মানিকছড়ির সেমুতাং ফিল্ডে গ্যাস ফুরিয়ে আসায় কূপ সংস্কারের উদ্যোগ

fec-image

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) লিমিটেডের সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্র সেমুতাং। এটি পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার কালাপানি মৌজার ২১এ কর ভূমিতে ১৯৬৩ সালে আবিস্কৃত গ্যাস ফিল্ড। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১১ সালে উৎপাদন শুরু করে। শুরুতে ৫ নম্বর কূপ এবং তিন বছর পর ২০১৪ সালে ৬ নম্বর কূপ থেকে দৈনিক গড়ে ১৪-১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে জানুয়ারী ২০২১ সালে ৫ নম্বর কূপটি বন্ধ হয়ে গেলে ৬ নম্বর কূপ থেকে বর্তমানে প্রতিদিন মাত্র .৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে। ফলে পাইপ লাইনে গ্যাসের চাপ বাড়াতে সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে বাপেক্স। উৎপাদন বন্ধ হওয়া কূপ সংস্কারে তোড়জোর শুরু হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দাবী সংস্কারে ৫ নম্বর কূপে সফলতা পেলে ৬ নম্বর কূপটিও সংস্কার করা হবে।

সেমুতাং গ্যাস ফিন্ড ও বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের এই প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র সেমতাংয়ের রয়েছে অনেক রহস্যঘেরা ইতিবৃত্ত। ১৯৬৩ সালে ব্রিটিশ কোম্পানীর একটি গ্যাস অনুসন্ধানী দল গ্যাসক্ষেত্রটির সন্ধান পান। পরে একে একে ৫টি কূপের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে টানা এক বছর গ্যাস ও তেল উত্তোলনে বিপুল গ্যাস ও তেল মজুদের সন্ধান পায় ব্রিটিশ কোম্পানী। এই খবর জানাজানির পর ২ নম্বর কূপে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসীরা। এতে রিগ মেশিনসহ ওয়েল হেড ভূগর্ভে তলিয়ে যায়। ফলে থমকে যায় গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম। এক পর্যায়ে ১৯৭০ সালে গ্যাস উত্তোলনে গিয়েও দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ায় এক দশক তা বন্ধ থাকে। ১৯৮৩ সালে পেট্রোবাংলা আবার গ্যাসক্ষেত্রটি পুরোদমে চালু করলেও হঠাৎ দুইজন প্রকৌশলী অপহরণের শিকার হয়। যা আজও ওই ঘটনার কূল-কিনারা হয়নি।

পরে ১৯৯৪, ১৯৯৭, ২০০০ ও ২০০৪ সালে বিভিন্ন কোম্পানীর সাথে চুক্তি ও গ্যাসের ব্যবহার নিয়ে পেট্রোবাংলার সিদ্ধান্তহীনতায় গ্যাসক্ষেত্রটি অভিভাবক হীন হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এই পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহন করেন। ফলে ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রথমে ৫ নম্বর কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনে যায় বাপেক্স। গ্যাসফিল্ড থেকে পাইপ লাইনে ৬৫ কিলোমিটার দূরে বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামে গিয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় সেমুতাং গ্যাস। শুরুতে গ্যাসের গতি ১৫-১৭ মিলিয়ন ঘনফুট থাকলেও অল্প সময়ে প্রায় (৩ বছর) গ্যাসের গতি কমে যায়! ফলে বাপেক্সের পুরনো (দেবে যাওয়া) ১ নম্বর কূপের পাশে ৬ নম্বর কূপ খনন শুরু করেন রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমের (GAZPROM) দেশীয় সহযোগি প্রতিষ্ঠান কে.এন।

২০১৪ সালের জানুয়ারী-এপ্রিল মাসের খনন প্রক্রিয়া শেষে ১২ এপ্রিল থেকে ৩ডিসেম্বর (প্রায় ৮মাস) গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হতে থাকে। শুরুতে প্রতিদিন গড়ে ৪.৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেত। পরে গ্যাসের চেয়েও পানি বেশি উত্তোলন হওয়ায় দীর্ঘদিন এই ৬ নম্বর কূপে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়।

পরে আবার সংস্কার শেষে ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও এই কূপ থেকে গ্যাস সরবরাহ হতে থাকে। ২০১৮ সালে বাপেক্স সেমুতাং সাউথ-১ নামে ৭ নম্বর কূপ খননে গেলেও খনন প্রক্রিয়া শেষে গ্যাসের মজুদ না পেয়ে তা বন্ধ করে দেয়।

এদিকে ১৮ জানুয়ারী ২০২১ তারিখে ৫ নম্বর কূপটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ৬ নম্বর কূপ থেকে প্রতিদিন গড়ে. ৮মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হওয়ায় বাপেক্স ৫ নম্বর কূপটি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহন করেন। এই কূপ সংস্কারে সফলতা পেলে পরবর্তীতে ৬নম্বর কূপটিও সংস্কার করবে বলে বাপেক্স সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

সেমুতাং গ্যাস ফিল্ড এলাকার বাসিন্দা ও সাবেক জনপ্রতিনিধি মো. এনামুল হক বলেন, এই গ্যাস ফিল্ডের অনুসন্ধান, গ্যাস উত্তোলনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সফলতার দেখা মেলে। ১৯৬৯ সাল থেকে ২০১১ এই দীর্ঘ সময় ধরে গ্যাস উত্তোলন না হওয়ায় আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। অবশেষে এই পার্বত্য জনপদের সম্পদ জাতীয় গ্রিডে অবদান রাখচ্ছে। তবে আমাদের দুঃখ একটাই আমরা বাতির নিচে থেকেও অন্ধকারে বসবাস করছি।

এলাকার যুবক মো. আমজাদ হোসেনের দাবী এই যোগ্যাছোলা ইউনিয়নে এখনো বিদুৎ পোঁছায়নি। সরকার একটু মানবিক হলে সেমুতাং থেকে আমাদেরকে বিদুতায়িত করতে পারেন। এটি আপাময় জনতার প্রাণের দাবী।

সেমুতাং গ্যাস ফিল্ডে দায়িত্বরত ম্যানেজার (প্রোডাকশন) মুহাম্মদ মাহিনূর রাহমান কূপ সংস্কার, ৫ ও ৬ নম্বর কূপে গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, বহিঃবিশ্বে যেভাবে গ্যাসের দাম বাড়ছে এবং দেশে প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ায় নতুন কূপ খনন ও সংস্কারের মাধ্যমে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে বাপেক্স। এরই অংশ হিসেবে সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্র সেমুতাংয়ে আপাতত ৫ নম্বর কূপটি বাপেক্সের নিজস্ব উদ্যোগে সংস্কার শুরু করতে যাচ্ছে । এটিতে সফল হলে পরবর্তীতে ৬ নম্বর কূপটিও সংস্কারসহ আগামী দিনে নতুন কূপ খননেও বাপেক্সের পরিকল্পনা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন