বিশ্বব্যাংকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ এসএনসি-লাভালিন

  ডেস্ক নিউজ

 বহুল আলোচিত পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যখন দৃশ্যত কিছুটা ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করেছে, ঠিক তখনই অভিযোগটি প্রমাণিত হওয়ার কথা জানিয়ে কানাডার বৃহত্তম নির্মাণ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে বিশ্বব্যাংক। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি পদ্মাসেতুতে তো নয়ই, এমনকি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নপুষ্ট কোনো প্রকল্পেই আগামী ১০ বছর কাজ করার সুযোগ পাবে না। একইসঙ্গে এসএনসি-লাভালিনের অধীনস্থ (এফিলিয়েটেড) আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠানকেও নিষিদ্ধ করেছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ সময় বুধবার মধ্যরাতের পর বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেয়া এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়।

কানাডার ‘দ্য গ্লোব এ্যান্ড মেইল’ পত্রিকা জানায়, বাংলাদেশের পদ্মাসেতু প্রকল্পে ঘুষ-দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ স্বীকার করে নেয়ার পরই এসএনসি-লাভালিনকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে বিশ্বব্যাংক। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার আগাগোড়াই পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ জোরালোভাবে অস্বীকার করে এসেছে। এদিকে পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে কানাডার আদালতে দায়েরকৃত মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষ হচ্ছে আজ শুক্রবার। এরপর মামলার ভবিষ্যতের বিষয়ে যে কোনো দিন আদেশ দেবে আদালত।

পদ্মাসেতু প্রকল্পের ‘নির্মাণ তদারকি পরামর্শক’ নিয়োগকে ঘিরে এসএনসি-লাভালিন ও বাংলাদেশের কতিপয় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির মধ্যে ঘুষ লেনদেনের প্রক্রিয়ার উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে – এমন অভিযোগ তুলেই বিশ্বব্যাংক ইতিপূর্বে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন বাতিল করেছে। মোট ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার প্রাক্কলিত ব্যয়ের এই প্রকল্পে অর্থায়নকারী গ্রুপের নেতৃত্বে থাকা বিশ্বব্যাংকের দেয়ার কথা ছিল ১২০ কোটি ডলার। কিন্তু তারা ঋণচুক্তি বাতিল করার পর অন্য অর্থায়নকারীরাও পিছিয়ে গেছে। ফলে জাতীয়ভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদ্মাসেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে মারাত্মক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পটিতে পরামর্শক নিয়োগের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশি কর্তাব্যক্তিদেরকে ঘুষ প্রদানের অভিযোগে কানাডার একটি আদালতে বর্তমানে এসএনসি-লাভালিনের দু’জন সাবেক কর্মকর্তার বিচার চলছে। এরা হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক ইসমাইল মোহাম্মদ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক রমেশ সাহা। তাদের ব্যক্তিগত ল্যাপটপ ও ডায়েরিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আলামত এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র জব্দ করে ইতিমধ্যেই আদালতে উপস্থাপন করেছে কানাডার পুলিশ। এরমধ্যে রমেশ সাহার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে পাওয়া গেছে ঘুষের টাকার নানা হিসাব-নিকাশ। ওই ডায়েরির বরাতে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে একাধিক খবর প্রকাশিত হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে যে, পদ্মাসেতু প্রকল্পে পরামর্শক খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ১০ শতাংশ অর্থ ঘুষ বাবদ বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে বন্টনের বিষয়ে পরিষ্কার নোট রয়েছে রমেশ সাহার ডায়েরীতে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে ১ শতাংশ, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ৪ শতাংশ, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারকে ২ শতাংশ, আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ভাই মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী ২ শতাংশ এবং সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে ১ শতাংশ অর্থ প্রদানের কথা উল্লেখ রয়েছে। রমেশ সাহার এই ডায়েরির ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক ২৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলেও সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়।

বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটের বিবৃতিতে বলা হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে এসএনসি-লাভালিন গ্রুপের ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে ১০ বছরের জন্য বিশ্বব্যাংকের সব ধরনের কাজে নিষিদ্ধ করা হলো। এছাড়া পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্ত কাজ চলার সময়ই কম্বোডিয়ায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চলমান অপর এক প্রকল্পেও এসএনসি-লাভালিনের দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। তবে একই বিবৃতিতে বলা হয় যে, নিষিদ্ধ হওয়ার পর এসএনসি-লাভালিন যদি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তাদের স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রের সকল শর্ত ঠিকমতো মেনে চলে, তাহলে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা দুই বছর কমিয়ে ৮ বছর করা হতে পারে। চুক্তি অনুযায়ী এসএনসি-লাভালিন এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠাগুলো বিশ্ব ব্যাংকের সব অভ্যন্তরীণ কাজে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংকের সততা বা ইন্টিগ্রিটি বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্ড ম্যাককার্থি বলেছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুর্নীতির প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এটি একটি যৌথ উদ্যোগ। এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে আমরা যখন দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছি, তখনই আমরা এ বিষয়ে কানাডীয় পুলিশের সহায়তা চেয়েছি। আমরা আশা করছি চুক্তি অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতারক ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন