বান্দরবান পরিস্থিতি, আরাকান আর্মি এবং সেনা অভিযান

11891139_482937901874273_6982389210507474311_n

গোলাম মোর্তোজা

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় যা ঘটে, তার পুরোটা ঢাকা পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। বান্দরবানের ঘটনার ক্ষেত্রেও সম্ভবত তেমনটাই ঘটছে। বান্দরবানের এই এলাকাগুলোতে অনেকবার গিয়েছি। মোটামোটি একটা স্বচ্ছ ধারণা আছে এলাকা সম্পর্কে।

মায়ানমারের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠন ‘আরাকান আর্মি ‘। বান্দরবানের যে অঞ্চলটিতে তাদের বিচরণ, সেটা বড় বড় পাহাড় এবং গহীন জঙ্গল। জায়গাটির নাম ‘ লাতাইন ‘। এতটাই জঙ্গল যে দিনের বেলাতেও কিছু এলাকা অন্ধকার থাকে। দেখা না থাকলে ঢাকায় বসে ধারণা করা বেশ কঠিন। এই অঞ্চলের সবচেয়ে কাছে বড় মোদকে যে বিজিবি ক্যাম্প আছে, তার থেকে আরাকান আর্মির বিচরণ ক্ষেত্র প্রায় 20 – 30 কিলোমিটার দূরে। এই দুরত্ব আরও বেশিও হতে পারে। এসব দুরত্ব স্থানীয়দের অনুমানভিত্তিক। কোনো রাস্তা নেই, পাহাড় -জঙ্গল পেরিয়ে যাওয়াটা শুধু ভয়ঙ্কর কষ্টের নয়, আতঙ্কেরও।

লাতাইন মায়ানমার সীমান্ত থেকে তিন চার দিনের দুরত্ব। ভারত সীমান্ত থেকে কিছুটা কাছে।

আরাকান আর্মি তাদের অস্ত্র এবং মালামাল পরিবহনের জন্যে ভারত থেকে 10 টি বৃহৎ আকারের ঘোড়া নিয়ে আসছিল। ভারত সীমান্ত পাড় হয়ে থানছি সদর থেকে নৌকায় ঘোড়াগুলো বড় মোদক হয়ে লাতাইন নিয়ে যাচ্ছিল। বিজিবি বলেছে থানছি ক্যাম্পের কাছে ঘোড়াগুলো আটক করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য থানছি সদর থেকে তারা ছয়টি ঘোড়া নৌকায় তুলে বড় মোদকের দিকে নিয়ে যেতে দেখেছেন। থানছি সদর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বড় মোদক পর্যন্ত যেতে সারাদিন লেগে যায়। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী 6 টি ঘোড়া আটক করা হয়েছে বড় মোদকে, 4 টি আটক করা হয়েছে থানছিতে। বড় মোদকে আটক ঘোড়ার দু ‘টিকে পাঁ বেধে নৌকায় করে থানছিতে আনার সময় নৌকা ডুবে যায় এবং ঘোড়া দু ‘টি মারা যায়। বাকি 4 টি ঘোড়া থানছিতে আনা হয়েছে কিনা নিশ্চিত তথ্য জানা যায় নি।

11947572_482937921874271_1700445125619170144_n

এই ঘোড়া আটকের পর আরাকান আর্মির এক দের ‘শ সদস্যের কয়েকটি দল থানছি ক্যাম্প ঘিরে গুলি বর্ষণ শুরু করে। যদিও বিজিবি বলেছে, টহল দলের উপর আক্রমণ করেছে। স্থানীয়দের ভাষ্য ক্যাম্প আক্রমণ করেছে হতাহতের উদ্দেশ্যে নয়, ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে। বিজিবি গুলি বর্ষণ করে জবাব দিয়েছে। আরাকান আর্মির দলগুলো আবার লাতাইন অঞ্চলের দিকে চলে গেছে। এরপর বিজিবি শক্তি বৃদ্ধি করেছে। হেলিকপ্টারে করে তাদের বড় মোদকে নেয়া হয়েছে। আলি কদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীকেও হেলিকপ্টারে বড় মোদকে নেয়া হয়েছে। বড় মোদকের আশেপাশে ছোটখাটো কিছু অভিযান চালিয়েছে বিজিবি -সেনাবাহিনী। আরাকান আর্মি এই এলাকায় অবস্থান করছে না।

বিভিন্ন সুত্রের খবর অনুযায়ী আরাকান আর্মির সদস্য সংখ্যা 5 শতাধিক এবং তাদের সংগ্রহে ভারি -আধুনিক অস্ত্র আছে। তারা মায়ানমার সীমান্তে কখনও কখনও ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করে। দু ‘একজন মায়ানমার বর্ডার গার্ড বা সেনা সদস্যদের মাঝেমধ্যে অপহরণ করে নিয়ে আসে। কয়েক দিন আগে মায়ানমারের দুইজন সেনা সদস্যকে জঙ্গলে পেয়েছিল বিজিবি। কিভাবে বিজিবি তাদের পেয়েছিল, এলাকায় ভিন্ন গল্প আছে। আরাকান আর্মি তাদের 2015 সালের ক্যালেন্ডারে বিমান বিধ্বংসী কামানের ছবি প্রকাশ করেছে। বিমান বিধ্বংসী কামান তাদের সংগ্রহে আছে বলে দাবি করেছে।

11880623_482937938540936_1581618999768422228_n

বিজিবি-সেনাবাহিনী সম্মিলিতভাবে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বিজিবি।
যদি এমন অভিযান চালানো হয়, তবে আরাকান আর্মি মায়ানমারে ঢুকতে পারবে না। মায়ানমার বর্ডার গার্ড এবং সেনাবাহিনী তাদের ভেতরে ঢুকতে দেবে না। স্থানীয় সূত্র বলছে, ভারতও তাদের সীমান্ত অতিক্রম করতে দেবে না।
তাহলে তারা করবে কি?
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী -বিজিবি’র সঙ্গে যুদ্ধ করে এলাকায় অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করা ছাড়া তাদের আর কোনো অপশন থাকবে না।
এখন আরাকান আর্মিকে যদি ধ্বংস বা গ্রেপ্তার বা ছিন্ন -বিছিন্ন করে দিতে হয়,তবে বেশ বড় একটি যুদ্ধ করতে হবে। এবং সেটা কয়েক শ ‘ বিজিবি -সেনাবাহিনী নয়, সংখ্যা কয়েক হাজার হতে হবে।
যুদ্ধের ক্ষেত্রে আরাকান আর্মির সুবিধা হলো, অনেক বেশি মরিয়া থাকবে, কারণ আর কোনো অপশন নেই তাদের। জঙ্গল তুলনামূলকভাবে তাদের কাছে আমাদের বিজিবি -সেনাবাহিনীর চেয়ে ভালো পরিচিত। স্থানীয় জনমানুষের সমর্থনও তাদের একটা শক্তি। আরাকান আর্মির আয়ের উৎস খুবই রহস্যজনক। আগে এই এলাকায় পপি চাষ হতো, এখন হয় না। চাঁদাবাজিও তারা করেনা বলে স্থানীয়রা জানায়। আরাকান আর্মির হাতে অনেক অর্থ, স্থানীয়রাও তাদের দ্বারা উপকৃত হয়। আমেরিকা সাহায্য দেয় -বিষয়ক গল্প প্রচলিত আছে এলাকায়। কিন্তু তাদের অর্থের উৎস বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়।
তবে তাদের অর্থ -অস্ত্র যাই থাকুক না কেন, কোনো অবস্থাতেই তা আমাদের বিজিবি -সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি নয়, শক্তি বেশি হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তবে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে হবে। সেই যুদ্ধটি করতে হবে গহীন পাহাড় -জঙ্গলে স্থল পথে। আকাশ পথে হেলিকপ্টারে বড় মোদক পর্যন্ত যাওয়া যাবে। কিন্তু লাতাইন অঞ্চলের গভীর জঙ্গলে হেলিকপ্টার থেকে কোনো সুবিধা পাওয়া যাবে না। তাদের কাছে বিমান বিধ্বংসী কামান থাকায় বিপদ বাড়তে পারে। সুতরাং স্থল পথে সর্বশক্তি এবং ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েই আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। এই অভিযানে আরাকান আর্মিকে পরাজিত করার শক্তি -কৌশল নিশ্চয়ই আমাদের বিজিবি -সেনাবাহিনীর জানা আছে,সামর্থ্যও আছে।

স্থায়ীভাবে আরাকান আর্মি বা বিচ্ছিন্নতাবাদি নানা গ্রুপের তৎপরতা মুক্ত থাকার জন্যে পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করে পাহাড়িদের আস্থা অর্জন করা দরকার। সীমান্ত এলাকায় রাস্তার উন্নয়ন করা জরুরি। মায়ানমার -ভারত তাদের সীমান্তে রাস্তা তৈরি করেছে। গাড়ি নিয়ে তারা সীমান্ত পাহাড়া দেয়। বাংলাদেশ অংশে পাকা রাস্তা তো দুরের কথা, কাঁচা রাস্তারও কোনো অস্তিত্ব নেই। বিজিবি ক্যাম্প থেকে একটি সীমান্ত পিলারে হেঁটে যেতে দুই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগে। এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দুরত্ব চার থেকে পাঁচ ঘন্টার। ক্যাম্প থেকে বিজিবি সদস্যরা একটি পিলারে গিয়ে বিপদে পড়লে, তাদের কাছে সাহায্য পৌঁছাতেও কম পক্ষে দুই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগে। রাতে চলাচল করা যায় না, দিনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। আবহাওয়া খারাপ হলে দিনে চলাচল করাও কষ্টকর।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ছয়টি ক্যান্টনমেন্টের শক্তি আরও বৃদ্ধি করা দরকার। সেনা বা বিজিবি ক্যাম্পের সংখ্যা কমিয়ে সীমান্ত এলাকায় পৌঁছানো এবং টহল দেয়ার রাস্তা তৈরি করা জরুরি। তাহলে চুক্তির শর্তও রক্ষা হয়, সীমান্তও নিরাপদ থাকে। সীমান্ত পাড় হয়ে আসা -যাওয়া ঠেকানো গেলে, নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হয়।

ছবি :আরাকান আর্মির ক্যালেন্ডার থেকে সংগৃহীত।

বি.দ্র: কিছু লিখেছি,কিছু লিখিনি | যেভাবে লিখলে বাস্তবতা বোঝানো সহজ হত,সেভাবে লিখিনি | কেন লিখিনি তা লিখছি না | সবাই না হলেও কেউ কেউ নিশ্চয়ই তা বুঝে নেবেন | শুধু একটি কথা বলি, আরাকান আর্মি শক্তিশালী হচ্ছে,বাংলাদেশের ভেতরে থেকে বাংলাদেশকে আক্রমণ করছে ! কি করে এত সাহস হয় ? আমাদের নীতি কৌশল নিয়ে নীতি নির্ধারকদের ভাবা দরকার|

(বর্তমান লেখাটি সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তজার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে হুবহু নেয়া। মুক্তমতে প্রকাশিত মতামতের সাথে পার্বত্যনিউজের সম্পাদকীয় নীতিমালা প্রযোজ্য নহে। )

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “বান্দরবান পরিস্থিতি, আরাকান আর্মি এবং সেনা অভিযান”

  1. পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করলে তো আরাকান আর্মিকে প্রতিহত করা যাবেনা,আমি মনে করি উল্টো আরো তাদের শক্ত ঘাটি হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম। তাই এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সেনাবাহিনীরর প্রতি আস্থা রাখুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন