প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন: ঘূর্ণিঝড় “মোখা” ঝুঁকি বাড়িয়েছে
১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দ্বীপটিকে। ১২শ ঘর বাড়ি ভেঙ্গেছে। মাদ্রাসা মসজিদ ভেঙ্গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ পাড়া,গলাচিপা, উত্তর পাশের সমুদ্র সৈকত। অরক্ষিত হয়ে উঠে দ্বীপটি। সামান্য জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে দ্বীপের ভাংগন কবলিত এলাকা। জলোচ্ছ্বাস হলে রক্ষা পাওয়ার কোন ব্যবস্হায় কার্যকর নেই সৈকত এলাকায়। এতে দ্বীপের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় “মোখা” য় ক্ষতিগ্রস্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপের হাজারের অধিক ঘর-বাড়ি ভেঙ্গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কটেজ দোকানপাট। কয়েক হাজার গাছপালা উপড়ে গেছে। চারপাশের চর, সাগর পাড় ও সমুদ্র সৈকত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার কারণে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বাড়িয়েছে ঝুঁকি।
এমনিতে পর্যটন মৌসুমে দ্বীপে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকদের যাতায়াত, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশ দূষণ, পর্যটকদের অসচেতনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সেখানকার ইকো-সিস্টেম অর্থাৎ প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছিল। এতো কিছু বয়ে যাওয়ার পরও দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে পারেনি সরকার। এর পেছনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে দ্বীপ রক্ষায় কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এসব বিভিন্ন কারন ও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় দ্বীপের পরিবেশ ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে জানান স্থানীয় চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, “পরিকল্পিত পরিকল্পনার অভাব ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতার কারণে দ্বীপের চারপাশে পর্যটন বান্ধব ও টেকসই বেড়িবাঁধ তেরী হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে অতি জোয়ার, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি কারণে দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এবং জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। কোন কোন প্রজাতি এখন বিলুপ্ত হবার পথে।”
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, ‘মোখা’ পরবর্তী সময়ে সেন্টমার্টিনসহ উপকূলে সমুদ্র সৈকতের জন্য জিওটিউব এবং জিওব্যাগ দিয়ে এলাকায় ভাঙন অথবা পানি প্রবেশের রোধে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।” তবে গোটা সেন্টমার্টিনের চারপাশে টেকসই বেড়িবাঁধ দেওয়া বা অন্য কোন ব্যবস্হা নেওয়া উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মত বিষয়। “
গত ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দ্বীপটিকে। ১২শ ঘর বাড়ি ভেঙ্গেছে। মাদ্রাসা মসজিদ ভেঙ্গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ পাড়া,গলাচিপা, উত্তর পাশের সমুদ্র সৈকত। অরক্ষিত হয়ে উঠে দ্বীপটি। সামান্য জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে দ্বীপের ভাংগন কবলিত এলাকা। জলোচ্ছ্বাস হলে রক্ষা পাওয়ার কোন ব্যবস্হায় কার্যকর নেই সৈকত এলাকায়। এতে দ্বীপের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান সেন্টমার্টিন ঘুরে গেছেন। এই সময় স্থানীয়রা পর্যটন বান্ধব ও টেকসই বেড়িবাঁধ দেওয়ার দাবী করেন। তিনি এ বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর অবহিত করবেন বলে নিশ্চিত করেন। তাছাড়া মোখা পরবর্তী খাদ্য ও গৃহনির্মাণ সামগ্রী বিতরণ করার মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গুলোর পাশে থাকার সরকারি ঘোষণা বাস্তবায়ন শুরু করেন। সরকার সেন্টমার্টিনে চার ক্যাটাগরীতে ১৯’শ পরিবারকে নতুন গৃহ, গৃহ পুর্ননির্মাণ ও নগদ অর্থ প্রদান করে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেছেন বলেও জানান টেকনাফ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. এরফানুল হক চৌধুরী।
সেন্ট মার্টিনে যেকোনো ধরণের স্থাপনা গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করেই গড়ে উঠছে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল।
এছাড়া পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যত্রতত্র প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা, ভারী জেনারেটর, পাম্প পরিচালনা, পাথর তোলা, সৈকতের বালি অপসারণ, এক কথায় পরিবেশ বিধ্বংসী সব ধরণের কাজই হয় দ্বীপটিতে।
পরিবেশ অধিদফতর জানিয়েছে, অবৈধভাবে গড়ে উঠা সেন্টমার্টিনের এসব স্থাপনা উচ্ছেদে তারা কয়েক দফা অভিযানে গিয়ে দেখেছে যে বেশিরভাগই আদালতের থেকে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়ে পরিচালনা করছে।
এ কারণে অধিদফতরও কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না। অথচ জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে সরকার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা-ইসিএ ঘোষণা করেছিল।
পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রতিদিন যদি পর্যটকদের সংখ্যা সীমিত করে ১ হাজার বা ১২’শত জনের মধ্যে রাখা যায়, তাহলেও কিছুটা ভারসাম্য রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু সেখানে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন কমপক্ষে আট থেকে দশ হাজার পর্যটক ভিড় করছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার অফিসের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, “পর্যটন মৌসুমে একজন নির্বাহী ম্যাজেস্ট্র্যাট সেন্টমার্টিনে নিয়মিত অবস্থান করে এবং পরিবেশ রক্ষায় সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করে।”
পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা এই দ্বীপটির স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। এছাড়া পর্যটক মিলে প্রতিদিন দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষের চাপ নিয়ে এক প্রকার মৃতপ্রায় অবস্থা সেন্টমার্টিনের।
১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে পরিবেশ অধিদফতর
এমন অবস্থায় সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১৪টি বিধিনিষেধ দিয়ে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গত কয়েক মাসে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে পরিবেশ অধিদফতর।
দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বিরল জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারসহ দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী দ্বীপে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
শুধু আইন প্রয়োগ নয় বরং পর্যটকদের সচেতন করে তুলতে এ ধরণের প্রচারণাকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর।
এ বিষয়ে মৌসুমে কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান । তিনি বলেন, ” দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক রক্ষায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কাজ করছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ”
তিনি দ্বীপের ভাংগন রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত ভাবে অবহিত করেছেন বলেও জানান।
একটা সময় পর্যন্ত পর্যটন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার’ দাবি। তবে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই দ্বীপে পর্যটকদের চলাচল পুরোপুরি বন্ধ না করলে দ্বীপের পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না।
এমন দাবীর কথা বলেছেন টেকনাফ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ছৈয়দ হোছাইন। তিনি বলেন, “এই সময়ের মধ্যে সৈকত ও পানির নীচে যতো দূষণ হয়েছে সব পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়া দ্বীপের সব ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে হবে।”
বছরের একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে শুধুমাত্র দিনের বেলা সীমিত সংখ্যক পর্যটকদের যাতায়াত করতে দেয়া হলে দ্বীপটির পরিবেশের ভারসাম্য ও জীব-বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা যাবে।
এ কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে।
এ নিয়ে কয়েক দফা সেন্টমার্টিন দ্বীপ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হলেও একবারও তা কার্যকর হয়নি।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিদায়ী চেয়ারম্যান লে.কর্নেল( অব:) ফোরকান আহমেদ বলেন,” সেন্টমার্টিনকে মাস্টার প্ল্যান এ অন্তর্ভুক্ত করা, পর্যটক সীমিতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা অদৃশ্য কারনে বাস্তবায়ন করা যায় না। যার কারণে দ্বীপটি হুমকির মধ্যে রয়েছে এবং দূর্যোগের সময় অরক্ষিত বলা যায়। “
এছাড়া সেন্টমার্টিনের দক্ষিণেই ছেঁড়াদিয়া দ্বীপও রয়েছে পরিবেশগত হুমকির মুখে। এ কারণে সরকারি ওই বিজ্ঞপ্তিতে ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে কোন জলযানে যাতায়াত নিষেধ করা হয়েছে।
এই দ্বীপে রাতে থাকা না গেলেও কাঠের নৌকা এবং স্পিডবোটে করে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক সেদিকেও ছুটে যায় এবং পরিবেশ নোংরা হয়। এ কারণে দ্বীপটিতে এখনও যে কয়টা জীবিত প্রবাল টিকে আছে, সেগুলো ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এমন অবস্থায় দ্বীপটির জীবিত প্রবাল বা সামুদ্রিক জীব টিকিয়ে রাখতে একটি কর্ম পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।