বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-হেফাজত সংঘর্ষে নিহত ২৫, আহত কয়েকশত

 

 ডেস্ক নিউজ, ঢাকা

রবিবার মধ্য রাতে মতিঝিলে হেফাজত কর্মীদের উপর সরকার পরিচালিত অভিযানে হতাহতের ঘটনায় সোমবার দেশের বিভিন্ন স্থানে হেপাজত কর্মীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয়েছে। এ ঘটনায় ২৫ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে পুলিশ ও বিজিবির সদস্যও রয়েছেন।

সিদ্ধিরগঞ্জে  হেফাজতের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশ-বিজিবিসহ নিহত ১৫

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের কাঁচপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়, শিমরাইলসহ বিভিন্ন পয়েন্টে র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবি সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে দুই পুলিশ ও তিন বিজিবি সদস্যসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় প্রায় অর্ধশত গুলিবিদ্ধ, সাংবাদিকসহ দুই শতাধিক আহত হয়েছেন।

কাঁচপুর পুলিশ ফাঁড়ি, সিদ্ধিরগঞ্জে বিদ্যুৎ অফিস, চ্যানেল আইয়ের গাড়ি, পুলিশের বেশ কয়েকটি পিকআপ, মোটরসাইকেল, ও কয়েকটি পরিবহণে অগ্নিসংযোগ করে হেফাজতের লোকজন।

সংঘর্ষ সাইনবোর্ড হতে কাঁচপুর পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েক হাজার রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে।

নিহতরা হলেন- বিজিবি সদস্য সুবেদার শাজাহান, লাভলু, শাহ আলম, পুলিশের নায়েক ফিরোজ, কনস্টেবল জাকারিয়া, শ্রমিক সাইফুল, বাবু গাজী, হান্নান মিয়া, জুয়েল, মাসুম, গফুর, বাদল, সিএনজি চালক জসিম উদ্দিন, ছাত্রলীগ কর্মী পলাশ। আহতদের স্থানীয় কিনিক  ও নগরের খানপুর ২০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়ায় হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীরা সোমবার ভোররাতে যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়, শিমরাইল, কাঁচপুর এলাকার পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মাদ্রাসায়  আশ্রয় নেয়। পরে সকাল পাঁচটার দিকে হেফাজতের কর্মীরা মাদ্রাসার ভেতরে সংগঠিত হলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। এ সময় হেফাজতের কর্মীরা মাদ্রাসার মাইকে ঘোষণা দিয়ে অন্যান্য মাদ্রাসা থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানালে হেফাজতের কর্মীরা সংগঠিত হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। ভোর পাঁচটায় প্রথমে কাঁচপুর পুলিশ ফাঁড়িতে এবং সাতটায় শিমরাইল পুলিশ বক্সে হামলা চালায়। এ সময় বিজিবি একটি গাড়ি পুলিশের দুটি ভ্যান ও একটি তেলবাহী ট্যাংক লরিতে অগ্নিসংযোগ করে হেফাজতের কর্মীরা।

সংঘর্ষের একপর্যায়ে হেফাজত ইসলামের কর্মীরা ঢাকা-চট্রগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কয়েক পয়েন্টে অবরোধ সৃষ্টি করলে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কয়েক শ’ রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ারসেল ছোড়ে।

সংঘর্ষের সময় বিজিবি সদস্য সুবেদার শাজাহান, পুলিশের নায়েক ফিরোজ, কনস্টেবল জাকারিয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং গাড়ি চালক বাবু গাজী, গার্মেন্টস কর্মী জুয়েল,সাইফুল ইসলাম মাসুম, হান্নান ও পরিবহণকর্মী জসিম উদ্দিন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে মারা যায়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গুলিতে হেফাজতের শতাধিক কর্মী আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

হাটহাজারীতে পুলিশ-হেফাজত সংঘর্ষে নিহত ৮, আহত অর্ধশতাধিক

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে স্থানীয় জনগণ ও মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। এতে ৮ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। এখনো সংঘর্ষ চলছে। তবে তাৎক্ষাণিকভাবে নিহতদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
জানা যায়, সোমবার বিকেলে আল্লামা শফীর গ্রেপ্তারের খবর শুনে মাদ্রাসার ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে সড়ক অবরোধ করে।
এরপর মিছিল নিয়ে হাটহাজারী থানা দিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি ছুঁড়লে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে এলাকাবাসী যোগ দেয়।

বাগেরহাটে পুলিশ হেফাজত সংঘর্ষে নিহত ২

ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনার পর বাগেরহাটের মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে সোমবার দুপুরে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে দুই হেফাজত কর্মী নিহত হয়েছেন। পুলিশ-সাংবাদিকসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।

নিহতরা হলেন- ফকিরহাট উপজেলার পিলজংগ গ্রামের মশিউদ্দিন মোড়লের ছেলে শহিদ মোড়ল ( ৪২)। অপরজনের নাম হাফিজ (৪৫)। তবে পিতার নাম জানা যায়নি।

দফায় দফায় সংঘর্ষে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলামসহ ৭ পুলিশ সদস্য, ২ সাংবাদিক ও ২০ জন হেফাজত কর্মী গুরুতর আহত হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দুজন মারা যান।

প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানান, বাগেরহাটের কাটাখালী জিরো পয়েন্টে, চুলকাঠি বাজার ও শুকদাড়া নামক স্থানে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা মহাসড়কে ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থান নেয়। ফলে খুলনা-মংলা ও খুলনা-বাগেরহাটের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সময়ে পুলিশ ব্যারিকেট তুলতে গেলে সেখানে সংঘর্ষ হয়।

পরে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ এ সময়ে বেশ কয়েক রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এতে পুলিশ-সাংবাদিকসহ ২৭ জন আহত হয়।

 

সাঁড়াশি অভিযানে ফাঁকা মতিঝিল

টানা অবস্থানের ঘোষণা দেয়া হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের মধ্যরাতে ১৫ মিনিটের সাঁড়াশি অভিযানে মতিঝিল থেকে উৎখাত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

রোববার দিনভর সংঘাতে কয়েকজন নিহত হওয়ার পর সোমবার ভোররাতে মতিঝিলে অভিযান শুরু করে র‌্যাব ও পুলিশ, তার আগেই ওই এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন করা হয়।

কাঁদানে গ্যাস ও রবার বুলেটে টিকতে না পেরে বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়েন মতিঝিলে অবস্থানকারীরা। এদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীর কর্মী বলে পুলিশের দাবি।

রোববার মতিঝিলে হেফাজতের সমাবেশ চলাকালে পল্টন-গুলিস্তান, কাকরাইল, বিজয়নগরজুড়ে দফায় দফায় সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যু হয়।

রাতে অভিযানের পর জনতা পাঁচজন এবং পুলিশ দুইজনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন বলে হাসপাতাল ফাঁড়ির পরিদর্শক মোজাম্মেল হক জানান। নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক ছাত্র রয়েছেন।

নিহত একেএম রেহান হাসান (২২) বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র এবং তিনি আহসানউল্লাহ হলে থাকতেন বলে তার স্বজনরা জানিয়েছেন।

এছাড়া ভোরে রাজারবাগ এলাকায় মো. শাজাহান নামের এক পুলিশ উপ পরিদর্শককে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। হাসপাতালে নেয়ার পথেই মৃত্যু হয় তার।   

রাত আড়াইটায় সাঁড়াশি অভিযান শুরুর আগে থেকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক জানান, পুরো অভিযানে আহতের সংখ্যা শতাধিক। বেশ কয়েকজনকে আটক করে রাতে শাপলা চত্বরে বসিয়ে রাখতেও দেখা যায়।

তবে পুলিশের রবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেডে টিকতে না পেরে হেফাজতকর্মীদের মধ্যে যারা বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের পুলিশ আটক না করে পালানোর সুযোগ দেয়।

এ রকম অনেককেই মাথার ওপর হাত তুলে নটরডেম কলেজের দিকে দৌঁড়ে যেতে দেখা যায়। তবে অভিযানের মুখে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হেফাজতকর্মী পালিয়ে যান টিকাটুলির দিক দিয়ে।

 

মতিঝিল অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি

মতিঝিলের অভিযানে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই সংখ্যা সহস্রাধিক বললেও পুলিশ ও হেফাজত কোনো তরফ থেকেই কিছু বলা হচ্ছেনা পরিস্কার করে। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমই এই সংখ্যা বিশের মধ্যে বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সংস্থাগুলোর দেয়া মৃতের সংখ্যায় প্রচুর গড়মিল রয়েছে। ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। রবিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত দুদিনের সংঘর্ষে বার্তাসংস্থা এএফপি ২২ জন নিহতের খবর দিয়েছে।

টাইমস অফ ইন্ডিয়ার খবরে এই সংখ্যা ২৮ দাবি করা হয়েছে। আল-জাজিরা অনলাইনের খবরে ১৪ জন নিহতের কথা বলে হলেও বিবিসি’র খবরে দাবি ৫ জন। সিএনএন খবর দিয়েছে ১৪ জন নিহতের। আর নিউ ইয়র্ক টাইসের খবরে এই সংখ্যা ১৫ জন। তবে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ইন্টারনেটের সূত্রে এই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ২৫০০ বেশী বলে উল্লেখ করেছে।

 

 

 

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন