প্যারাগুয়েতে ১৫শ’ বাংলাদেশি, মাথা উঁচু করেছে নিজস্ব মসজিদ

image_90078_0

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ও বলিভিয়া পরিবেষ্টিত দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যঞ্চলে একটি অনুন্নত ভূখণ্ড প্যারাগুয়ে। প্রতিবেশী দেশসমূহের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ হলেও আয়-রোজগারের দিক দিয়ে দেশটিতে ভালো আছেন বাংলাদেশিরা।

৬৮ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্যারাগুয়েতে এখন প্রায় ১৫শ’ বাংলাদেশির বসবাস। আর্জেন্টাইন সীমান্তবর্তী ‘আসুনসিয়ন’ নগরী দেশটির রাজধানী। এখানে মাত্র ১৫-২০ জন বাংলাদেশির বসবাস হলেও রাজধানী থেকে ৫শ’ কিলোমিটার দূরে দেশের অপর প্রান্তে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বর্ডার লাইনে ‘সিউদাদ দেল এস্তে’, যেখানে বসবাস করেন প্রায় ৭শ’ বাংলাদেশি।

প্যারাগুয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ‘সিউদাদ দেল এস্তে’ থেকে ২শ’ কিলোমিটার উত্তরে ‘সালতো দেল গুয়াইরা’ এবং ব্রাজিলীয় সীমান্ত ঘেঁষেই আরো উত্তরে ‘পেদ্রো খুয়ান কাবাল্লেরো’ উভয় শহরেই প্রায় সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ করে বাংলাদেশির বসবাস। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি ব্রাজিলকে ঘিরে বছরজুড়ে জমজমাট ব্যবসার সুবাদে সীমান্তবর্তী উক্ত তিনটি শহরেই মূলত গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ কমিউনিটি। ২৫-৩০ বছর আগে থেকেই দেশটিতে বাংলাদেশিদের বসবাস, তবে বাই-রোডে আমেরিকা-কানাডা যাবার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশিরা ব্রাজিল আর্জেন্টিনা মেক্সিকোসহ লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের মতো প্যারাগুয়েকেও বছরের পর বছর ব্যবহার করে এসেছে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজারে হাজারে গিয়েছেনও তারা ‘কথিত’ স্বপ্নের দেশে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের তুলনায় বিভিন্ন দিক দিয়ে প্যারাগুয়ে দেশ হিসেবে খুব বেশি উন্নত না হলেও এখানে বসবাসরত হাজার দেড়েক বাংলাদেশি সব মিলিয়ে অনেক অনেক ভালো আছেন। পরিশ্রমের বিনিময়েই মাসান্তে তারা গড়ে দুই হাজার ইউএস ডলার থেকে পাঁচ হাজার ডলারও আয় করছেন। ‘সিউদাদ দেল এস্তে’, ‘সালতো দেল গুয়াইরা’ ও ‘পেদ্রো খুয়ান কাবাল্লেরো’ তিনটি শহরের অধিকাংশ বাংলাদেশিরা একই ধরণের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। লেবানিজ ও ভারতীয় পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে তাদের হোল-সেলে কিনতে হয় বিভিন্ন কাপড়-চোপড় ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী যেমন পিসি, মোবাইল, ক্যমেরা সহ রকমারি পণ্য সামগ্রী।

চাহিদা মোতাবেক তারা এসব সাপ্লাই দিয়ে থাকেন বিভিন্ন ছোট ছোট দোকানগুলোতে, যেতে হয় অনেকটা ডোর টু ডোর। মালামাল নিয়ে দূর দূরান্তের বিভিন্ন শহরেও মুভ করতে হয় অনেককে। ব্যবসা ভালো, নর্মাল পরিশ্রমেই মাসের শেষে দুই হাজার ডলার মিনিমাম। সারা বছরই ব্যবসা হয়, তবে আয়-রোজগার প্রতি মাসে সমান যায় না। চোখ-কান খোলা রেখে বাড়তি পরিশ্রমে মাসে গড়ে হাজার পাঁচেক ডলারও ক্যাশ করছেন অনেকেই। ‘সিউদাদ দেল এস্তে’ শহরে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে দোকান নিয়েও ব্যবসা করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কারা কিনছেন এসব মালামাল? না, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকরা অবশ্যই নন, তাছাড়া ট্যুরিস্ট হিসেবে এদেশে এসে দেখার মতোও তেমন কিছু নেই, চারিদিকে স্থলসীমান্ত, নেই কোনো সমুদ্র সৈকত।

ব্রাজিল সীমান্ত জুড়ে বছরব্যাপী যে রমরমা ব্যবসা, তার শতকরা ৯০ ভাগ ক্রেতারাই হচ্ছেন ব্রাজিলিয়ান তথা ব্রাজিল থেকে আসা লোকজন। যে জিনিস ব্রাজিলে ১০ ডলার, ঘরের কাছের প্যারাগুয়ে থেকে তা কেনা যাচ্ছে মাত্র ২-৪ ডলার খরচায়। ‘লিভিং কস্ট’ তথা জীবন যাত্রার ব্যয় ব্রাজিলের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ প্যারাগুয়েতে। পাঠক বুঝতেই পারছেন, ব্যবসায়িক কারবার কি ঘটছে সীমান্ত শহরগুলোতে, বিশেষ করে প্যারাগুয়ের ভূখণ্ডে। সবাই যে শুধু কেনাকাটা করতেই সকাল-সন্ধ্যা ব্রাজিল থেকে প্যারাগুয়েতে এসে থাকেন তা কিন্তু নয়, রাতে থাকেন ব্রাজিলে আর সারাদিন ব্যবসা-বাণিজ্য করেন প্যারাগুয়েতে এমন লোকজনও আছেন হাজার হাজার। বলা হয়ে থাকে, কেনাকাটা ও ব্যবসার নিমিত্তে ব্রাজিল থেকে লোকজন যদি এক দিন সীমান্ত পাড়ি না দেয়, তবে সেদিন প্যারাগুয়ে অচল।

বাংলাদেশের মতো প্যারাগুয়েও একটি ভালো মানের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। টাকা দিলে বাঘের চোখও মেলে – এই ফর্মূলায় সবই হয় সবই পাওয়া যায় তথা করা যায় সবকিছু প্যারাগুয়েতে। ৫-১০ ডলার সমপরিমাণ অর্থও যত্রতত্র ঘুষ খেয়ে অভ্যস্ত স্থানীয় পুলিশ। গাঁজা চাষের জন্য প্যারাগুয়ের খ্যাতি আছে লাতিন আমেরিকায়, যার বেশির ভাগ চালান হয় প্রতিবেশী ব্রাজিলে। হিউম্যান ট্র্যাফিকিংও জমজমাট। আদম ব্যবসায় বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশ ক’জন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন যথারীতি। অভিবাসী হিসেবে কোন রকমে দেশটিতে ঢুকতে পারলে ওয়ান-টু’র মধ্যে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে বৈধ হওয়া যায় এখানে। হাজার-পনেরশ’ ডলার খরচায় চুক্তিভিত্তিক বিবাহের জন্য মেয়ে পাওয়া পানির মতো সহজ প্যারাগুয়েতে।

কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ ছাড়াও ভিন্ন পথে বছরের যেকোনো সময় লিগ্যালিটি পাওয়া যায়, এক্ষেত্রে খরচ পড়ে ৮শ’ থেকে ১২শ’ ডলার। সর্বোচ্চ দুই হাজার ডলার পেমেন্ট করারও নজির আছে, তবে সবকিছুই নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। পুরো প্যারাগুয়েতে বর্তমানে প্রায় শ’খানেক বাংলাদেশি পরিবারের বসবাস। কোথাও কোনো সভা সমিতি সংগঠন তেমন প্রতিষ্ঠিত না হলেও বাংলাদেশি অধ্যুষিত প্রধান শহর ‘সিউদাদ দেল এস্তে’, যেখানে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ মিনার শোভিত সুপরিসর মসজিদ। ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশিদের অর্থায়নে কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদের প্রবেশমুখের শোভা বর্ধন করেছে বাংলাদেশ-প্যারাগুয়ে সৌহার্দের প্রতীক দু’দেশের জাতীয় পতাকা।

বিদেশ বিভুঁইয়ে দেশের কৃষ্টি সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি এমন উদ্যমী বাংলাদেশিরা এখানে ঘটা করে উদযাপন করতে শুরু করেছেন বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস, নাটকও মঞ্চায়ণ করারও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তারা প্যারাগুয়ের মাটিতে। প্রতিবেশী ব্রাজিলের মতো বিগ ভলিউমে না হলেও বাংলাদেশি গার্মেন্টস সামগ্রী চিলি হয়ে সীমিত পরিসরে আসছে এদেশে। প্যারাগুয়ের সয়াবিন তেলের কোয়ালিটি অনেক ভালো, প্রাইস আশাব্যঞ্জক হতে পারে বাংলাদেশের জন্য যদিও এই সেক্টরটি যথারীতি মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে। পুরো লাতিন আমেরিকায় আগামী দিনে ব্যাপক হারে বাংলাদেশিদের বসবাস শুরু হবে এটা যেমন সুনিশ্চিত, তেমনি প্যারাগুয়েতেও এক্ষেত্রে লাল-সবুজ পতাকা আরো পতপত করে উড়বে, হলফ করে তা এখনি বলে দেয়া যায়।

সূত্র: নতুনবার্তা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন