মুহিবুল্লাহ হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ

fec-image

ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার এক টুইট বার্তায় বলেছেন, মুহিবুল্লাহ ছিলেন রোহিঙ্গাদের একজন সাহসী যোদ্ধা। আমরা তার হত্যাকাণ্ডে শোকাহত ও বিচলিত। আশা করা যায়, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন টুইট বার্তায় বলেন, মুহিবুল্লাহর মৃত্যু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন মুহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে নিপীড়ন চালিয়েছে তা তুলে ধরতে এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোচ্চার ছিলেন তিনি। তার এই কাজের জন্য কয়েক বছর ধরেই তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল।

সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, মুহিবুল্লাহ ছিলেন রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের এক ভাইটাল ভয়েস। তিনি সবসময় ছিলেন রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পক্ষে। গাঙ্গুলি আরও বলেন, মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার ঘটনা শুধু রোহিঙ্গাদের অধিকার ও নিরাপত্তার লড়াইকেই ছোট করবে না, এই ঘটনা তাদের মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসনেও অন্তরায় সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের উচিত গুরুত্বের সঙ্গে মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড ও অন্য রোহিঙ্গা অধিকার কর্মীদের ওপর হওয়া সকল হামলার তদন্ত করা।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একই সঙ্গে হত্যাকারীকে চিহ্নিত করে তাকে বা তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি বলেছেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের শীর্ষ স্থানীয় একজন প্রতিনিধি ছিলেন মুহিবুল্লাহ। তিনি ক্যাম্পের সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সমর্থন দিয়েছেন শরণার্থীদের মানবাধিকারের পক্ষে এবং তা সুরক্ষিত রাখায়। তার হত্যাকাণ্ড পুরো সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে। এখন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব তার এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিচার করা।

সাদ হাম্মাদি আরও বলেন, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক এজেন্সির প্রতি আমরা আহ্বান জানাই, একত্রে কাজ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত শরণার্থী, নাগরিক সমাজের কর্মী, রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীসহ ওই শিবিরে অবস্থানরত মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এসব মানুষের অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সাদ হাম্মাদি আরও বলেন, কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে সহিংসতা একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। সশস্ত্র গ্রুপগুলো সেখানে মাদকের ব্যবসা করছে। তারা মানুষ হত্যা করছে এবং জিম্মি করছে। সেখানে আরও রক্তপাত বন্ধে কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ অনেক আগে থেকেই মৃত্যু ঝুঁকিতে ছিলেন। প্রায়শই বলতেন, বরাবরই বুলেট তাকে তাড়া করে বেড়ায়। ২০১৯ সনে একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভয়, আশঙ্কা, আতঙ্কের কথা বলেছিলেন। তার কথা, ‘যদি আমি মরে যাই, তাহলে জানবে তবুও ভালো আছি। কারণ আমি আমার জীবনটা উৎসর্গ করে গেলাম’। আসলে মৃত্যুকে পরোয়া করতেন না মুহিবুল্লাহ।

কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কর্মকর্তাদেরও তিনি বার কয়েক জানিয়েছিলেন, তার জীবনের ওপর হুমকি আছে। তার ভাই হাবিবুল্লাহ বলেছেন, মুহিবুল্লাহ প্রতিনিয়ত হুমকির মধ্যেই থাকতেন। ভয়ে অনেক সময় তটস্থ থাকতেন। কিন্তু নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ। রোহিঙ্গাদের দাবি নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে গেছেন। ২০১৯ সনে হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। প্রেসিডেন্টকে বলেছেন, রোহিঙ্গারা এখন রাষ্ট্রহীন। ক্যাম্পে ক্যাম্পে তাদের জীবন কাটছে এক অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে। মুহিবুল্লাহ ছিলেন স্পষ্টবাদী। কথা বলতেন সোজাসাপ্টা। তাই তার মৃত্যুর পর সবাই এক বাক্যে বলছেন- তাকে শুধু হত্যা নয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেই হত্যা করা হলো। কারা হত্যা করলো মুহিবুল্লাহকে?

এখন পর্যন্ত কেউ দায় স্বীকার করেনি। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অবস্থান জানতে চাইলে সদর দপ্তরের ডিআইজি(অপারেশন এন্ড মিডিয়া)হায়দার আলী খান বলেন, পুলিশ মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। এর পেছনে যারা আছে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেছেন, নিহত মুহিবুল্লাহর মৃতদেহ সদর হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এখনো মামলা হয়নি। ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে ক্যাম্পে এবং আশপাশে। শত শত পুলিশকে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে। তবে তার ভাই হাবিবুল্লাহ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে তাদের সবাইকে আমি চিনি। তারমধ্যে রয়েছে মুর্শিদ, লালুসহ অনেকেই। চেহারা দেখলে আমি চিনবো। হাবিবুল্লাহ বলেন, এশার নামাজ পড়ে অফিসে এসে বসার পরপরই ভাইকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। চারটি গুলি চালানো হয়। তিন ভাই আর চার বোনের মধ্যে মুহিবুল্লাহ ছিলেন সবার বড়।

মুহিবুল্লাহ বাংলাদেশে কখন আসেন এ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। কোনো কোনো সূত্র বলছে, ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। অন্য একটি সূত্রের দাবি, রোহিঙ্গা জনস্রোত যখন বাংলাদেশমুখী হয় তখন তিনি ছিলেন এই মিছিলে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সমাবেশের মধ্যে দিয়েই মুহিবুল্লাহ আলোচনায় আসেন। ওই সমাবেশে তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ নানা বিষয়ে খোলাখুলি অনেক কথাই বলেন।

গত ডিসেম্বরে ঢাকার একটি সংবাদপত্রের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, চারদিকে সন্ত্রাসীরা ওত পেতে বসে আছে। এই নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কারণ যে কোনো সময় আমার ওপর বিপদ নেমে আসবে। ইংরেজি ভাষায় দক্ষ মুহিবুল্লাহ বলতেন, জাতিসংঘের কাছ থেকে আমরা সুবিচার পেলাম না। যদি জাতিসংঘ মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতো তাহলে হয়তো আমরা এতদিনে দেশে ফিরে যেতাম।

এ দিকে জাতিসংঘ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরনার্থী নেতা মুহিবুল্লাহকে গতকাল হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

এই ঘটনার তদন্ত করতে এবং এবং যারা ‘এর জন্য দায়ী তাদের জবাবদিহিতার জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, “আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের যে কোন জায়গায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদানের জন্য জোরালো এবং অব্যাহত আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছি”। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শরনার্থীদের এবং অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যূত লোকদের নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে টেকসই স্বদেশ প্রত্যবর্তনের আহ্বান অব্যাহত ভাবে করে আসছে। জাতিসংঘ এই প্রচেষ্টার প্রতি তার শক্ত সমর্থন অব্যাহত রাখবে।

জাতিসংঘের শরনার্থী সংস্থা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে গতকাল কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার মর্মান্তিক ঘটনায় তারা গভীর ভাবে মর্মাহত এবং বিষাদগ্রস্ত। তারা বলছে, “ আমরা কঠোরতম ভাষায় এই হত্যার নিন্দা করছি”।

“আমরা মুহিবুল্লাহর পরিবারের প্রতি এবং ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্প্রতদায়ের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আমরা এই ঘটনার অবিলম্বে তদন্ত শুরু করার এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি”।

জাতিসংঘের শরনার্থী সংস্থা. শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে।

সংস্থাটি শিবিরগুলিতে তাদের কর্মী সংখ্যা বাড়িয়েছে যাদে এটা নিশ্চিত করা যায় যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহযোগিতা প্রদান করা যায় এবং তারা তাদের উদ্বেগ জানাতে পারে।

সূত্র: voabangla.com

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন