ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের অবলুপ্তির কারণ

ড. হাবিব সিদ্দিকী

ashoka

চিত্র ১ – সম্রাট অশোকের প্রতিকৃতি। লক্ষাধিক নিহতের কলিঙ্গের যুদ্ধের পরে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে অনুতপ্ত সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।

মুসলিমদের উপমহাদেশে আবির্ভাবের আগে থেকেই বৌদ্ধরা ক্ষমতাশালী হিন্দুদের প্রতাপে ছিলেন একেবারে কোণঠাসা। এমনকি গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুস্থান বিহারের প্রতিবেশী বাংলাতেও হিন্দু ব্রাহ্মণ, শাসক ও নেতারা সাধারণ জনগণকে বশীভূত করে ফেলতে পেরেছিলেন। আসলে ইসলাম না এলে বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দুদের দ্বারা ভারতবর্ষ থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্নই হয়ে যেত। অন্ধ বৌদ্ধবাদের সমর্থকদের উচিত উইরাথুদের মত উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের বিক্রি করা বিষাক্ত ঘৃণার বড়ি না গিলে এ বিষয়ে নির্মোহ বিশ্লেষকদের লেখাগুলো পড়ে দেখা – যদি তাতে অবিচক্ষণ মুর্খতা ও ঘৃণ্য মুসলিম বিদ্বেষ কিছুটা হলেও কমে। আদতে প্রচলিত ইসলামবৈরী গল্পকথার বিপরীতে এটাই সত্য যে, বখতিয়ারের অশ্বারোহীরা যখন হিন্দু রাজাদের পরাভূত করেন তখন স্থানীয় বৌদ্ধরা মুসলিমদেরকে বর্ণবাদী হিন্দুদের নিপীড়ন থেকে তাদের উদ্ধারকর্তা হিসেবেই দেখেছেন।

যদিও গৌতম বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন, তবুও প্রাচীন ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাযজ্ঞের পরে হিন্দু রাজা অশোকের ২৩৬ পূর্বাব্দে বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হবার আগ পর্যন্ত বৌদ্ধদের ভরতবর্ষের রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো রকম প্রভাব ছিলনা বললেই চলে। অশোকের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্ম পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তবে স্বভাবতই এমন আনুকূল্য বেশিদিন টিকেনি, আর শক্তিশালী গুপ্ত সাম্রাজ্যের আমল থেকে শাসনযন্ত্র ধীরলয়ে হিন্দুত্বের প্রভাবে ফিরে যায়। স্থানীয় রাজারা তখন থেকে বৌদ্ধ ধর্মের চেয়ে হিন্দু ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে – আর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চেয়ে হিন্দু ব্রাহ্মণদের সাথে মিত্রতা গড়ে তোলার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে থাকে। প্রান্তিক জনতার মধ্যে থেকে দলিত নিম্নবর্ণের লোকজন– যারা আগে বৌদ্ধ ধর্মের জাতপ্রথার বিরুদ্ধ বাণীতে আকৃষ্ট হয়েছিল– তারাও পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক কারণে সনাতন ধর্মে ফিরে যেতে শুরু করে। পঞ্চম শতাব্দির চীনা বৌদ্ধ পরিব্রাজক ও তীর্থযাত্রী ফেক্সিয়ান ভারত সফরের সময় স্থানীয় মহায়ন বৌদ্ধ-তত্ত্বে মৌলিক দুর্বলতা দেখতে পান। সেখানে অনেক ঈশ্বররূপী বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বরা মহাবিশ্বের অগণিত স্তরগুলোতে বসবাসরত – ওই বৌদ্ধ তত্ত্ব হিন্দু ধর্মের এতটাই কাছাকাছি ছিল যে অনেকেই এই দু’ধর্মের মধ্যে পার্থক্য দেখতে পেতেন না।

উঁচু বর্ণের ব্রাহ্মণরা ধর্ম বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতেন। তারা বুদ্ধের দার্শনিক ভাবশিক্ষার বিরুদ্ধে ততটা সোচ্চার ছিলেন না। তবে ব্রাহ্মণ্যবাদের ভিত্তিপ্রস্তর অর্থাৎ, প্রাচীন কাল থেকে রক্ষা করে আসা বেদে দেয়া ব্রাহ্মণদের দৈবত্ব, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বকে যখন বৌদ্ধবাদে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো তখন তারা তার সর্বাঙ্গীন বিরোধিতা করলেন।
বৌদ্ধ ধর্মের পতনের কারণ নিয়ে গবেষণা করা শ্রী নরেশ কুমার মনে করেন, বৌদ্ধবাদের বিরোধিতা ও একইসাথে ক্ষয়িষ্ণু ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের পুনর্স্থাপনের জন্যে, ব্রাহ্মণ পুনর্জাগরণীরা তিন ধাপের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। প্রথম ধাপে তারা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর অত্যাচারের অভিযান শুরু করেন। এরপরে তারা বৌদ্ধ ধর্মের ভালো দিকগুলো আত্মস্থ করে নেয় যাতে করে “নীচু” জাতের বৌদ্ধদের মন জয় করা যায়। কিন্তু বাছাইকৃত আত্মীকরণের এই ধাপে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য যাতে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ না হয় তা নিশ্চিত রাখা হয়। বৌদ্ধবাদ ধ্বংস প্রকল্পের শেষধাপে – ‘গৌতম বুদ্ধ হিন্দু বিধাতা বিষ্ণুর আরেকটি অবতার ছাড়া আর কিছুই নন’ – এই ধারণা চালু করে তা চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এভাবে বুদ্ধকে ব্রাহ্মণ্যবাদের সর্বদেবতার মন্দিরের অগুন্তি ঈশ্বরের সামান্য একটিমাত্র-তে পরিণত করা হয়। অবশেষে, বৌদ্ধরা মূলত শুদ্র আর অচ্ছুত হিসেবে জাতপ্রথায় আত্মীকৃত হলেন – আর এভাবেই নিজ জন্মভূমিতেই বৌদ্ধরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে লাগলেন।

নীলেশ কুমার বলেন, “বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে চলা এই নির্মূলাভিযানকে বৈধতা দিতে ব্রাহ্মণ্য লেখাগুলোতে বৌদ্ধদের প্রচণ্ডভাবে তিরস্কার করা হয়। মনুসংহিতায় মনু বলেন, “কেউ যদি বুদ্ধকে স্পর্শ করে […] তবে সে স্নান করে নিজেকে শুচি-শুদ্ধ করে নেবে।” অপরাকা তার গ্রন্থে একই ধরণের আদেশ দেন। ব্রাদ্ধ হরিত ঘোষণা করেন যে বৌদ্ধ মন্দিরে প্রবেশ করাই পাপ, যা কেবল আচারিক স্নানের মাধ্যমে স্খলিত হতে পারে। এমনকি সাধারণ জনগণের জন্যে লেখা নাটিকা কিংবা পুথিগুলোতেও ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা বুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘৃণার অর্গল ছড়িয়েছেন। প্রাচীন নাটিকা ‘মৃচ্ছাকথিকা’তে (পর্ব ৭), নায়ক চারুদত্ত এক বৌদ্ধ সন্তকে হেঁটে আসতে দেখে, বন্ধু মৈত্রীয়কে ক্রোধক্তিতে বলেন – ‘আহ্‌! কী অশুভ দৃশ্য – এক বৌদ্ধ সন্ত দেখছি আমাদের দিকেই আসছে।’

The-Little-Clay-Cart

চিত্র ২ – বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ঘটা নিয়মতান্ত্রিক অবহেলা আর ঘৃণার প্রকাশ প্রাচীন নাটিকা “মৃচ্ছাকথিকা”তেও দেখা যায়। উপরে বিখ্যাত নাটিকাটির ইংরেজি অনুবাদের গ্রন্থ। এই নাটিকার নায়ক চারুদত্ত এক বৌদ্ধ সন্তকে হেঁটে আসতে দেখে, বন্ধু মৈত্রীয়কে ক্রোধক্তিতে বলেন – ‘আহ্‌! কী অশুভ দৃশ্য – এক বৌদ্ধ সন্ত দেখছি আমাদের দিকেই আসছে।’

কুমার বলেন, “অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থের রচয়িতা ব্রাহ্মণ বর্ণের চাণক্য ঘোষণা করেন, “যদি কেউ শক্য (বৌদ্ধ), অজিবিকাশ, শুদ্র বা নিষ্ক্রান্ত ব্যক্তিদের ঈশ্বর বা পূর্ব-পুরুষদের পূণ্যার্থে উৎসর্গিত ভোজসভায় যোগদান করে – তবে তার উপর একশ পানা অর্থদণ্ড আরোপিত হবে।” ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুজ্জীবনের পুরোধা শঙ্করাচার্য বৌদ্ধবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড নিন্দামূলক কথার মাধ্যমে বৌদ্ধদের মনে সীমাহীন ভীতির সঞ্চার করেন … পুরানের অনেক রচয়িতাও মিথ্যা কলঙ্ক, অপবাদ, চরিত্রহরণের মাধ্যমে ঘৃণার এই পরম্পরা অব্যাহত রাখেন। এমনকি বিপন্ন সময়েও কোনো বৌদ্ধের বাড়িতে প্রবেশ করাকে ব্রাহ্মণদের জন্যে মহাপাপ হিসেবে তাদের ধর্মগ্রন্থ নারদীয় পুরানে আজ্ঞায়িত করা হয়। বিষ্ণু পুরানে বৌদ্ধদের মহা-মোহ হিসেবে উপাধিত করা হয়। এতে ‘বৌদ্ধদের সাথে কথা বলার পাপ’-কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়, “যারা এমনকি বৌদ্ধ সন্তদের সাথে কথাও বলবে – তাদের নরকে যেতে হবে।”
chan

চিত্র ৩ – বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নিন্দা ও ঘৃণার অর্গল ছড়াতে এমনকি অর্থশাস্ত্রের জনক বলে বিবেচিত চানক্যও কম ছিলেন না।

কুশিনগর বা হার্রাম্বাতে গৌতম বুদ্ধ মারা যান বিধায় এটি বৌদ্ধদের কাছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থান। এই নামকরা শহরের চাকচিক্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে ব্রাহ্মণরা এই কুৎসা রটায় যে এই শহরে মৃত্যু হলে সে সরাসরি নরকে চলে যাবে কিংবা পরজন্মে গাধা হয়ে জন্মাবে – কিন্তু ব্রাহ্মণীয় পবিত্র নগর কাশিতে মৃত্যু হলে সে সরাসরি স্বর্গে চলে যাবে। এই উদ্ভট ধর্মতত্ত্ব এমনই পরিব্যপ্ত হয়ে গিয়েছিল যে, যখন মুসলিম সুফী সাধক কবির ১৫১৮ সালে কুশিনগরের কাছে মঘরে মারা যান, তখন তার হিন্দু ভক্তকুল কোনো স্থানীয় স্মৃতি স্থাপনা বানাতে অস্বীকৃতি জানায়। তারাই আবার কাশিতে গিয়ে তার নামে একটি স্মৃতি স্থাপনা গড়ে তোলে। কবিরের মুসলিম ভক্তরা এদিক থেকে কম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল। তারা মঘরেই তার মাজার গড়ে তোলে।

এরপরে নরেশ কুমার বলেন, “বুদ্ধের নাম কলুষিত করার পাশাপাশি এহেন ব্রাহ্মণ্য পুনর্জাগরণবাদীরা নিরপরাধ বৌদ্ধদের নিপীড়ন কিংবা এমনকি মেরে ফেলার তাগিদ হিন্দু রাজাদের দিতে থাকেন। বাংলার শৈব ব্রাহ্মণ রাজা শশাঙ্ক শেষ বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধনের বড় ভাই রাজ্যবর্ধনকে ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে হত্যা করেন। এরপরে শশাঙ্ক বোধি গয়াতে গিয়ে বোধি বৃক্ষকে উপড়ে ফেলেন – যার নিচে বসে ধ্যান করে গৌতম বোধি প্রাপ্ত হন। পাশের বৌদ্ধ বিহারে থাকা বৌদ্ধের প্রতিকৃতি তিনি সরিয়ে ফেলে তার জায়গাতে শিবের প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে দেন। এরপরে বলা হয়ে থাকে যে শশাঙ্ক কুশিনগরের সব বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নির্বিচারে হত্যা করেন। আরেক শৈব হিন্দু রাজা মিহিরকুল ১৫০০ বৌদ্ধ তীর্থস্থান সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেন। শৈব রাজা তরামন কৌসম্বিতে থাকা বৌদ্ধ মঠ ঘষিতরাম ধ্বংস করেন বলে জানা যায়। [নোট: শেতাঙ্গ হুন জাতির মিহিরকুল হিন্দুত্বে ধর্মান্তরিত নাও হয়ে থাকতে পারেন।]

ব্রাহ্মণদের দ্বারা পাইকারী হারে বৌদ্ধ স্থাপনাগুলোর ধ্বংস ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধবাদের নির্মূল হওয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। বোধগয়ার মহাবোধি বিহারকে জোর করে শিব মন্দিরে পরিণত করা হয়েছে কিনা – তা নিয়ে বাদানুবাদ আজও চলছে। কুশিনগরের বুদ্ধের স্তুপ-প্যাগোডাকে রমহর ভবানী নামের এক অখ্যাত হিন্দু দেবতার মন্দিরে পরিবর্তিত করা হয়। জানা যায় যে আদি শঙ্কর অধিকৃত বৌদ্ধ আশ্রমের জায়গাতে হিন্দু শ্রীঙ্গেরী মঠ বানিয়েছিলেন। অযোধ্যার অনেক হিন্দু তীর্থস্থান, যেমন সবরীমালা, বদ্রীনাথ কিংবা পুরীর মত প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ্য মন্দির আদতে একসময় ছিল বৌদ্ধ মন্দির।”

ইতিহাসবিদ এস. আর. গোয়েল এর মতে (লেখক – A History of Indian Buddhism) পুরোহিত বর্ণের ব্রাহ্মণদের শত্রুতার জন্যেই ভারতবর্ষে বৌদ্ধবাদের অবলুপ্তি ঘটেছে। গৌড়ের শাসক হিন্দু শৈব রাজা শশাঙ্ক (৫৯০-৬২৬) বোধি বৃক্ষ ধ্বংস করেন – যার নিচে বসে ধ্যান করে গৌতম বোধিপ্রাপ্ত হন। পুস্যমিত্র শুঙ্গ (১৮৫-১৫১ পূর্বাব্দ) বৌদ্ধদের প্রতি বৈরী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় সূত্র লেখনিগুলোসহ বৌদ্ধ প্রার্থনালয় জ্বালিয়ে দেয়া ছাড়াও অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুকে পাইকারী হারে হত্যা করেন। এককালে উদগ্র গো-মাংস ভক্ষক ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধদের দেখাদেখি নিরামিষাশী হয়ে যান। তারা বুদ্ধের প্রতি প্রচলিত ভালবাসার আদলেই নতুন করে রাম আর কৃষ্ণ বন্দনা শুরু করে দেন। বৌদ্ধদের অবলোপনের ঊষালগ্নের এই সময়কালেই মহাভারত রচিত হয় – যাতে করে নিম্নবর্ণের বৌদ্ধদের আবার শুদ্র হিসেবে হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনা যায়। ব্রাহ্মণরা অবশ্য এর পরেও বেদ গ্রন্থ শুদ্রদের পড়বার জন্যে উন্মুক্ত করেননি, আর এই বৈষম্য সামাল দিয়ে ধর্মান্তরিত বৌদ্ধ শুদ্রদের শান্ত রাখতেই খুব সম্ভবত মহাভারত রচিত হয়।

প্রথম সহস্রাব্দীর দ্বিতীয় অংশে বৌদ্ধদের অবস্থা সম্পর্কে আমরা যা জানি তা মূলত এসেছে সপ্তম শতাব্দীর চৈনিক বৌদ্ধ পদব্রাজক হিউয়েন সাং ভ্রমনবৃত্তান্ত থেকে। যদিও কিছু জায়গাতে বৌদ্ধদের সমৃদ্ধ হতে দেখেছেন, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি বৌদ্ধবাদকে দেখেছেন জৈন ও ব্রাহ্মণ শক্তির কাছে পরাভূত মৃতপ্রায় সত্তা হিসেবে। বিহারে (প্রাচীন মগধ – বুদ্ধের মৃত্যুস্থান) কয়েকটি বিশেষ বৌদ্ধ স্থানে তিনি মারাত্মকভাবে ক্ষয়িষ্ণু হাতেগোনা কিছু ভক্ত দেখেছেন – ঐদিকে আবার দেখেছেন হিন্দু ও জৈনদের রমরমা অবস্থা। বাংলা, কামরূপ ও আসামেও তিনি অপেক্ষাকৃত স্বল্প সংখ্যক বৌদ্ধ দেখেছেন; কন্যাধাতে কোনো বৌদ্ধ পাননি, আর তামিল, গুজরাট ও রাজস্থানে দেখছেন গুটিকয়েক বৌদ্ধ। চালুক্যদের রাজত্বকালে হিউয়েন সাং লিখেছেন, চালুক্যদের শাসনামলে অন্ধ্র আর পল্লব শাসকদের অনুকুল্যে গড়ে ওঠা অনেক বৌদ্ধ স্তুপ মন্দির পরিত্যাক্ত কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই অঞ্চলগুলো বৈষ্ণব-পূর্ব চালুক্যদের শাসনাধীনে আসে, যারা বৌদ্ধদের প্রতি বৈরী ছিলেন। সাং এর বাংলা ভ্রমণকালে গোঁড়া হিন্দু শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার শাসক। তিনি শশাঙ্ককে একজন “বিষাক্ত গৌড় সাপ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন – যিনি বাংলার বৌদ্ধ স্তুপ -মন্দিরগুলো ধ্বংস করেন আর তার রাজ্যের একেক বৌদ্ধ সন্তদের মাথার জন্যে একশ স্বর্ণমুদ্রা করে পুরস্কার ঘোষণা করেন। হিউয়েন সাং-সহ অনেক বৌদ্ধ সূত্রগুলোতে থানেসরের বৌদ্ধ রাজা রাজ্যবর্ধনের হত্যার জন্যে শশাঙ্ককে দায়ী করা হয়। হিউয়েন সাং লিখেছেন, বোধ গোয়ার বোধি বৃক্ষ কাটা ছাড়াও ওখানকার বৌদ্ধ মূর্তিগুলোকে শিবলিঙ্গ দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন।

Xuanzang_w

চিত্র ৪ – চৈনিক পদব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভারত সফরের বৃত্তান্ত থেকে সমসাময়িক কালের বৌদ্ধদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, শশাঙ্ক বৌদ্ধ রাজা হর্ষবর্ধনের সাথে এক অমিমাংসিত যুদ্ধ করেন – যেখানে শশাঙ্ক তার নিজের অঞ্চলগুলো ধরে রাখতে সমর্থ হন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে কিছুকাল ধরে শাসনের অধিকার নিয়ে বাংলায় হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট চলে। পরে পাল রাজারা বাংলার অধিপতি হলে তারা মহায়নী বৌদ্ধবাদ ও শৈব হিন্দু উভয়েরই পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পালদের পরে ত্রয়োদশ শতকের বখতিয়ার খিলজি বাংলার শাসন অধিগ্রহণের আগে হিন্দু সেন রাজারা (১০৯৭-১২০৩) বাংলার অধিপতি ছিলেন। আর সেন’দের সময়ে শৈব হিন্দুরা পায় শাসকদের আনুকুল্য, আর ঐদিকে বৌদ্ধদের তিব্বতের দিকে ঠেলে সরিয়ে দেয়া হয়। পুরান গ্রন্থগুলো নিয়ে সামান্য গবেষণা করলেই দেখা যায়, এই ব্রাহ্মণ্য আখ্যানগুলো কীভাবে বৌদ্ধদের প্রতি শ্লেষ আর অবর্ণনীয় ভাষিক বর্বরতায় ভরা, যেখানে বৌদ্ধদের ক্ষতিকর আর ভয়ানক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

আসলে অশোকের পরে ভারতবর্ষের অধিকাংশ শাসকরাই হিন্দুত্বকে আনুকুল্য দেখানোর পাশাপাশি বৌদ্ধদের প্রতি ছিলেন বৈরী – আর এ কারণেই ভারতবর্ষে বৌদ্ধদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। অনেক দিক থেকেই বৌদ্ধবাদ সার্বিক অর্থে ম্রিয়মান হয়ে আসছিল। জনৈক ঐতিহাসিক বলেন, “গুপ্ত সম্রাজ্যের পর থেকে ভারতীয় ধর্মগুলো দিনে দিনে জাদুমন্ত্র ও যৌনতা-কেন্দ্রিক আধ্যাত্মিক মর্মজ্ঞান লাভের মত সনাতনী চিন্তাধারা দিয়ে আবিষ্ট হতে থাকে, আর বৌদ্ধ ধর্মও এই ধারাগুলো দিয়ে প্রভাবিত হতে থাকে।” এই অবিষ্টতার ফলাফল হিসেবে “বজ্রপাতের যান” হিসেবে বজ্রায়নের আবির্ভাব ঘটে। নতুন এই গোষ্ঠী ধর্মীয় মতবাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উন্মত্ততাকে আশির্বাদ দেয় – সাথে সাথে কৌমার্য ব্রতের প্রতিও দেখা দিতে থাকে শৈথিল্য।

সপ্তম শতাব্দীর আরেক পরিব্রাজক ইউয়ান চং বলেন, “বৌদ্ধবাদের নানা মতবাদীদের মধ্যে অবিরত বচসা লেগেই থাকত, যেন একেকজনের বচসা-বাণী সাগরের উত্তাল ঊর্মিমালা … যেখানে ১৮টি গোত্রের প্রতিটিই নিজেদের মৌলিক বিশিষ্টতার দাবি করে।” এই নানা উপদলের শত্রুতা জনমানসে সঞ্চিত বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা কালেক্রমে ম্রিয়মান করে তোলে। মহায়ন ও বজ্রায়ন উপদলের ধর্মীয় গ্রন্থগুলো সংস্কৃতে লেখা শুরু হলো যা কিনা ভারতীয় আমজনতার কাছে ছিল অবোধগম্য। এই ধারা দিনে দিনে বৌদ্ধ ধর্মকে সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। ফলে মূলত “ঈশ্বরহীন” মর্মবাণীর এই ধর্ম ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণের মনে হিন্দুত্ববাদের মত করে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হলো – যেখানে অসংখ্য দেবতারা সাধারণের জীবনে মধ্যস্থতা করতো যদি তারা সেভাবে পূজিত হত। বৌদ্ধদের এই নৈতিক অবক্ষয় ধর্মটিতে বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা ডেকে আনে – অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদ তখন শক্তিশালী বুদ্ধিজীবিদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল।

কয়েক শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ হওয়া বৌদ্ধবাদ তাই সংঘ পরিবারের দূষণ, উপদলীয় কোন্দল, আর শাসক শ্রেণীর আনুকুল্য পেতে ব্যর্থ হওয়ায় ধীরলয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে – ফলে তা আর সংশোধিত হিন্দুত্ববাদের সাথে পাল্লা দিতে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। এভাবে একসময় পুরো ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। নানা উপঢৌকনে সংঘ পরিবার ধনী হতে থাকে আর বৌদ্ধ সন্তরা বিনয়ের দশম বিধি উপেক্ষা করে সোনা রূপার অনুদান নিতে থাকেন। কৃচ্ছতার মূল সুর থেকে সরে গিয়ে মহায়ন উপদল নানা ব্যয়বহুল আচারানুষ্ঠান চালু করে।

দেখা যায়, যে নিজেদের দোষেই বৌদ্ধবাদ অনেকাংশে অবলুপ্ত হয়। নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হিন্দুত্ববাদের সাথে এটি জনপ্রিয়তায় কোনোভাবেই টিকতে পারছিলনা। আদিশঙ্কর, মাধবাচার্য ও রামানুজ প্রমুখ হিন্দু দার্শনিক ও ধর্মবেত্তাদের আবির্ভাবে হিন্দুত্বে নবপ্রাণ ফিরে আসে – আর সেইসাথে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধবাদ দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকে। শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০ খৃঃ) ও রামানুজ (১০১৭-১১৩৭) প্রান্তিক লোকদের কাছে পরিচিত বৈদিক সাহিত্যের আলোকে হিন্দু দর্শনকে পরিশীলিত করেন আর সেইসাথে এই নব মতবাদ প্রচার ও প্রসারে গড়ে তোলেন অসংখ্য মন্দির আর পাঠশালা। অন্যদিকে নানা পথ ও মতের সমন্বয়ের চেষ্টায় রত হিন্দুত্বের সর্বদেবতার আলয়ে গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে আত্মস্থ করে নেয়া হয়। হিন্দু ধর্মের মধ্যে থেকেই তাই একজন ভক্ত বুদ্ধকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতে পারত। এটাই ছিল বুদ্ধের জন্মস্থানেই বৌদ্ধ ধর্মের কফিনে মারা শেষ পেরেক। হিন্দুধর্ম তাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো – “নানা মতের বিশ্বাসীদের জন্যে আস্থা ও সন্তুষ্টির কেন্দ্র।” ব্যক্তিগত ঈশ্বরের স্থান করে দেয়া ছাড়াও তখন আবেগী ভক্তিমূলক গানের উত্থান শুরু হলো যা আগে দেখা যেতনা।

Hindupriests

চিত্র ৫ – আদিশঙ্কর, রামানুজ ও মাধবাচার্য। এসব দার্শনিক ও ধর্মবেত্তাদের আবির্ভাবে হিন্দুত্বে নবপ্রাণ ফিরে আসে – আর সেইসাথে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধবাদ দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকে।

বৌদ্ধ ধর্মবিশারদদের মতে একাদশ শতকের আগে সাধারণ বৌদ্ধ জনতার ধর্মরীতি কিংবা আচরণবিধি তৈরী করা হয়নি। কিছু বৌদ্ধ ধর্ম গবেষক বৌদ্ধ ধর্ম ক্ষয়িষ্ণু ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার পেছনে কিছু ভিক্ষুর সহজিয়া ও অলস পথাবলম্বনকে দায়ী করেছেন – যা কিনা স্বয়ং বুদ্ধের অপরিগ্রহ কিংবা অনধিকার রীতির বিপরীত। বৌদ্ধ মন্দিরগুলো অনেকক্ষেত্রেই অঢেল সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে দেখা হয়। বাঁচার জন্যে ভিক্ষাবৃত্তি করা এসব বৌদ্ধ সন্তদের অনেক সময়ই দেখা গেছে সাধারণ জনগনের পরিবর্তে নিপীড়ক শাসকদের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে। আর এই প্রবণতা – এমনকি আজও বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোতে দেখা যায়।

হিন্দু আর বৌদ্ধদের এই সহস্রাব্দী ধরে চলতে থাকা শত্রুতাতে সাধারণ লোকজন বিরক্ত হয়ে পড়ে – এতে করে অবশ্য সুফী সাধক ও মুসলিম অগ্রদূতদের প্রচেষ্টায় ইসলাম এতদ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। চমৎকার নৈতিক শিক্ষা, বর্ণবাদ-মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহজবোধ্য ও সহজসাধ্য বিশ্বাস ও আচারিক ব্যবস্থার কল্যানে ইসলাম এতদ অঞ্চলে জনপ্রিয় হতোই – প্রশ্নটা কেবল ছিল – কখন? তাছাড়াও বৌদ্ধ ও হিন্দু শাসনামলের চাইতে ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের বিশাল অংশে মুসলিম শাসকদের আমলে জনগণের উপর আরোপিত শুল্কহার কমে আসে – যা প্রান্তিক ও বঞ্চিত ভারতীয়দের ইসলামের প্রতি অনুকুল মনোভাব তৈরীতে সহায়তা করে। পরে অবশ্য নিজেদের অবস্থান আরো সুসংহত করতে শাসক শ্রেণীর অনেকেও ইসলাম গ্রহণ করে নেন। আর এসব ঘটনা রাতারাতি ঘটেনি – বরং শতাব্দী ধরে এই ধারা চলাতে ইসলাম ভারতবর্ষের অনেক অঞ্চলে প্রধান ধর্মে পরিণত হয়।

প্রচলিত উপকথা ও জনশ্রুতির বিপরীতে এখানে বলে রাখা ভালো যে, নালন্দার বৌদ্ধ বিহার বখতিয়ারের অভিযানের সময় মোটেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। নালন্দার ক্ষয়-ক্ষতিগুলো সবই প্রাক-ইসলামিক। তিব্বতীয় অনুবাদক চাগ লোতসাওয়া ধর্মস্বামী (১১৯৭-১২৬৪) যখন ১২৩৫ সালে ভারত সফর করেন, তিনি নালন্দাকে অনেকখানি লোকশূন্য অবস্থায় পান, তথাপিও তিনি সেখানে ৭০ জন ছাত্রসহ চালু অবস্থায় দেখতে পান। এটা কীভাবে সম্ভব যদি বখতিয়ারের সৈন্যদল আসলেই প্রায় তিন দশক আগে এটাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে থাকে? তাহলে অন্যান্য জায়গাগুলো সম্পর্কে কি জানা যায় – যেখানে বৌদ্ধ ধর্ম নির্মূল হয়েছে?

পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মত উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের বিশাল অঞ্চল ও মধ্য এশিয়াতে বৌদ্ধ ধর্ম ষষ্ঠ শতকে শ্বেতাঙ্গ হুনদের দখল অভিযানে নির্মূল হয়ে যায়। বৌদ্ধবাদের বদলে সেখানে প্রচলিত হয় তান্গেরী ও মানিষেবাদ। রাজা মিহিরকুল (রাজত্বকাল ৫১৫ খৃষ্টাব্দ) বৌদ্ধবাদকে দমন করেন। তিনি এমনকি হালের এলাহবাদ থাকা বৌদ্ধ মন্দিরগুলোও ধ্বংস করেন। [নোট: শ্বেতাঙ্গ হুনেরা পরে ব্রাহ্মণদের কল্যানে রাজপূত হিন্দুত্ব গ্রহণ করে আর বৌদ্ধবাদের প্রতি বিরূপ বা বৈরী হয়ে পড়ে।] আর এইসব বৌদ্ধমঠগুলোর ধ্বংস ঘটে এতদ অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশের বহুকাল আগেই।

দশম শতাব্দীর গজনীর সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের সময় বৌদ্ধ ধর্ম বলতে গেলে ভারত থেকে মুছেই গেছে – আর হিন্দু ও অন্যান্য অ-বৌদ্ধ রাজারাই এজন্যে মূলত দায়ী। আর যখন হুলাগু খানের পৌত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন মধ্য এশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মকে মেনে নেয়। গজনীর রাজারা সগদিয়া, বাকত্রিয়া কিংবা কাবুলের বৌদ্ধদের উপর কোনো অত্যাচার করেনি। ৯৮২ সালেও নব বিহারের চিত্রপটগুলো দৃশ্যমান ছিল আর মধ্য আফগানিস্থানের বামিয়ানে খাড়া পাহাড়ে খোদাই করা বিশালাকায় বুদ্ধের মুর্তিগুলোও ছিল অক্ষত। প্রথম সহস্রাব্দির সংলগ্নে সগদিয়ায় দক্ষিণ সীমান্তে অনেক বৌদ্ধ মঠ তখনও চালু ছিল বলে আল-বিরুনি জানিয়েছেন। গজনীর রাজারা বৌদ্ধ ধর্মকে বাঁধা দেননি – এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বলতে গেলে তারা একে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন, বিশেষত এর সাহিত্য ও শিল্পকর্মকে।

১০২৮ সাল থেকে শুরু করে ১১০১ এ শেষ হবার আগ পর্যন্ত কাশ্মীরের প্রথম লোহারা সাম্রাজ্যের সময় বৌদ্ধধর্ম অর্থনৈতিকভাবে ধীরলয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। কালক্রমে বৌদ্ধ মঠগুলো অত্যল্প আর্থিক সাহায্যের জন্যে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, গজনীর শাসনাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় মধ্য ভারতের ভিক্ষু বিহারের তুলনায় কাশ্মীরি মঠগুলোর মান ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে থাকে। লোহারা সাম্রাজ্যের শেষ হিন্দু রাজা হর্ষ (১০৮৯-১১০১) আরেকটি ধর্মীয় নিবর্তনমূলক নিয়ম চালু করেন। তিনি একাধারে হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ মঠগুলো ধ্বংস করা শুরু করেন। দ্বিতীয় লোহারা সাম্রাজ্যের সময় (১১০১-১১৭১) অবশ্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দু’টি ধর্মই পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। পরন্তু “The Decline and Fall of Buddhism” বইতে ডক্টর কে. জামানদাস জানিয়েছেন যে, দুটো বুদ্ধের মূর্তি হর্ষের ধ্বংসাভিযানের হাত থেকে বেঁচে যায় তা রাজা জয়সিংহের (রাজত্ব ১১২৮-১১৪৯) আমলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়াও শ্রীনগরের কাছে আরিগোনের বৌদ্ধ বিহার আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এছাড়াও সার্বিক অর্থেই সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি দিনে দিনে কমে আসতেও থাকে। ঐদিকে এর পরে আবার আসে হিন্দু রাজাদের (১১৭১-১৩২০) আমল। তবে যদিও আর্থিকভাবে দিনে দিনে বৌদ্ধ মঠগুলো ম্রিয়মান হতে থাকে – তথাপি তিব্বত থেকে ক্ষণে ক্ষণে শিক্ষক ও অনুবাদকদের আসা যাওয়া থাকায় বৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপ চতুর্দশ শতক পর্যন্ত চলতে থাকে।

যদিও হিন্দু রাজাদের অধীনে তিন শতকেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মিরে রাজনৈতিক দুর্বলতা ছিল– গজনীর সুলতান কিংবা ভারতে তাদের উত্তরসুরীরা ১৩৩৭ এর আগ পর্যন্ত কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করেনি। ডক্টর কে. জামনদাস বলেছেন যে, কাশ্মিরে ইসলাম এনেছেন সুফী সাধক ফকির বুলবুল শাহ আর সৈয়দ আলী হামদানী – যিনি আমির কবির নামেও পরিচিত। [আগ্রহী পাঠক কাশ্মিরে ইসলাম প্রবেশের ইতিহাস ডক্টর কে. জামনদাসের বই থেকে পড়ে দেখতে পারেন।]

আর দক্ষিণে শৈব আর বৈষ্ণবীয় হিন্দুত্বের বলিষ্ঠ পূণর্জাগরণের ফলে বৌদ্ধ ধর্ম দ্রুতই ক্ষীণকায় হয়ে পড়ে।
বৌদ্ধ ধর্ম মূলত বৌদ্ধ মঠগুলোতেই বেঁচে ছিল ও আছে। অন্যান্য ধর্মের মত ধর্মসূত্র বা নৈতিক সংহিতার ঘাটতি এখানে সব সময়ই ছিল। তাই যখনই বৌদ্ধ মঠগুলো সাহায্যের অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো, সাথে সাথে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ ধর্ম দ্রুতই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে লাগলো।

উপসংহার:
কিছু ঐতিহাসিকের মধ্যে পূর্ব এশিয়াতে বৌদ্ধবাদের ক্ষীণকায় হয়ে আসার কারণ সম্পর্কে মতভেদ দেখা যায়। কিন্তু অকৃত্রিম ও নির্মোহ ইতিহাসবিদরা এ বিষয়ে একমত যে – ইসলামের আগমনের কারণে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপ ঘটেনি – বরং পুনরুজ্জীবিত হিন্দুত্বই এজন্যে মূলত দায়ী। অষ্টম শতকের বিখ্যাত হিন্দু দার্শনিক শঙ্কর বুদ্ধকে জনতার শত্রু বলে আখ্যায়িত করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি নিজেই বৌদ্ধবাদের আদলেই আশ্রম বিধি জারি করেন আর বৌদ্ধ ধর্ম থেকে অনেক দর্শন ধার করেন। বৌদ্ধ সংঘের আদলে শঙ্কর যখন অষ্টম শতকে সন্যাস ও আশ্রম বিধি জারি করেন – ঠিক তখনই বৌদ্ধ বৈরী প্রচারণাও ছিল উত্তুঙ্গে। তাকে বৌদ্ধবাদের কড়া সমালোচক হিসেবে যেমনভাবে অভিনন্দিত করা হয় – ঠিক তেমনিভাবে তাকেই ভারতবর্ষে বৌদ্ধবাদের অবলুপ্তির প্রধান কারিগর হিসেবেও দেখা হয়। একই সময়ে তাকে ছদ্মবেশী বৌদ্ধ হিসেবেও দেখা হয়। এই আপাত বিপ্রতীপ মতবাদগুলো সম্পর্কে প্রাচীন ও আধুনিক উভয়কালের দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও বিশেষজ্ঞ লেখকেরা একমত। যদিও শঙ্করকে হিন্দু সাহিত্যে বৌদ্ধবাদের পরাজয়ের কারণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তথাপি তিনি মূলত বৌদ্ধবাদ কিয়দ অঞ্চল থেকে দীপ্তিহীন হয়ে যাবার পরেই বেশি সক্রিয় ছিলেন।

বিশ্বকোষে লেখা হয়েছে, “চাঁদেলার প্রাঙ্গনে ঘটা প্রভাবশালী সংস্কৃত নাটক প্রবোধচন্দ্রদায়ে বিষ্ণুর আরাধনা আর প্রতিকাশ্রয়ী ভাষায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পরাজয় যেভাবে দেখানো হয়েছে তাতে বোঝা যায় যে প্রাক একাদশ শতকে উত্তর ভারতে হিন্দুত্বের নব-উচ্ছাস ফিরে আসে। উত্তর ভারতের জনগণ ততদিনে মূলত শৈব, বৈষ্ণব কিংবা শাক্ত হিন্দুত্বে ফিরে গেছেন। দ্বাদশ শতকের মধ্যে বৌদ্ধবাদ বলতে গেলে মঠ ও আশ্রম ভিত্তিক ধর্মে পরিণত হয় – যদিওবা কৃষক শ্রেণীতে কিছু লোক তখনও বৌদ্ধ ছিলেন, তাদেরকে ভিন্ন ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে পৃথক করা যেতোনা … আর যখন ভারতে মুসলিম শাসন অধিষ্ঠিত হলো তখন ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের কেবল ছিটেফোটা অবশিষ্ট ছিল – আর প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা তো বৌদ্ধদের হাত থেকে অনেক আগেই চলে গিয়েছে।”

সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতকে যখন ইসলাম দক্ষিন এশিয়ায় আগমন করে তখন থেকেই এটি হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মকেই উদার ও বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে প্রতিস্থাপন করে ফেলে। আগে যেভাবে বলা হলো, মধ্য ত্রয়োদশ শতকে বাগদাদে হুলাগু খানের গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার বদৌলতে অনেক মুসলিমই ঝামেলাবিহীন জায়গাগুলোতে আশ্রয় খুঁজছিল। অনেকেই ভারতবর্ষে স্থাপনা গাড়েন। সাথে নিয়ে এসেছিল উন্নততর নৈতিক শিক্ষা ও তার প্রয়োগ এবং এরসাথে সুফী শিক্ষা ভারতীয় জনগণকে ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করতে প্রনোদিত করে। সুফী সাধকদের প্রভাব, বর্ণপ্রথার চাপ, ও সেইসাথে সামাজিক পরিবর্তনকে রুখে দেবার মত রাজনৈতিক শক্তির অভাবে বাংলাতে সবচাইতে বেশি লোক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।

মোদ্দাকথা হচ্ছে, গাঙ্গেয় সমতল, মধ্য ও উত্তর ভারত-সহ হালের অন্ধ্র ও কর্নাটকে ইসলাম প্রোথিত হবার অনেক আগে থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম এতদ অঞ্চলে অবলুপ্তির নিদর্শন দেখাচ্ছিল। বলতে গেলে এর স্বাভাবিক মৃত্যুই ঘটেছে। যেভাবে জনৈক হিন্দু পণ্ডিত বলেছেন, “পুরাতন বৌদ্ধবাদ, যা কিনা ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে, মানব জীবনের অমরত্বকে কোনো আশা দেখাতে পারেনি – যেন জীবনটাই এক মর্মবেদনা, জীবনের মায়া যেন এক মহাপাপ, আর মৃত্যুই হচ্ছে সমস্ত কামনা, বাসনা থেকে পাওয়া নিষ্কৃতি। বৌদ্ধবাদ কুসংস্কার, স্বার্থহীনতা ও তদ্ভুত তুষ্টির দ্বারা নিজেই ছিল ভারাক্রান্ত … মহায়ন অধিবিদ্যা ও ধর্ম আদতে অদ্বৈত দর্শন ও বিশ্বাস সমার্থক। অন্যদিকে বৈরাগ্য চরিত্রের হীনায়ন শেষমেষ শৈব ধর্মের একটি শাখায় পরিণত হয়। দেখা গেল বৌদ্ধ ধর্মের স্বতন্ত্র আর কোনো শিক্ষাই দেবার ছিলনা। যখন ব্রাহ্মণ্যবাদ ঈশ্বরের প্রতি সর্বজনীন ভক্তি আত্মস্থ করলো আর সেইসাথে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে ঘোষণা দেয়া হলো – তখনই ভারতবর্ষে বৌদ্ধবাদের কফিনে শেষ পেরেক খানি ঠোকা হয় গেল।”

স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, “তাই, জীবে দয়া প্রদর্শন করার আদেশ সত্ত্বেও, মহান নৈতিক ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও, চিরায়ত আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব সম্পর্কিত আলোচনা থাকা সত্ত্বেও বৌদ্ধবাদের দালান ধ্বসে পড়েছে আর দালানের সেই ধ্বংসাবশেষ আসলেই কদাকার। মানব রচিত কিংবা পরিকল্পিত সবচাইতে কদর্য আচারাদি কিংবা অশ্লীল বই যা চিন্তা করা যায় তার সবই অধঃপতিত বৌদ্ধবাদের কল্যানে পাওয়া গেছে।”

অন্য ধর্মের দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন না করে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের নিজেদেরই ভারত ও দক্ষিণ এশিয়াতে নিজেদের অবলুপ্তির কারণ অনুসন্ধানে অন্তর্বীক্ষণে নামা উচিত। যদি তাই’ই করা হয় তবে দেখা যাবে যে বৌদ্ধ ধর্মের মৃত্যুর জন্যে সে নিজেই দায়ী – কোনো বাইরের শক্তি নয়। নিজেদের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার দায় বৌদ্ধবাদ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারেনা। বিশ্বায়নের এই যুগে বৌদ্ধবাদ যদি টিকে থাকতে চায় তবে এর সংস্কার বড়ই জরুরি – পাছে এটি মানব আকাঙ্খার প্রতি বৈরী ও ‘অন্য’দের প্রতি গণহত্যার আকাংখায় লালিত মৃতপ্রায় এক দর্শন হিসেবে বিবেচিত না হয়। এই সফরের জন্যে তাদের যত কম সম্ভব ‘উইরাথু’-দের ও যত বেশি সম্ভব গম্বিরা’-দের প্রয়োজন।

কথা হচ্ছে, বৌদ্ধবাদ কি সেই ‘প্রার্থিত অগ্রচিন্তা’ (‘quantum leap’) করতে প্রস্তত?

♦ সূত্র ও কৃতজ্ঞতা:  সদালাপডটঅর্গ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

5 Replies to “ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের অবলুপ্তির কারণ”

  1. ঘুরে ফিরে সেই আসল কথা, তাল গাছটা আমার । এটা বলার জন্যই আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে এতো বর্ণনার ঘনঘটা। হায়রে বখতিয়ার । তোমার দায় মুক্তির জন্যে আমরা হাজির। ইতিহাসের প্রতি সততার কি অভিনব দৃষ্টান্ত ।

    “”””চমৎকার নৈতিক শিক্ষা, বর্ণবাদ-মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহজবোধ্য ও সহজসাধ্য বিশ্বাস ও আচারিক ব্যবস্থার কল্যানে ইসলাম এতদ অঞ্চলে জনপ্রিয় হতোই – প্রশ্নটা কেবল ছিল – কখন? “”””” কখন ? কখন ??? কখন ????????

    1. ইতিহাস যে পড়েছে সে ভালোভাবেই জানে যে এই লেখাটা কতটা অযৌত্তিক।
      আসল কথা বৌদ্ধ ধর্মের ধ্বংসের কারণ বলা,না হিন্দুদের অসাম্প্রায়িকতার,নাকি নিজ ধর্ম ইসলামের সাফাই আর গুণগান করা।
      এটা মূর্খ লেখকের লিখনী পড়েই বোঝা যাচ্ছে।

  2. হিংসা হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের একটা অভিচ্ছেদ্য অংশ। অপদিকে বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসার বানী, নীতি কথাগুলো ইসলাম ধর্মের শান্তির বানীগুলোর সাথে অনেকটা সামঞ্জস্যতাপূর্ন। কিন্তু ধর্মহিসাবে একটা পূর্নাংগ জীবন বিধান বৌদ্ধ ধর্ম থাকে পাওয়া যায় না। স্রষ্টা সঠিক পরিচয় বৌদ্ধ ধর্মে নেই।

  3. বৌদ্ধ ধর্ম আদি-মধ্য ও অন্তঃ কল্যাণের জন্য রচিত। এটি বুদ্ধের মুখনিসৃত বাণী। এটিকে সংস্কার করা কারও অধিকার নাই। মুর্খ লেখকের লেখা এটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন