বাঘাইছড়ি উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

fec-image

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদ এর বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি ও কর্মকর্তাদের সাথে অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছে।

টাকা ছাড়া কোনো ফাইলে হাত দেন না তিনি। খাতা কলমে শতকরা হিসাব ধরে ঘুষ আদায় করেন তিনি। ঘুষের টাকার হিসেব রাখতে বানিয়েছেন আলাদা রেজিস্ট্রার খাতা। সেটিও টেবিলের উপর সযত্নে রাখা। ঘুষ গ্রহণ যেন তার কাছে বৈধ পন্থা। কথামত ঘুষ না দিলে ফাইল আটকে হয়রানি, অসদাচরণ থেকে শুরু করে রুম থেকে বের করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

গত বছর ১৩ জুন বাঘাইছড়ি উপজেলায় হিসাব রক্ষণ কার্যালয়ে দায়িত্ব নিয়েই তিনি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগের উপজেলা কাপ্তাইয়ে একই অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতিবাজ এই হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদ বাঘাইছড়ি উপজেলায় দায়িত্ব নিয়েই নানা অজুহাতে পেনশেন ভোগী কর্মকর্তা কর্মচারী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী, এসিল্যান্ড অফিস, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সমাজ সেবা কার্যালয়, মৎস কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, প্রধানমন্ত্রীর দুর্যোগ সহনীয় ঘর তৈরি প্রকল্পসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথেও বিল পাসে ঘুষ নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়েছেন ।

কথায় কথায় জেলা ও বিভাগীয় হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়েও মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করেন। বাঘাইছড়ি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মৃত একজন কর্মচারী তসলিম উদ্দিনের পেনশনের টাকা থেকেও ৩ লক্ষ টাকা ঘুষ নেয়ার তথ্য অভিযোগ রয়েছে।

মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, আমাদের বৈধ পে-স্কেলে বেতন নির্ধারণের জন্য সে নানান হয়রানি করে আমার অফিসের তিন জন স্টাফের কাছে ৩০ হাজার এবং আমার কাছ থেকে ১০ হাজার মোট ৪০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে নতুন পে-স্কেলে নিজ হাতে বেতন নির্ধারণ করে দেয়। একমাস বেতন ভাতা তোলার পর আবার বেতন বন্ধ করে রাখে। বেতন বন্ধের কারণ জানতে চাইলে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদ জানায় তার বিভাগীয় কর্মকর্তা আপাতত বন্ধ রাখতে বলেছেন।

তিনি আরো বলেন, পর তিনমাস বেতন বন্ধ রাখার পর অনেক হয়রানি করে সি,জি,এ থেকে চিঠি মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করেছি সব ঠিক ঠাক হয়ে বেতনের চিঠি আসলে আবার নতুন করে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। বেতন থেকে আর এক টাকাও ঘুষ দিতে পারবো না বলায় তিনি বলেন, আপনি একসাথে অনেক টাকা বকেয়া পাবেন, পেনশনে বেশি টাকা পাবেন আচ্ছা এখন আপাতত ৮০ হাজার টাকা দেন। সামনে ঈদ তিন মাস বেতন বন্ধ তাই ১০ হাজার টাকা দিয়ে অনেক আকুতি করে বেতন উত্তলন করি।

এমাসে আবার টাকার জন্য চাপ দেয় আর কোন টাকা দিতে পারবোনা বলায় সে দম্ভ করে বলে আপনার ৬ মাসের বেতন বন্ধ করে দিবো। এই বলে আমাকে আবার পূর্বের পে-স্কেলে নামিয়ে দেয় । প্রতিনিয়ত আমার সাথে অসদাচরণ করে বেতন কমিয়ে হয়রানি করছে। বিষয়টি আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম স্যারকে জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছি এখনো পাইনি।

উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি (এসিল্যান্ড) মংশিনু মারমা বলেন, আমার চাকরি জীবনে এমন হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা দেখিনি তার ভাবখানা এমন যে তিনিই আমাদের বেতন দেন। গত তিন মাস ধরে মিথ্যা বলে আমার এল,পি,সি আটকে রেখে আমাকে হয়রানি করছ। বেতনের টাকায় আমাদের সংসার চলে তিনমাস ধরে আমি বেতন তুলতে পারছি না। আমার অফিস সহকারী তাজুল ইসলামের সাথেও সে খারাপ আচরণ করছে। বিষয়টি আমার নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম স্যারকে অভিযোগ আকারে জানিয়েছি।

উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা জয়াস চাকমা বলেন, হিসাব রক্ষণ কর্মকতা প্রতিটি বিলের জন্য শতকরা পাঁচ থেকে দশ টাকা হারে ঘুষ দাবি করেন চাহিদা মত টাকা না দিলে সব বিল বরাদ্দ আটকে রেখে হয়রানি করেন। হিসাব কষে দশ টাকা সহ তাকে দিতে হয়। পেনশন ভাতা ভোগীদের কাছ থেকেও প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা কেটে রাখে। আমরা অতিদ্রুত ওনার অপসারণ দাবি করছি।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নব আলো চাকমা বলেন, আমার ২৭ বছরের চাকরি জীবনে এমন কর্মকর্তা দেখিনি। সব ধরনের বিল থেকে ৫-১০ পার্সেন্ট ঘুষ দিতে হয়, ঘুষ না দিলে ৬ মাস বেতন বন্ধ রাখার হুমকি দেন, আমরা অবিলম্বে তার অপসারণ চাই। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জয়নাল আবেদীন বলেন বড় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদ এর দ্বারা সবচেয়ে বেশি হয়রানি হতে হয় আমাকে ঘুষের টাকা ছাড়া ওনার সাথে কোন কথাই বলা যায়না। আমার প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি খুব বাজে ব্যাবহার করেন। শিক্ষকরা প্রায়ই আমাকে অভিযোগ দেন। ফাইল আটকে হয়রানি করেন এমন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা আগে দেখিনি দ্রুত ওনার অপসারণ দাবি করছি।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতা সহকারী শিক্ষক মো. বাবুল মিঞা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি মাসেই তিনি হয়রানি করেন। উপজেলায় তিনশত পেনশনার শিক্ষক আছেন প্রতিমাসের তাদের কাছ থেকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কেটে রাখেন, জিপিএফ ফান্ড থেকে লোন নিতে তাকে প্রতিলাখে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। না হলে লোন অনুমোদন হয় না। সরকার শিক্ষকদের ১৩ম গ্রেড ঘোষণা করেছেন সেই গ্রেড লাগাতে শিক্ষকদের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, ইওএনডিপি পরিচালিত ২২ টি বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে সরকার সেই বিদ্যালয়ের প্রতিজন শিক্ষক থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছেন তিনি। ৮৭ জন শিক্ষকের বকেয়া বেতন ভাতা ১২ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা থেকে ২০ পার্সেন্ট হারে মোট আড়াই কোটি টাকা তিনি ঘুষ দাবি করেন এবং সেই টাকা থেকে ৭০ পার্সেন্ট জেলা ও বিভাগীয় অফিসে দিতে হবে বলেন। এতোদিন যেই শিক্ষকরা না খেয়ে পাঠদান চালিয়ে গেছেন তাদের টাকা থেকে কিভাবে এতো টাকা তিনি ঘুষ দাবি করেন এটা নিয়ে ওনার সাথে শিক্ষকদের কথা-কাটাকাটি হয়েছে সেই ভিডিও আমাদের হাতে রয়েছে।

উপজেলা আওয়ামিলীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন মামুন বলেন, সবধরনের বিলের আগে ওনাকে এক পার্সেন্ট পিসি দিতে হয় না হলে বিল পাস হয়না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চরম হয়রানি করেন তিনি তার বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলন গড়ে তুলা হবে।

বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান সুদর্সন চাকমা বলেন, বাঘাইছড়ি উপজেলায় হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাই নয় এমন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আরো আছে উপজেলা পরিষদ আইনের দূর্বলতার কারণে এসব অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তবে শীঘ্রই এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাঘাইছড়ির সচেতন মহল জেগে উঠবে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে তাদের উপজেলায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করবে।

এ বিষয়ে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, তার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযোগ পাচ্ছি, আমি নিজেও ভুক্তভোগী, সে ঠিকমত অফিস করেন না, মানুষকে হয়রানি করে লিখিত অভিযোগ পেলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অভিযুক্ত হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পেয়ার মোহাম্মদের কাছে বিষয়টি জানতে গেলে তিনি সংবাদ প্রচার না করতে অনুরোধ করেন। বাঘাইছড়ি কি ভালো জায়গা নাকি, এখানে থাকার আর ইচ্ছে নাই এক মাসের মধ্যে বদলি হয়ে যাবেন। এ বিষয়ে জেলা ও বিভাগীয় হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার মুঠোফোনে একাধিক বার ফোন দিয়েও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: দুর্নীতি, বাঘাইছড়ি, হিসাবরক্ষণ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন