পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও বাস্তবায়ন অগ্রগতি

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ২৫ বছর আগে যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিয়ে কথা উঠেছে পক্ষে-বিপক্ষে। এ নিয়ে নিবিড় পর্যালোচনা দরকার। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে ওই শান্তিচুক্তি হয়। চুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমরা বহুবার প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমি পাহাড়িদের পক্ষে স্বাক্ষর করেছি, আমার দায় আছে, আমি প্রশ্নবিদ্ধ আমার আক্ষেপ হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন তো আমি দেখতে পেলাম না। বাংলাদেশে যারা আজ শাসনে আছে বা সামনে আসবে, তাদের প্রত্যক্ষ করলে আমি পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষীণ সম্ভাবনাও দেখি না। কারণ এ দেশে গণতান্ত্রিক শাসন নেই। যত দিন এ দেশে গণতান্ত্রিক, গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক সরকার না আসবে ততদিন চুক্তি আলোর মুখ দেখবে না।’ সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বৃহত্তর আন্দোলনে শামিল হোন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় উপর্যুক্ত মন্তব্য করেন সন্তু লারমা। (বিডিনিউজ২৪ডটকম)

এই চুক্তির ইতি ও নেতিবাচক দু’টি দিক রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ত্রিপুরায় ঘাঁটি স্থাপন করে বাংলাদেশের পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের রাজনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনা, শান্তি বাহিনীকে নিরস্ত্রীকরণ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার তাদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করে। এটিই ছিল সরকারের বক্তব্য। রাষ্ট্র পরিচালনায় চুক্তি অত্যন্ত জরুরি, সময় বিশেষে অপরিহার্য। চুক্তি যদি শান্তির উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হয় তাহলে সব সময় তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য কিন্তু চুক্তি যদি শান্তির পরিবর্তে দুর্যোগের ঘনঘটা তৈরি করে তাহলে তা প্রত্যাখ্যান অপরিহার্য। পার্বত্য শান্তিচুক্তি আসলে কতটুকু শান্তি নিয়ে এসেছে অথবা আনবে তা সংশ্লিষ্ট মহল ভালোভাবে জানে। তবে পরিস্থিতি একটি অশনি সঙ্কেতের পূর্বাভাস দিচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়ের সাথে বাংলাদেশ সরকারের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরপরই গোটা পার্বত্য এলাকায় অশান্তির দাবানল জ্বলে ওঠে। শুরু হয় কালো পতাকা উত্তোলন, অবরোধ, হরতাল, লংমার্চ, বয়কটসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। সম্পাদিত এ অসম চুক্তির ফলে চাকমা সন্ত্রাসীদের কাছে বাংলাদেশ সরকার নতি স্বীকার করে। আঞ্চলিক পরিষদের হাতে এত বেশি ক্ষমতা দেয়া হয় যে, তাতে পার্বত্য এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের আইনগত কোনো কর্তৃত্ব আছে বলে মনে হয় না। পতাকা ও মুদ্রা ছাড়া সব নির্বাহী ক্ষমতা চাকমাদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১২টি উপজাতির মধ্যে শুধু চাকমাদের সাথে চুক্তি করা হলো কেন? সন্তু লারমা কি পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি? জনসংহতি সমিতি কি কোনো ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সংগঠন? তাহলে একটি নির্বাচিত সরকারের সাথে একটি অনির্বাচিত গ্রুপের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব হস্তান্তরের চুক্তি হয় কী করে? এ চুক্তি শান্তির সুবাতাস বয়ে আনতে পারেনি; বরং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষোভ ও অসন্তোষের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। চুক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে বাঙালিরা বঞ্চনার প্রতিশোধে জ্বলে উঠতে পারে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। তখন হয় তো বেঁধে যেতে পারে বাঙালি-চাকমা সঙ্ঘাত। স্বজন হারানোর বেদনায় আবার পাহাড়ি এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠতে পারে। বিপন্ন হতে পারে প্রতিবেশ।

বাঙালি-পাহাড়ির মধ্যে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠুক এটি যেকোনো নাগরিকেরই একান্ত কামনা। এমন চুক্তি হওয়া চাই, যাতে পাহাড়ি-বাঙালি উভয়েরই স্বার্থ সংরক্ষিত হয় কিন্তু সম্পাদিত চুক্তিটি একতরফা পাহাড়িদের পক্ষে। প্রশ্ন উঠতে পারে, পার্বত্য এলাকায় বাঙালিরা বহিরাগত, তাদের স্বার্থ আবার কী? তবে ইতিহাস বলে চাকমারাও কিন্তু ‘ভূমিপুত্র’ (Son of the soil) নয়; তারাও বহিরাগত। তাদের আদি বাসস্থান মিয়ানমারের আরাকান। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১০ লাখ বাঙালি রয়েছে। তাদের স্বার্থ ও মতামত কি বিবেচনার অযোগ্য?

চুক্তির অন্যতম শর্ত হচ্ছে পার্বত্য এলাকার গুটিকয়েক সেনা ছাউনি ছাড়া বাকি অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার। কিন্তু কেন? সেনা ক্যাম্পগুলো থাকলে পাহাড়িদের অসুবিধা কী? সেনাবাহিনী তো নিরাপত্তার প্রতীক, সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। দেশের স্বার্থে ও জাতির মর্যাদা রক্ষায় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়ার জন্যই তো সেনাবাহিনীর জন্ম। একটি দেশের অভ্যন্তরে যেকোনো জায়গায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প থাকতে পারবে না এটি কেমন অমর্যাদাকর কথা। জুম্মুল্যান্ড প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব সেনাক্যাম্প বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এ ভয়ে হয়তো চাকমারা সন্ত্রস্ত। অথচ বিশ্বের রাজনৈতিক ঘটনা পরম্পরা পর্যালোচনা করলে স্পষ্টত প্রমাণ মেলে, পৃথিবীর বহু দেশ তাদের রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে অনেক অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ রাশিয়া হাজার মাইল দূরে জাপানের কিউলিস দ্বীপপুঞ্জে, ব্রিটেন ১০ হাজার মাইল দূরে ফকল্যান্ডে, ফ্রান্স ১২ হাজার মাইল দূরে মরুরোয়ায় ও আমেরিকা ভারত মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর, পারস্য উপসাগর ও দিয়াগো গার্সিয়াসহ বিশ্বের সর্বত্র সেনাবাহিনী মোতায়েন করে রেখেছে।

চুক্তির আরেকটি অন্যতম শর্ত হলো- পার্বত্য এলাকায় ভূমি জরিপ ও ভূমিসংক্রান্ত জটিলতা দূরীকরণ।

পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধিত) আইন-২০১৬ নামে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে বসবাসরত ৫২ শতাংশ বাঙালির মধ্যে শঙ্কা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ গঠিত কমিশনে পার্বত্য বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার আইন থাকায় এ কমিশন থেকে একতরফা যেকোনো সিদ্ধান্ত আসার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠী ভূমিহীন হয়ে যেতে পারে বলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

পার্বত্য বাঙালিরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তাদের প্রত্যাশা, শান্তির স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সব উপজাতি ও বাঙালি ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে তাদের প্রাপ্য অধিকার ভোগ করুক, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের ভূমি ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৬ সংশোধন করে জনসংখ্যার অনুপাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সব জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধির উপস্থিতি ও মতামত নিশ্চিত করে ভূমি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে শান্তি ও আস্থা ফিরে আসবে।

রাজনৈতিক সমীক্ষকদের ধারণা, দিল্লির চাপে পড়ে বাংলাদেশ সরকারকে এ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থ, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের স্বার্থ বিঘ্নিত হলেও দিল্লির স্বার্থ কিন্তু শতভাগ রক্ষিত হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও এর সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। ফলে ইউরোপীয় ইহুদি-খ্রিষ্টান লবি পার্বত্য চুক্তিকে স্বাগত জানায়। পার্বত্য এলাকার চাকমা সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও আশ্রয়দাতা হচ্ছে ভারত। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সহায়তায় ত্রিপুরা সীমান্তের অদূরে চাকমা তরুণদের সশস্ত্র ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল। প্রশিক্ষণ শেষে চাকমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানোর জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে পাঠানো হতো। ভারতীয় মদদ না পেলে তথাকথিত শান্তিবাহিনীর পক্ষে এক মুহূর্ত টিকে থাকা সম্ভব নয় এ কথা সচেতন ব্যক্তি মাত্রই বোঝেন। এ উপজাতি সন্ত্রাসীরা বিগত ২৬ বছরে ৩০ হাজার বাঙালিকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। গৃহহারা ও স্বজনহারা করেছে অনেক আদম সন্তানকে। অপহরণ করে গুম করে ফেলেছে অনেক বাঙালিকে। পণবন্দী, চাঁদাবাজি, টোকেন প্রথা, অপহরণ, ধর্ষণ পার্বত্যাঞ্চলে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। চাকমা সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দান ও সহিংসতা বিস্তারে ভারতীয় উদ্দেশ্য একেবারে স্পষ্ট।

প্রথমত, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের ওপর স্থায়ী রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা।

দ্বিতীয়ত, ভারত চট্টগ্রাম বন্দরকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে ‘সেভেন সিস্টার’ নামে পরিচিত পূর্বাঞ্চলীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমন করতে চায়। মিজোরাম, অরুণাচল, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় রাজ্যে জনগণ দিল্লির বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রানজিট সুবিধার মাধ্যমে ভারতীয় সেনা তিনগুণ কম সময়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ঢুকে যেতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের অনুগত আঞ্চলিক পরিষদ থাকলে পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহ দমন তাদের পক্ষে সহজতর হবে।

তৃতীয়ত, অহমীয়, নাগা ও মিজো বিদ্রোহীরা ছদ্মবেশে বাংলাদেশে অবস্থান করত অথবা অন্য দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করত। ভারতীয় চাপের ফলে বাংলাদেশে এসব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গ্রেফতার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অতীতে, ঢাকায় উলফার (United Liberation Front of Assam) মহাসচিব অনুপ চেটিয়া ওরফে গোপাল বড়ুয়া ও তার দুই সহযোদ্ধা লক্ষ্মী প্রসাদ ও বাবুল শর্মাকে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়।

চতুর্থত, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার বিরুদ্ধে যারা অস্ত্রধারণ করে তারা দেশদ্রোহী। আসামের অনুপ চেটিয়া ভারতের দৃষ্টিতে দেশদ্রোহী। তাকে জীবন্ত ধরে আনার জন্য ইন্টারপোলের সহায়তা কামনা করে ভারত। অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়। কাশ্মিরের মীর ওয়ায়েজ ফারুককে শহীদ করে দিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাঞ্জাবের স্বর্ণ মন্দিরে হত্যা করা হয়েছে খালিস্তানের নেতা ‘আগরওয়াল’কে। অথচ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সন্তু লারমাকে হেলিকপ্টারে করে দুদুকছড়ি থেকে ঢাকায় এনে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে মহাসমারোহে আপ্যায়িত করা হয়। অপর বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা কল্প রঞ্জন চাকমাকে পূর্ণ মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব হচ্ছে ভারতের ইঙ্গিতে। চানক্যনীতির কী অদ্ভুত প্রকাশ!

পঞ্চমত, পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে ভারতীয় স্বার্থ, মার্কিন স্বার্থ ও ইউরোপীয় স্বার্থ এক মোহনায় এসে মিলিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ ক’টি মার্কিন কোম্পানি তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। চাকমাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে মার্কিনিরা নিরূপদ্রবে তেল গ্যাস নিয়ে যেতে ইচ্ছুক। আহরিত প্রাকৃতিক ও খনিজ পদার্থের রয়্যালটি পাবে আঞ্চলিক পরিষদ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কি পেল, এটি বড় কথা নয়।

ষষ্ঠত, বহুকাল ধরে বাংলাদেশী ও ভারতীয় পার্বত্য এলাকার ওপর ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মিশনারি ও এনজিওর মাধ্যমে বিপুল জনগোষ্ঠীকে খ্রিষ্টান বানানো হয়েছে। মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে রয়েছে রেকর্ডসংখ্যক ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানদের সংখ্যাও একেবারে ফেলনা নয়। আন্তর্জাতিক শক্তি চায় বাংলাদেশী ও ভারতীয় পার্বত্য এলাকা নিয়ে এক বা একাধিক স্বাধীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের জন্ম দিতে। তাই চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই খ্রিষ্টান নিয়ন্ত্রিত দাতাগোষ্ঠী প্রকাশ্যে চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে- পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌত অবকাঠামো ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে তারা সাহায্য প্রদানে অত্যন্ত আগ্রহী। বিগত ২৫ বছরে তাদের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা অনেকটা বাস্তবায়িত হয়েছে। এভাবে ভারত ও বাংলাদেশের মাঝখানে গড়ে উঠবে নতুন ইসরাইল। এ শান্তিচুক্তি বেলফোর ডিক্লারেশনের মতো তাৎপর্যপূর্ণ। বেলফোর ডিক্লারেশন আরবের বুকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম দিয়েছিল তেমনি এ শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের বুকে নতুন খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে। এখানে আরো একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও দাতাগোষ্ঠী এ চুক্তিকে স্বাগত জানালেও এ পর্যন্ত কোনো মুসলিম রাষ্ট্র এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেনি। কালব্যাধি যেমন মানবদেহকে ভেতর থেকে খেয়ে ফোকলা বানিয়ে দেয় তেমনি এ চুক্তির কালব্যাধিও বাঙালিদের সার্বিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দেবে।

সপ্তমত, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ২০২০ সালে চিকিৎসার নামে জনসংহতি নেতা সন্তু লারমা অতি গোপনে প্রতিবেশী দেশটিতে গেছেন। নয়াদিল্লিতে উপস্থিত হয়ে দেশটির মন্ত্রীদের সাথে আলোচনা করেন যাতে চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। এতে বেশি ফায়দা হয়েছে বলে মনে হয় না।

অষ্টমত, পাহাড়ে হানাহানি বন্ধে নতুন চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। সরকারের কাছে পেশের জন্য মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালে প্রসিত বিকাশ খিসার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ইউপিডিএফ। ৬৬ পৃষ্ঠার ওই প্রস্তাবে মোট ৮৭টি দাবি এবং প্রতিটি দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

দাবিনামার ভাগগুলো হলো- সাংবিধানিক অবস্থা, সাংবিধানিক আইন ব্যতীত অন্য কিছু আইন রহিতকরণ ও সংশোধন, সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৮৮-এর সংস্কার, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনগুলোর সংস্কার, পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন, পুনর্বাসন, মামলা প্রত্যাহারসহ অন্যান্য বিষয় ও চুক্তি বাস্তবায়ন। সরকার কি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়ন করবে নাকি ইউপিডিএফের সাথে নতুন চুক্তি সম্পাদন করবে? এটি দেখার বিষয়।

শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমা বলেন, ‘সাতচল্লিশে দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলে পাহাড়ে ইসলামীকরণ আমি দেখেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাহাড়ের মানুষেরা নতুন দেশ, নতুন জীবনের আশা করেছিল। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে নতুন দেশের শাসনামলে নতুন পরিচিতি জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ে বাঙালিকরণ শুরু করা হলো। এক দিকে বাঙালিকরণ, অন্য দিকে ইসলামীকরণ; এই দুই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের জীবনধারা বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে।’ (বিডিনিউজ২৪ডটকম)

সন্তু লারমা বাঙালিকরণ ও ইসলামীকরণকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশের সমতলের যেকোনো জেলায় ও যেকোনো স্থানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বসতি স্থাপন করে সরকারি-বেসরকারি চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ধর্মচর্চা সাংবিধানিক কোনো বাধা ছাড়াই করতে পারবে। বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাহাড়ে যেতে ও থাকতে এত আপত্তি কেন? ইসলামীকরণ নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুললেও খ্রিষ্টীয়করণ নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই। পাহাড়ের বেশির ভাগ নৃগোষ্ঠী এখন খ্রিষ্টান। ইদানীং পার্বত্য চট্টগ্রামে অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। সাজেক, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র। এর পেছনে সরকারের উদ্যোগ এবং সেনাবাহিনীর শ্রম ও অবদান অস্বীকার করার জো নেই। উপজাতি কোটায় পাহাড়িরা এখন শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংকিং সেক্টর, সরকারের বিভিন্ন ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে উচ্চপদে চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছে।

অনেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতি সন্তু লারমার আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার বয়স এখন ৭৯। ৭৭ বছর পর্যন্ত তিনি ভোটার হননি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নেননি। ২০২১ সালে করোনার টিকা গ্রহণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে বাধ্য হন।

সরকারের সিদ্ধান্ত আছে, জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে কোভিড-১৯-এর টিকা পাওয়ার সুযোগ নেই। বলা হয়ে থাকে, আঞ্চলিক পরিষদের আইনে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়নের দাবিতে দীর্ঘদিন ভোটার হওয়া থেকে বিরত ছিলেন সন্তু লারমা। (ডয়চে ভেলে, ২৭ সেপ্টেম্বর-২০২১) ফলে ১৯৯৭ সালের পর থেকে কোনো জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দেননি তিনি।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির সবচেয়ে বেনিফিশিয়ারি সন্তু লারমা নিজে ও তার সংগঠন। শান্তিবাহিনীর হাজারখানেক সদস্যকে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি দেয়া হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর দীর্ঘ দিন ধরেই প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। রাষ্ট্রীয় বা সরকারের সব সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছেন তিনি। রাষ্ট্রীয় টাকায় চলাফেরা, জাতীয় পতাকা বহনকারী গাড়ি, আলিশান বাড়ি সব কিছুই ভোগ করছেন। অথচ অবাক হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে- স্বাধীনসার্বভৌমত্ব বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেননি সন্তু লারমা ২০২১ সাল পর্যন্ত। একজন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার সাংবিধানিক পদের এই ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র এত দিন না নেয়া অতি বিস্ময়কর বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে ২০১৯-এর জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪২ জন খুন হয়েছে। মোট ২৪টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা এই ৪২ জনকে হত্যা করেছে। নিহত ৪২ জনের রাজনৈতিক পরিচয় বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে শাসকদল আওয়ামী লীগের ৯ জন, আটজন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি, ১৪ জন জেএসএস (সংস্কারপন্থী গ্রুপ), এমএনপি পাঁচজন, জেএসএস মূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একজন ও চারজন সাধারণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক গবেষণা সংস্থা সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচটিআরএফ) এক গবেষণা থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে। সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ বলেন, ‘শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তপাত বন্ধ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সন্তু লারমার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। কারণ জেএসএস তার সব অস্ত্র জমা দেয়নি এবং সব সামরিক সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করেনি।’ সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘তারা এটি সীমিত রেখেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সন্তু লারমা তার শাখার মাধ্যমে জোরালো সামরিক তৎপরতা শুরু করেছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হোক এটি সন্তু লারমা চান না। সে কারণে সরকারের সম্প্রীতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশীদার হতে যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হয়েছে তারা তার রোষানলে পুড়েছে। বিশেষ করে তারা সশস্ত্র সন্ত্রাস, জাতির মুক্তির নামে চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণের মতো সমাজবিরোধী কার্যক্রমে বিতৃষ্ণ হয়ে যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য জেএসএস ছেড়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে তাদের ওপর জেএসএস নির্যাতন চালিয়েছে। বিশেষ করে যারা দল ত্যাগ করে অন্য সংগঠনে যোগ দিয়েছে বা স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে এসেছে তাদের নির্মম পরিণতির শিকার হতে বাধ্য করেছে জেএসএস। মেহেদী হাসান পলাশ জানান, জাতির মুক্তির জন্য আন্দোলনের কথা বলে জেএসএস নিজ জাতির লোকদের ওপরই চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণ ও সন্ত্রাসের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। কেননা যে ৪২ জন খুন হয়েছে তাদের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বাসিন্দা। (বাংলানিউজ২৪ডটকম, ১৩ জুলাই-২০২০)

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মো: মুজিবুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও সন্তু লারমা দেশের জাতীয় পরিচয়পত্রই নেননি ২০২১ সাল পর্যন্ত। এটি রাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মতো বিষয়। জাতীয় পরিচয়পত্র না নিয়েও তিনি প্রতিমন্ত্রীর সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলেও তার রয়েছে পাসপোর্ট। তিনি বেশির ভাগ সময়ই ভারত বা মিয়ানমার হয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে থাকেন। মুজিবুর রহমান বলেন, এই সন্তু লারমা কেবল এখানেই ক্ষান্ত হননি, তিনি পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য আলাদা পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এটি তার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ (দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ, ২ ডিসেম্বর-২০১৯)

অতএব, দলমত ধর্ম নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিককে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে, গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন। ভুলে গেলে চলবে না, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতার বাতাবরণ তৈরি করা সময়ের অপরিহার্য দাবি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন