সরেজমিন প্রতিবেদন

মহালছড়ির জয়সেন পাড়ার অগ্নিকাণ্ড: সত্যি নাকি সাজানো নাটক?

fec-image

খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার জয়সেন পাড়ায় গত ১৪ মার্চ রাতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের সপ্তাহকাল পার হয়ে গেলে থানায় মামলা করেনি কুটিরের মালিক দাবীদারগণ। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পাহাড়ের সচেতন মহলের দাবী, এ ঘটনায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার চেয়ে পাহাড়ের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার দিকেই একটি মহলের আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ঘটনার পর পার্বত্যনিউজের প্রতিনিধি ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন। বিবদমান উভয়পক্ষ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন। পরিদর্শনকালে তিনি দেখতে পান,  মহালছড়ি উপজেলায় মাইসছড়ি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের জয়সেন পাড়ার পশ্চিমে ৫ একর নামক এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের স্থানটিতে সরেজমিনে কয়েকটি অস্থায়ীভাবে নির্মিত জুমঘর বা কুঁড়েঘর পোড়া অংশ বিশেষ দেখা যায়। তবে পুড়ে যাওয়া সেই ঘরগুলো পাহাড়ের ছন, বাঁশ দিয়ে তৈরি দৈর্ঘ্য ৬ফুট, প্রস্থে ৫ফুট করে সদ্য নির্মিত জুমঘর বা কুঁড়েঘর।

এদিকে ৪নং মাইসছড়ি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান বাবু সাজাই মারমা নেতৃত্বে এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের সাথে নিয়ে, উক্ত স্থানে সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পাশাপাশি ওই জায়গাটির নথিপত্র চাওয়া হলে স্থানীয়দের মধ্যে শুধুমাত্র বাঙ্গালীরাই তাদের রেকর্ডকৃত কবুলিয়ত নামার কপি প্রদর্শন করে।

এখানে ভুক্তভোগীদের কাছে জানতে চাইলে ওই পাহাড়ের মালিকানা দাবিকারী জৌতিচন্দ্র চাকমা(৬৫) বলেন, আমি এই পাহাড়ি জমির মালিক এই জায়গা আমার বাবার নামে, আমি সরকারি কোষাগারে জমির খাজনা দিয়ে আসছি। এখানে ৫ একর জায়গা আমাদের রেকর্ড আছে তা ৮০ দশকের সময়ে পরিবর্তন ঘটেছে তবুও আমি সরকারি নিয়ম অনুসরণ করে খাজনা পরিশোধ করে আসছি। বর্তমানে জুমচাষ করার জন্যে আমার নিকটতম ভূমিহীন (ভাগিনা ও ভাগনি জামাই) আত্মীয়দের চাষাবাদ করে থাকার জন্যে পাহাড়ের ভূমিগুলো তাদের দিয়েছি। কিন্তু তিনি একটি বারও বলেন নাই যে, এই সদ্য নির্মিত ঘরগুলো কে বা কারা পুড়ে দিয়েছে। মোট কথা এই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে জমির মালিক কর্তৃক কাউকে দোষারোপ করে নাই।

অপরদিকে ৮০/৮২ সালে আসা কাগজধারী পাহাড়ের মালিক মো. মহর আলী বলেন, চৌহদ্দি অনুয়ায়ী এই জায়গার মালিক আমি। ১৯৮২ সালে সরকার আমাদেরকে এই জায়গার উপর ৫একরের কবুলত দেয় এবং জায়গাটি বুঝিয়ে দেয় কিন্তু তৎকালীন সময়ে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে সরকার আমাদেরকে ক্লোজ করে গুচ্ছগ্রামে নিয়ে যায়। সেই থেকে জায়গাটি অনাবাদিভাবে পড়ে আছে।

মালিক দাবিকারী মহর আলী আরো বলেন, কিছু দিন পূর্বে কয়েকজন উপজাতি লোক ও এলাকার দূর্বৃত্তদের নিয়ে আমাদের জমি দখলের অপচেষ্টা করে। পাশাপাশি আরেক বাঙালি মালিকদের উপর নির্যাতন করেন ও সূর্য ভানু নামক একজনকে মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ শে ফেব্রুয়ারি আমরা জমির মালিকগণ উপজেলা ভূমি কমিশনার বরাবর তদন্ত স্বাপেক্ষে সুষ্ঠু ন্যায় বিচারের জন্য আবেদনপত্র করি। কিন্তু কিছু উগ্রপন্থি জনগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ পরিবেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার উদ্দেশ্যে গত ১৪ মার্চ আনুমানিক রাতে ১০টায় অস্থায়ীভাবে তাদের নির্মিত কয়েকটি কুড়েঘরে নিজেরাই আগুন ধরিয়ে দিয়ে আমাদের জমি দখল নেওয়ার অপচেষ্টা করছে এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে বাঙ্গালীদের উপর দোষ চাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছে।

স্থানীয় বাঙালি নেতৃবৃন্দ বলেন, ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের পর এবং বিতর্কিত ১৯০০ সালের আইন উচ্চ আদালতে বৈধ হওয়ার পর পাহাড়ের ভূমির মালিকানা প্রথাগত আইনে নির্ধারণের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এতে কৌশল উপজাতীয় হেডম্যান ও কার্বারীরা বাঙালিদের কবুলিয়তভূক্ত বেদখল ও অনাবাদি ভূমিগুলো স্থানীয় পাহাড়ীদের নামে খাজনা রশিদ কেটে দিয়ে মালিকানা বৈধ করছে। এতে পাহাড়ের ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরাট সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। তাদের এ কাজের মূল উদ্দেশ্য পাহাড়ে বাঙালিদের ভূমিহীন করে উচ্ছেদ করা। তারা এ কাজে সফল হলে সরকারী খাসজমি, রিজার্ভ ফরেস্টের জমি ও সরকারী অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকানা দাবী করবে। কাজেই এ সমস্যা থেকে বেরুতে হলে বিতর্কিত ভূমি কমিশন আইন সংশোধন বাতিল এবং সংবিধান বিরোধী ঔপনিবেশিক আইন বাতিল করার কোনো বিকল্প নেই।

তবে এই বিষয়ে ৪নং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাজাই মারমা বলেন, এই মাইসছড়ি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পরিস্থিতি সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনগণের মাঝে ভেদাভেদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে কতিপয় দূর্বৃত্ত কর্তৃক এমন ঘটনা ঘটাতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ভূমি কমিশনার বলেন, যে এলাকার ঘটনাটি ঘটেছে আমি সরেজমিনে দেখতে যাবো, কাগজপত্র দেখে যথাযথ সমাধানের লক্ষ্যে সকলকে সাথে নিয়ে পাহাড়ের শান্তি সম্প্রীতি বজায় রাখতে কাজ করবো।

এই বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশিদ বলেন, আমার পরিদর্শন টিম পুড়ে যাওয়ার জুমঘর বা কুঁড়েঘর পরিদর্শন করে আসেন কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ বা মামলা করা হয়নি। তবে তিনি আরো বলেন, ঘটনার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে তদারকি করা হচ্ছে।

উল্লেখ্যে যে, গত ১৫ মার্চ ২০২২ তারিখ হতে বেশ কিছু অনলাইন ভিত্তিক পত্রিকা ও নিউজ পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ১৪ মার্চ দিবাগত রাত আনুমানিক রাত ১০টায় মাইসছড়ি ইউনিয়নের জয়সেনপাড়া এলাকার পশ্চিমে ৪নং ওয়ার্ডে কিছু স্থানীয়দের নির্মিত জুমঘর বা কুঁড়েঘরে আগুন লাগানোর ঘটনাকে নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন