোগ আনেন।  মহান নেতার এই উক্তিতে তাঁর পাশে উপবিষ্টা রাজমাতা বিনীতা রায়ের দু’চোখ সজল হয়ে উঠে।  যারা ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন, তারা মহান নেতার সেদিনকার উক্তি এবং সেই করুণ দৃশ্য সহজে ভুলতে পারেন নি।” (খীসা, ১৯৯৬, পৃ-৪৮)।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উপরে আলোকপাত করতে গিয়ে শরদিন্দু শেখর চাকমা (২০১১) রচিত ‘বঙ্গবন্ধু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ বইয়ে, ত্রিদিব রায়ের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর এহেন অভিযোগের কারণ তুলে ধরে জানিয়েছেন,

“ঐ ভাষণে তিনি রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেন।  উল্লেখ্য, পাকিস্তান হতে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু রাজা ত্রিদিব রায়কে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য তার মা বিনীতা রায়কে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন। তখন ত্রিদিব রায় জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে নিউইয়র্কে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায় দেশে ফেরত আসেন নি। তিনি এখনও পাকিস্তানে আছেন। আরো উল্লেখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় রাজা ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে পাকিস্তানিদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং যুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য শ্রীলঙ্কা, বার্মা (বর্তমান মায়ানমার), থাইল্যান্ড ইত্যাদি বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশগুলো সফর করতে গেছিলেন। এসব কারণে বঙ্গবন্ধু ত্রিদিব রায়-এর উপর খুবই নাখোশ হয়েছিলেন ” (চাকমা, ২০১১, পৃ-৯)।

সঙ্গত কারণেই উল্লেখ্য যে, ত্রিদিব রায়ের প্রসঙ্গে নয় বরং  বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩ সালের ভাষণ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রেক্ষাপটে সর্বাধিক আলোচিত/সমালোচিত হয়েছে ‘ বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ প্রসঙ্গের অবতারণায়।  বস্তুত বঙ্গবন্ধুর ঐ ভাষণের সবচেয়ে আলোচিত অংশ ছিল, উপজাতিদেরকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার আহবান সংক্রান্ত। এক জনাকীর্ণ জনসভায়, ‘আবেগ আপ্লুতভাবে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে’ তিনি বলেছিলেন,

“আমরা এখন সবাই বাঙালী। এখানে কোন উপজাতি নেই। আমি আজ থেকে আপনাদেরকে উপজাতি থেকে জাতিতে প্রমোশন দিলাম” (চাকমা, ১৯৯১, পৃ-৫২)।

ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির কয়েক মাস পরে ১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই হতে ২১ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ কিস্তিতে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত ‘জাতীয় সংহতির প্রেক্ষিতেঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপ’ শিরোনামের এক বিশ্লেষণধর্মী লেখায় ডাঃ হারুন-অর-রশিদ বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি তৎকালীন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মূলত  স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি উপজাতীয়দের আনুগত্য প্রকাশের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন।  তাঁর মতে,

“বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বাঙালী হয়ে দেশের সমগ্র জনগণের সঙ্গে বসবাসের বহুল আলচিত পরামর্শদানের ঘটনা থেকে ভিন্ন অবস্থায় নতুন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সূচনা বলে অনেকে মনে করলেও প্রকৃত অবস্থা ছিল ভিন্নতর।

এ কথা সত্যি যে, বঙ্গবন্ধু সরকার প্রবর্তিত ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৬নং অনুচ্ছেদে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী নামে পরিচিত হইবেন’ – এ কথা বলা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবান ছিল সংবিধানের উক্ত অনুচ্ছেদের বলিষ্ঠ উচ্চারণ এবং জাতীয় সংহতির প্রতি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধকরণের প্রয়াস।

একথা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না যে, বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের চুড়ান্ত পরিণতিতে ’৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে।  এ যুদ্ধে রাজা ত্রিদিবরায়সহ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানীদের পক্ষ সমর্থন করে।  স্বাধীনতা – পরবর্তী পার্বত্য বিদ্রোহের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ অপর একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্নসমর্পণ সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য এবং হানাদার বাহিনী কর্তৃক বেসামরিক লোকজন নিয়ে সৃষ্ট ওদের সহযোগী সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর সদস্য পাহাড়িদের একটি অংশের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করে নতুন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে থাকে।  তাদের এ তৎপরতা দমন করতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসের শেষ পর্যন্ত সময় লাগে।

এমনি এক অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর পাহাড়ি জনগণকে ‘বাঙালী হয়ে’ বসবাসের পরামর্শ ছিল বস্তুত তাদের প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নেয়ার তাগিদ এবং নতুন রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের (জাতিসত্ত্বার নয়) পরিচয়বাহী।  জাতির জনক হিসেবে তা ছিল সময়োপযোগী ও যথার্থ। ” (হারুন-অর-রশিদ, ১৯৯৮)।

সুনীতি বিকাশ চাকমা রচিত, ‘উপজাতীয় নেতৃত্বঃ সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিকথা’, শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত আহবানের ভিন্ন আঙ্গিকের এক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাঁর মতে,
“শেখ মুজিব বুঝাতে চেয়েছিলেন, ‘উপ’ শব্দটি বরাবরই খাটো বা নিম্ন শ্রেণীভুক্ত করার জন্যই ব্যবহৃত হয়।  যেমন উপ-সচিব, উপমন্ত্রী, উপ-প্রধান, উপ-রাষ্ট্রপতি যথাক্রমে সচিব, মন্ত্রী, প্রধান এবং রাষ্ট্রপতির চেয়ে নিম্ন পদবীর।  সুতরাং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে উপজাতিরা কি বাঙালী জাতি থেকে নিম্ন শ্রেণীর? তাই তিনি সেদিন বুঝাতে চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে কোন জাতিভেদ থাকবে না।  একজন সাধারণ বাঙালী সংবিধানের আওতায় যে সুযোগ, সুবিধা, গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করবে তেমনি পার্বত্যাঞ্চলে যে কোন পাহাড়ীও একই সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকার থাকবে। সুতরাং কোনক্রমেই শেখ মুজিব উপজাতীয়দের মুসলমান বানাতে চাননি। বরং তাদের সমান অধিকার দেওয়ারই অঙ্গীকার করেছিলেন”।

বঙ্গবন্ধু কী মনে করে পাহাড়িদেরকে বাঙালী হওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন তার একটা পরিস্কার ধারণা উঠে এসেছে সুবীর ভৌমিক (১৯৯৬) এর ‘Insurgent Crossfire: North-East India’ বইয়ে।  উপেন্দ্রলাল চাকমা’র সাথে সাক্ষাৎকারের সুত্রোল্লেখ করে সুবীর ভৌমিক সামনে এনেছেন,

“ব্রিটিশরা আপনাদেরকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রেখেছিল। পাকিস্তানিরাও একই কাজ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন জাতি এবং আপনারাও মুক্ত মানুষ।  সুতরাং পৃথক পরিচয়ের ব্যাপারে কুচক্রীরা আপনাদের কী বলেছে – তা ভুলে যান এবং এই স্বাধীন জাতির অন্য সকলের মত একই অধিকার উপভোগ করার জন্যে  বাঙালী হয়ে উঠুন।” (The British kept you as second- and third-class citizens, the Pakistanis did the same, but now Bangladesh is a free nation and you are free people. So, forget what mischief-makers tell you about your separate identity and become Bengalis to avail yourselves of the same rights others will have in this free nation.)  (Bhaumik, 1996, p. 260)।

উপজাতিদের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুতির কথা উঠে এসেছে শরদিন্দু শেখর চাকমা’র কণ্ঠেও।  তিনি তার পূর্বোক্ত বইয়ে তিনি জানিয়েছেন,

“উল্লেখিত জনসভায় (১৯৭৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি) বঙ্গবন্ধু আরো ঘোষণা করেন যে, জাতি উপজাতি নির্বিশেষে আমরা সবাই বাঙালী। তবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং সামাজিক জীবনে কেহ হস্তক্ষেপ করবে না বলে উপজাতিদের আশ্বস্ত করেন।এবং বাঙালীদের উপজাতি জনগণের জায়গা জমি জোর করে দখল করার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি করে দেন। এরপর সরকার ভুমি অধিকার বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করে।” (চাকমা, ২০১১, পৃ-৯-১০)।

বঙ্গবন্ধুর মনে ঠিক কী ছিল কিংবা তিনি কী বুঝাতে চেয়েছিলেন সেটা নিয়ে মতভিন্নতা থাকলেও এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে,  তাঁর এই কথাকে পাহাড়ের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ নিজেদের মত অপব্যাখ্যা দিয়ে ব্যবহার করেছিলেন নিজেদের স্বার্থোদ্ধারে। পাহাড়ের কিছু কুচক্রী কর্তৃক এহেন জঘন্য মানসিকতার বলি হয়েছিল পাহাড়ের সহজ-সরল, নিরীহ আপামর জনসাধারণ।

জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা তার ‘ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ’ পুস্তকে বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত উক্তির অপব্যাখ্যার এক সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেছেন।  তিনি বলেছেন,

“উপজাতীয়রা বাঙালী বলতে বাঙালী মুসলমানদের বুঝে। জনসংহতি সমিতি শেখ মুজিবের উপরোক্ত বক্তব্যকে অপব্যাখ্যা করে বলেছে যে, তিনি উপজাতীয় জনগনকে বাঙালী আখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ ভবিষ্যতে উপজাতীয়দের সবাই বাঙালী বা মুসলমান হতে হবে। তাই মুসলমান তথা বাঙালী হওয়া থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ তাদের মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য উপজাতীয় জনগণের প্রতি আহবান জানান। সহজ-সরল উপজাতীয় জনগণ তাদের কথায় বিশ্বাস করে জনসংহতি সমিতির প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে।”(চাকমা, ১৯৯১,পৃ-৫২)।

অথচ এই ঘটনার এক বছর আগেই ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের এক প্রতিনিধিদলকে বঙ্গবন্ধু আশ্বস্ত করেছিলেন যে, “উপজাতীয়দের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি পুরাপুরিভাবে সংরক্ষণ করা হবে।” (পূর্বোক্ত, পৃ-৫১)।

৭ জুন ১৯৭৩ সালের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ হতে জানা যায় যে,  সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর চেম্বারে সাক্ষাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদ সদস্যা সুদিপ্তা দেওয়ান বঙ্গবন্ধুকে তার নির্বাচনী এলাকা এবং উপজাতীয় জনসাধারণের সমস্যা সম্পর্কে  অবহিত করেছিলেন। যার প্রেক্ষিতে, প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, “উপজাতীয় এলাকার জনগণের জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করা হবে।”  আরো জানা যায় যে,

 “প্রধানমন্ত্রী দুঃখের সঙ্গে বলেন যে, অতীতের ঔপনিবেশিক সরকারের শোষণ ও অবহেলার ফলেই উপজাতীয় এলাকায় কোনরূপ উন্নয়ন হয়নি। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, উপজাতীয় এলাকার জনগণের দুঃখের দিনের অবসান হয়েছে। উপজাতীয় জনগণও স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক এবং অন্যান্য নাগরিকদের মতই সমান সুযোগ ও সুবিধা ভোগ করবে। ” (Tripura, 2017, p. 8)।

এই সাক্ষাৎকালেই সুদিপ্তা দেওয়ান মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে উপজাতিদের জন্যে পাঁচটি করে কোটা দাবী করেছিলেন- যা বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়ই নিশ্চিত করা হয়েছিল।

স্মরণযোগ্য যে, ১৯৭৩ সালের ১১ ডিসেম্বর চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে এক উপজাতীয় প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে, “পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য এই জেলার বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা প্রদানের দাবী জানান।” এই প্রতিনিধি দলে সংসদ সদস্যা মিসেস সুদীপ্তা দেওয়ানও ছিলেন।  এই দাবীর প্রেক্ষিতে, “প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিধিদলকে আশ্বাস দেন যে, নির্বাহী আদেশ বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ করা হবে এবং বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে।”  (চাকমা, ১৯৯১, পৃ-৫২-৫৩)।

১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু ২য় বার রাঙামাটি গিয়েছিলেন। সেখানে স্থানীয় এমপি, সার্কেল চীফ, হেডম্যান, কারবারী, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং অগনিত জনসাধারণের সামনে ঘোষণা করেছিলেন, “জাতীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার অবশ্যই রক্ষা করা হবে।” তিনি আরো বলেছিলেন যে, “অনগ্রসর সম্প্রদায় এবং এলাকার উন্নয়নের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ” (Tripura, 2017, p. 5)।

বক্তব্যে তিনি আরো জানিয়েছিলেন,

“পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তিনি একটি সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, সেজন্য তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ৩ (তিন) জেলায় ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি পুলিশ বাহিনীতে ৩ শত এবং রক্ষী বাহিনীতে ২শত জন উপজাতিকে নিয়োগ দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। এখন হতে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও অধিকতর সুবিধা দানের সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। (চাকমা, ২০১১, পৃ-১২)।

বিষ্মিত হতে হয় এই ভেবে যে, বঙ্গবন্ধু উপজাতিদের অধিকার  ও স্বার্থ রক্ষা এবং উন্নয়নের জন্যে বাংলাদেশে ফেরার পর হতেই একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।  কোন এক অজ্ঞাত কারণে, তার ছিটেফোঁটাও উল্লেখ করা হতে বিরত থাকলেও বঙ্গবন্ধুর একটা কথার প্রায় খণ্ডিতাংশকে যুগের পর যুগ ধরে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।  এই অপপ্রচার এবং তার কথার অপব্যাখ্যার মূল উৎস খুঁজতে গেলে সামনে চলে আসে কিছু অদূরদর্শী এবং স্বার্থান্বেষী চাকমা নেতার নাম। যাদের সাথে পরবর্তীতে যোগ দিয়েছে বাঙালী সমাজের কিছু বিজ্ঞজন।

আবেগতাড়িত ভ্রান্তি (Emotional Mistake) অথবা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা (Political Wisdom) – যাই বলা হোক না কেন, বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় পাহাড়ের মানুষদের পরিচয় মুছে ফেলা কিংবা ধর্মান্তরিত করা, এমনকি জোর জবরদস্তি করে হলেও তাদেরকে ‘বাঙালী’  বানানোর ছিটেফোঁটা উদ্যোগও কখনো গ্রহণ করা হয়নি।

বরং বাস্তবে ঘটেছিল – এর উল্টোটা। পাহাড়ের অনগ্রসর এবং পিছিয়ে পরা মানুষদের স্বার্থ রক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্যে একাধিক বাস্তবমুখী পদক্ষপে গ্রহণ করা হয়েছিল। যে পাহাড়িদের দুরবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালের ২৩ জুন তারিখে এম এন লারমা জাতীয় সংসদে বলেছিল,

“আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না যে, আমাদের ওখানে এখনও আদিম যুগের মানুষ রয়েছে। ……….. এরা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় এখনও বাস করে। ………. ব্রিটিশের সময়ে এবং পাকিস্তানের আমলে আমাদেরকে চিড়িয়াখানার জীবের মতো করে রাখা হয়েছিল।” (রহমান, ২০১৮, পৃ-১৪২-১৪৩)।

সেই মানুষদের এক প্রতিনিধিদলকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারিতে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, “উপজাতীয়দের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি পুরাপুরিভাবে সংরক্ষণ করা হবে।” স্মরণযোগ্য, এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পাকিস্তানে বন্দীদশা কাটিয়ে দেশে ফেরার মাত্র ১৮ দিনের মাথায়।

১৯৭৩ সালের ৭ জুনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, “উপজাতীয় এলাকার জনগণের জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করা হবে। … … উপজাতীয় জনগণ ও স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক এবং অন্যান্য নাগরিকদের মতই সমান সুযোগ ও সুবিধা ভোগ করবে।” ১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঘোষণা করেছিলেন, “জাতীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার অবশ্যই রক্ষা করা হবে। …….. অনগ্রসর সম্প্রদায় এবং এলাকার উন্নয়নের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

প্রাসঙ্গিক কারণেই বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর উপজাতীয়দের জন্য  আরো যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

  • ১। চাকমা রাজপরিবারের আর্থিক সংকট চলছিল বলে, বঙ্গবন্ধু নিজেই ত্রিদিব রায়ের ছোট ভাই সমিত রায়কে রাঙামাটি সরকারী কলেজে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের আদেশ দিয়েছিলেন।
  • ২। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্যে বিশেষ আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
  • ৩। বিদেশে উপজাতি শিক্ষার্থী পাঠানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যার ফলে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে ডাক্তারি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কিছু চাকমা শিক্ষার্থী প্রেরণ করা হয়।
  • ৪।  রাঙ্গামাটির ঐ জনসমাবেশেই উপজাতি শিক্ষার্থীদের জন্যে বঙ্গবন্ধু বৃত্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।  এছাড়াও  স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আনারস বাজারজাতকরণের জন্য এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।
  • ৫। বাকশাল গঠনের পরে উপজাতিদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করানো হয়। যেমন, জেলা গভর্নর পদে  খাগড়াছড়িতে মং চীফ এবং বান্দরবানে বোমাং চিফকে নিয়োগ করা হয়। এর পাশাপাশি বাকশালের জেলা সেক্রেটারি হিসেবে খাগড়াছড়িতে অনন্ত বিহারী খীসা, বান্দরবান জেলায় কে এস প্রু এবং রাঙামাটি জেলায় চারু বিকাশ চাকমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। (চাকমা, ২০১১)।
  • ৬। ১৯৭৩-৭৪ সালে বিভিন্ন সময়ে কিছু অর্থনৈতিক – প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।  যেমন, “সরকারী জুম কর মওকুফ ( ৬ টাকার মধ্যে ১.২৫ টাকা), শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন সংরক্ষণ, বেতারে ‘উপজাতি’ অনুষ্ঠান প্রচার, বাংলা একাডেমি কর্তৃক উপজাতীয় গল্প, কবিতা, ছড়া, লোকগাথা ও রুপকাহিনী প্রকাশ ইত্যাদি।” (রহমান, ২০১৮, পৃ-১৭৩)।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুর আমলেই ১৯৭২ সালে আই এল ও কনভেশন-১০৭ বাংলাদেশ কর্তৃক গ্রহীত হয়।  যেখানে উপজাতি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ইত্যাদি সকল অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকার করার পাশাপাশি নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মনোভাব কেমন ছিল, সেটার উল্লেখ পাওয়া যায় শরদিন্দু শেখর চাকমা রচিত ‘বঙ্গবন্ধু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ এবং ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সেকাল একাল’ বইয়ে।  লেখক জানিয়েছেন যে, রাঙ্গামাটির তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ, এম, আব্দুল কাদের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের উপ-সচিব থাকাকালে বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, উপজাতিরা সহজ সরল মানুষ এবং পাকিস্তান আমলে তারা নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েছিল।   এছাড়া, “ কেবল রাজা ত্রিদিব রায় এবং অং শুয়ে প্রু চৌধুরীর কারণে সকল চাকমা এবং অন্যান্য উপজাতিদের বাংলাদেশ বিরোধী বলে বিশ্বাস করা বা মনে করা তো ঠিক নহে।”(চাকমা, ২০১১)।

শুধু তাই নয়, জেলা প্রশাসক আব্দুল কাদের এবং কর্ণফুলী বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ, কে, এম, ফজলুল হক মিয়া দু’জনে মিলে বঙ্গবন্ধুকে আরো বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্য জেলা থেকে বাঙালী পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত জমি নেই। যার ফলে, বঙ্গবন্ধু রাঙ্গামাটির পূর্বতন জেলা প্রশাসক “ জিন্নাত আলীর পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী পুনর্বাসনের প্রস্তাব নাকচ করে দেন।” (চাকমা, ২০১১, পৃ-১১)।

২৭ জুন ২০০৮ তারিখের সাপ্তাহিক ২০০০ এর সুত্রোল্লেখ করে, শরদিন্দু শেখর চাকমা জানান যে , ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বাকশালে যোগদানের সময় বঙ্গবন্ধু নিজেই জন সংহতি সমিতির নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে বলেছিলেন,

“তাঁর কিছু লোক চাকমাদের সম্পর্কে তাকে ভুল তথ্য দিয়েছিল, সেটা তিনি পরে বুঝতে পেরেছেন, তিনি এখন চাকমাদের জন্য কিছু করতে চান।” (চাকমা, ২০১১, পৃ-১১)।

বস্তুত, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই সত্য চোখে পরে যে, বঙ্গবন্ধু কখনই উপজাতিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি ।  এমনকি পুরো দেশ যখন স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি নির্দয় ছিল, স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরের সেই দিনগুলোতেও তিনি অন্যদের মত প্রতিশোধপরায়ণ হন নি।

বরং উপজাতিদের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন।  পরবর্তীকালে তিনি তাদের সকল স্বার্থ ও অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের জন্যে বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।  যা থেকেই সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গবন্ধু পাহাড়ের উপজাতিদের প্রতি মুলত সহানুভূতিশীল ছিলেন, বিদ্বেষী ছিলেন না।

তাই, নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের স্বার্থহানিকর কোন কিছু বোঝাতে চাননি, বরং তাদেরকে দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার নিশ্চিত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন।  তাঁর লক্ষ্য ছিল জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে  বাংলাদেশের  আপামর জনসাধারণের জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি।  যেখানে বৃহত্তর বাঙালী জাতীয়বাদের মধ্যেই দেশের সকল  সংখ্যালঘুর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধর্ম, কৃষ্টি ইত্যাদির রক্ষাকবচের মাধ্যমে নিজস্ব অস্তিত্ব বিকাশের সুযোগ থাকবে।

অপরদিকে কিছু স্বার্থান্বেষী চাকমা নেতা মহান নেতার এই আহবানের ভুল ব্যাখ্যায় নিরীহ-সাধারন পাহাড়িদের প্রতারিত করেছিলেন। যেখানে কিছু স্বার্থান্বেষী নেতার চোখের সামনে হাজির ভোটের রাজনীতিতে জয়ী হওয়ার অভিপ্রায়ের কাছে দৃষ্টির আড়ালে রয়ে যাওয়া পার্বত্য অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের স্বার্থ এবং ভাগ্যোন্নয়নের চাবিকাঠি চাপা পরে গিয়েছিল। সহজ সরল পাহাড়িদেরকে যার জের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বংশানুক্রমিকভাবে – কোন কারণ না জেনেই, না বুঝেই। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান প্রজন্মের কাছ থেকে সত্য জানার ন্যুনতম সুযোগ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে –  ঘৃণা, বিদ্বেষ আর অপপ্রচারের ডামাডোলে।

  • তথ্যসুত্রঃ
    ১। মেজর জেনারেল ইব্রাহিম, বীর প্রতীক (অব.) (২০১৮). পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ- পরিস্থিতির মূল্যায়ন (৪র্থ মুদ্রণ), ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স।
  • ২। প্রদীপ্ত খীসা, (১৯৯৬). পার্বত্য চট্রগ্রামের সমস্যা. ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ।
  • ৩। শরদিন্দু শেখর চাকমা, (২০১১). বংগবন্ধু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম. ঢাকা: বিভাস।
  • ৪। জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, (১৯৯১). ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ. রাঙামাটি: স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
  • ৫। জিবলু রহমান, (২০১৮). পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সমাধান (১৯৭২-১৯৯৮). সিলেট: শ্রীহট্ট প্রকাশ।
  • ৬। সুনীতি বিকাশ চাকমা, ‘উপজাতীয় নেতৃত্বঃ সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিকথা’, প্রকাশের সময় অজ্ঞাত।
  • ৭। ডাঃ হারুন-অর-রশিদ, ‘জাতীয় সংহতির প্রেক্ষিতেঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপ’ (১ম পর্ব), দৈনিক জনকণ্ঠ, জুলাই ১৭, ১৯৯৮, ঢাকা।
  • ৮। স্টাফ রিপোর্টার, পত্রিকায় ‘উপজাতীয় এলাকার জনগণের জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করা হবেঃ বঙ্গবন্ধু, দৈনিক পূর্বদেশ, ৭ জুন ১৯৭৩,  ঢাকা।
  • ৯। Bhaumik, Subir. (1996). Insurgent Crossfire North-East India. New Delhi: Lancer Publishers.
  • ১০। Tripura, Naba Bikram Kishore (Ed.). (2017). Chittagong Hill Tracts: Journey towards Peace and Prosperity. Dhaka: Ministry of Chittagong Hill Tracts Affairs.

মাহের ইসলামের আরো লেখা পড়ুন:

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমান
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন