পাহাড়ে শুরু হয়েছে বৈসাবি’র আমেজ: বর্ষবরণকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি

boisabi pic

এম. সাইফুর রহমান, খাগড়াছড়ি:

পাহাড়ী সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব বৈসাবি। বৈসাবিকে ঘিরে প্রতি বছরের মতো এবারো পাহাড়ে শুরু হয়েছে উৎসবের আমেজ। চৈত্রের শেষ দু’দিন এবং পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষকে ভিন্নরুপে উদযাপন করে পার্বত্যাঞ্চলের মানুষ। পাহাড়-হ্রদ-অরণ্যের শহর রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে শুরু হওয়া বর্ষ বিদায় এবং বর্ষবরণের মহান উৎসব উপজাতিদের প্রাণের উৎসব বৈসাবি।

চাকমাদের ভাষায় এ উৎসবকে বিঝু, ত্রিপুরাদের ভাষায় বৈসুক, মারমাদের ভাষায় সাংগ্রাইং, তংচঙ্গাদের ভাষায় বিষু ও অহমীয়দের ভাষায় বিহু নামে আখ্যায়িত করা হয়। এছাড়া ম্রো ঙ্গালীমি সম্প্রদায়রা “ক্লবং পাই” নামে উৎসবটিকে পালন করে। প্রধান তিন সম্প্রদায়ের প্রাণের এ উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়েই এ মহান উৎসবেক বলা হয় বৈসাবি”। কেউ কেউ বৈসাবি নামকরণটি মেনে নিতে না পারলেও পার্বত্যাঞ্চলে এ নামটি বহুল পরিচিত ও আলোচিত।

তিন দিনব্যাপী এ উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় ফুলবিঝু, দ্বিতীয় দিনকে মূলবিঝু এবং তৃতীয় দিনকে নুয়াবঝর বা গেজ্যা পেজ্যা দিন বলা হয়। এভাবেই ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে হারিকুইসুক দ্বিতীয় দিনকে বুইসুকমা এবং তৃতীয় দিনকে বিসিকাতাল নামে অভিহিত করে থাকে। মূলত এটি পাহাড়ী সম্প্রদায়ের সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব হলেও বাঙালী সম্প্রদায়ও সমানতালে উপভোগ করে এ উৎসব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে সারাদেশের উৎসব প্রিয় মানুষ প্রতি বছর পার্বত্য এলাকায় এই দিনটিতে ভিড় জমায়।

বৈসুক : ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং প্রধানতম উৎসব হলো বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্রমানের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের প্রথম দিন মোট তিনদিন পালন করা হয় এই উৎসব। উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড়-চোপড় ধুয়ে পরিস্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মোরগ-মুরগীতে ছিটিয়ে দেয়। ত্রিপুরা নবদম্পতি ও যুবক-যুবতীরা নদী থেকে কলসি ভরে পানি এনে গুরুজনদের গোসল করানোর মাধ্যমে আশির্বাদ গ্রহণ করে। গৃহপালিত সব প্রাণীকে খুব ভোরে ছেড়ে দেয়। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পড়ে ছেলেমেয়েরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ছেলেমেয়েদের বিচিত্র পিঠা আর বড়দের মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। বৈসুক শুরুর দিন থেকে গরয়া নৃত্যদল গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক ঘরের উঠোনে নৃত্য করে। এ আনন্দদায়ক ও চিত্তাকর্ষক নৃত্যকে ত্রিপুরারা গরয়া নৃত্য বা খেরেবাই নৃত্য বলে থাকে। এই নৃত্যে ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয়। নৃত্য শেষে শিল্পিরা উপঢৌকন হিসাবে পাওয়া সামগ্রী গরয়া দেবতার পূজা করে। কোন শিল্পী একা গড়াইয়া নৃত্যে অংশ নেয় না। নৃত্যটিতে ১৬,১০০,১৫০, থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারে।

boisabe 15 (1)সাংগ্রাইং : পাহাড়ের মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন তিনদিন ধরে সাংগ্রাইং উৎসব পালন করে। মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব হলো সাংগ্রাইং। মারমারা সাধারণত মঘিসনের চন্দ্র মাস অনুসারে এ দিনটি পালন করে থাকে। বছরের শেষ দুইদিন ও নববর্ষের প্রথমদিন তারা পালন করে ফারাং রিলংপোয়েহ অর্থাৎ বৃদ্ধের স্নানোৎসব। এই দিন মারমা সম্প্রদায়ের নারী পুরুষ সবাই মিলে বৌদ্ধ মূর্তিগুলোকে নদীর ঘাটে নিয়ে যায়। তারপরের দিনগুলোতে শুরু হয় মারমা সম্প্রদায়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান রিলংপোয়ে অর্থাৎ জলকেলি উৎসব। সাংগ্রাইং উৎসব এবং রিলংপোয়ে বা পানি খেলা এখন যেন একে অপরের সমার্থক হয়ে গেছে। এ খেলার সময় এক জায়গায় পানি ভর্তি রেখে যুবক-যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছুড়ে মারে। স্নিগ্ধতায় ভিজিয়ে দেয় পরস্পরকে। সাংগ্রাইং উৎসব উৎযাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা তৈরি করার জন্য চাউলের গুড়া তৈরি করে। পাড়ায় পাড়ায় ঝুলবে ফুলফল পত্র পল্লবে শোভিত নানা কারুকার্য বাজারে ড্রাম চলবে নাচ-গান, হাসি-তামাশা করবে। এছাড়াও এই দিন মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শ্রবণ করে।

বিঝু : চৈত্রের শেষ দুইদিন ও পয়লা বৈশাখ এ তিনদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ উপজাতি সম্প্রদায় চাকমারা মহাসমারোহে বিঝু উৎসব পালন করে। বিঝু তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনুভূতি আর মোহনীয় আবেশ। তারা মনে করে প্রতি বছরই চাকমা জনপদে একটি পাখি বিজু বিজু ডাক সবাইকে বিঝুর আগাম আগমনী বার্তা জানিয়ে দিয়ে যায়। এ উৎসবের সঙ্গে তাই যেন দূলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। বিঝু উৎসবের সময় তারা কোন প্রাণী হত্যা করে না। উৎসবের জন্য তারা ঘরে ঘরে প্রচুর পরিমাণে পাহাড়ী মদ সংগ্রহ করে রাখে, মুখরোচক খাবারের জন্য নানা রকস শাক সবজি তরি-তরকারী সংগ্রহ করে রাখা হয়। উৎসবের প্রথম দিনে খুব ভোরে তারা নদীতে গিয়ে স্নান করে। নদীর ঘাটে গিয়ে জলদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল পূজা করে। সবাই মিলে একসাথে বৌদ্ধমূর্তিকে স্নান করায়। রাতে সারিসারি আলো জালিয়ে সব গ্রাম উৎসবের আলোয় উদ্ভাসিত করে রাখা হয়। এটাই হচ্ছে তাদের মূল উৎসব। এই দিন সবার ঘরে কমপক্ষে ৫ রকমের তরিতরকারী দিয়ে বিশেষ ধরণের পাজোন রান্না করা হয়। গ্রাম্য ছেলেমেয়েরা গিলা খেলা, গুদু (হা-ডু-ডু) খেলায় মেতে উঠে আর আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং আতশবাজি ফোটায় মহানন্দে।

সর্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটি গঠন:
এদিকে বৈসাবি অনুষ্ঠান সফল করতে খাগড়াছড়িতে কিরণ মারমাকে আহ্বায়ক ও মিলন দেওয়ান (মনাঙ)-কে সদস্য সচিব করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি সর্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ১৩ মার্চ স্বনির্ভরস্থ ঠিকাদার সমিতি ভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় উক্ত কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে বৈসাবি উপলক্ষে আগামী ১২ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। রবিবার চেঙ্গী নদীতে ফুল ভাঁসানোর মধ্যদিয়ে বৈসাবীর উৎসব শুরু, সোমবার ফুল বিঝুর দিন বৈসাবি র‌্যালি অনুষ্ঠিত হবে, মঙ্গলবার মুল দিনগুলিতে বয়স্ক এবং মুরুব্বীসহ দলবদ্ধভাবে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় করা হবে। এছাড়াও নতুন বছরের সুখ-শান্তি কামনায় প্রদীপ প্রজ্জ্বালন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পানি খেলা ও গড়িয়া নৃত্য অনুষ্ঠিত হবে।

অন্যদিকে বৈসাবী উৎসব’কে সফল করতে জেলার গুইমারা রিজিয়নের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এবার রিজিয়ন সদর দপ্তরে ৩দিনের মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এ মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ সম্মিলিত প্রস্তুতি বৈঠক শেষ হয়েছে।

প্রতি বছর বৈসাবি উৎসব আসে। পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণের ছোয়া। নব আনন্দে জাগে পাহাড়ের অধিবাসীরা। পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে শুরু হয় এক মহামিলন মেলায়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন