যে ২ জনের ভূমিকায় বিচারের কাঠগড়ায় মিয়ানমার

fec-image

আইনের তোয়াক্কা না করে কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর চরম নিষ্ঠুরতা করে মিয়ানমার পার পেয়ে গেলেও এবার প্রথমবারের মত রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে গেছে আফ্রিকার ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গাম্বিয়া। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে মিয়ানমারকে দোষী প্রমাণিত করার চেষ্টায় গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মামাদু তাঙ্গারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

ইসলামি সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) কর্মরত সৌদি আরব ও বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ইসলামী সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) কর্মরত ওই দুই দেশের কূটনীতিকেরা জানান, নিজের দেশে ২২ বছরের স্বৈরশাসন, রুয়ান্ডার গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের আদালতে কাজের অভিজ্ঞতা আর সবার শেষে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর মা’রি তামবাদু মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে নেওয়ার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসেন।

নিউইয়র্কে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন, গাম্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মামাদু তাঙ্গারা অতীতে দুই দফায় জাতিসংঘে তাঁর দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই জানতেন। ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিও রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় তাঁর দেশের ভূমিকা রাখার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকেই এ সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আর আলোচনায় থেকেছে গাম্বিয়া। তৃতীয় দেশে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে নেওয়ার বিষয়টিও যে গাম্বিয়া ভাবছে তা বাংলাদেশকে জানিয়েছে দেশটি।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে গাম্বিয়ার ভূমিকা নিয়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ওআইসিতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি গোলাম মসিহ বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই গাম্বিয়া নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছে। ২০১৮ সালের প্রথম দিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনার একপর্যায়ে গাম্বিয়া স্পষ্ট করেই বাংলাদেশকে বলেছিল, দ্বিপক্ষীয়ভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না।

গত বছরের মে মাসে ঢাকায় ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর মা’রি তামবাদু তাঁর দেশের নেতৃত্ব দেন। ঢাকায় বৈঠকে বসার আগে তিনি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজার গিয়েছিলেন। পরে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছিলেন রুয়ান্ডার গণহত্যার সঙ্গে তিনি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার মিল খুঁজে পাচ্ছেন। কাজেই মিয়ানমারকে আদালতে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত সপ্তাহে তাদের এক বিশ্লেষণে বলেছে, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ইয়াহিয়া জামেহর ২২ বছরের স্বৈরশাসনের সময়ের নেতিবাচক ছবি আর রুয়ান্ডার গণহত্যার বিচারে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিশেষ সহকারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে মারি তামবাদু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন।

ওআইসির ভূমিকা: ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকেই মিয়ানমারের বি’রুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপের কথা ভাবতে শুরু করে ওআইসি। এ জন্য ইসলামী দেশগুলোর বৃহত্তম জোটটি আসিয়ানভুক্ত মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনেইকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এসব দেশ সেভাবে এগিয়ে আসেনি। অথচ রোহিঙ্গা ঢলের পরপরই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠে রয়েছে গাম্বিয়া। তাই ওআইসি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইনি পদক্ষেপ নিতে গাম্বিয়াকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ৩০ ও ৩১ মে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে গৃহীত ঢাকা ঘোষণার ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদে ওআইসির পক্ষে গাম্বিয়াকে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেয়।

ওআইসিতে কর্মরত বাংলাদেশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের শুরু থেকেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে গাম্বিয়া বিষয়টি ওআইসির বিভিন্ন ফোরামে তোলে। এরপর ওআইসি গাম্বিয়াকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার দায়িত্ব দেওয়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়।

রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি গাম্বিয়ার বানজুলে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গঠিত ওআইসির মন্ত্রিসভা বিষয়ক অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি এ নিয়ে আলোচনা করে। বাংলাদেশ, গাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, সুদান, তুরস্ক ও জিবুতি নিয়ে গড়া ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ওই কমিটির বৈঠকে একটি খসড়া প্রস্তাব আনে আফ্রিকার দেশটি। ওই প্রস্তাব মার্চে আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়।

ওআইসির অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনাসহ আইনি পদক্ষেপ নিতে এ পর্যন্ত গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার খরচ ধরা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় সৌদি আরব, তুরস্ক, কুয়েত, কাতারের পাশাপাশি বাংলাদেশও গাম্বিয়াকে ওই তহবিল সংগ্রহে সহযোগিতায় রাজি হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ওআইসি, মিয়ানমার, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন