রাজস্থলীতে কেন একের পর এক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে

fec-image

সন্ত্রাসীদের অভয়ারাণ্য হয়ে উঠেছে রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলা এবং কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নটি। বিগত কয়েকমাস ধরে প্রতিদিন এ এলাকায় ঘটছে খুন, গুম, চুরি-ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধ। এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ নিরাপত্তা চৌকি না থাকায় এসব অপরাধ হরহামেশা ঘটছে বলে নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি।

সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, রাজস্থলী উপজেলা এবং কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়ন অনেক দুর্গম হওয়ায় সন্ত্রাসীরা এ এলাকাকে তাদের অপকর্মের নিরাপদ রুট হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করছে। প্রতিদিন এ এলাগুলোতে কোনো না কোনো ঘটনা লেগেই থাকে। অনেক ঘটনা প্রশাসনের নজরেও আসে না। আর আসলেও ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক পর বা অনেক সময় ঘটনার পরের দিন প্রশাসন জানতে পারে।

নিরাপত্তা কাজে সংশ্লিষ্টরা জানান, এ এলাকায় বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান লিবারেশন আর্মির এক সময় আনাগোনা এবং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও বর্তমানে এ এলাকায় সন্তু গ্রুপের নেতৃত্বাধীন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসি জেএসএস), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক (বর্মা গ্রুপ), আরকান আর্মির সহযোগী মগ লিরাবেশন পার্টি এবং মগ লিরাবেশন পার্টি ‘সংস্কার’ নামের সংগঠনগুলো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। তাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনী সর্বদা যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এলাকা অনুযায়ী নিরাপত্তার যথাযথ স্থানে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপিত না হওয়ায় অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে বলে তাদের অভিমত।

এদিকে সরকারি তথ্য মতে জানা গেছে, রাজস্থলী উপজেলার উত্তরে কাপ্তাই উপজেলা, দক্ষিণে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলা এবং বান্দরবান সদর, পূর্বে বিলাইছড়ি উপজেলা এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলা। এ অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের আনাগোনাটা বেশি হয় মূলত বান্দরবান জেলার দুর্গম রোয়াংছড়ি উপজেলা হয়ে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে সন্ত্রাসীরা এ রুটকে নিরাপদ ভেবে চলাচল করে।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা গেছে, বিগত কয়েকমাস যাবৎ রাজস্থলী উপজেলা এবং কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নটি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চলতি বছরের গত ১৮ আগস্ট রাজস্থলী আর্মি ক্যাম্পের দক্ষিণে পোয়াইতুমুখ এলাকায় সেনাটহলের ওপর গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে সৈনিক মো. নাসিম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় মাইন বিষ্ফোরণে আরো সেনা কর্মকর্তা ও একজন সৈনিক আহত হন। এর আগে চলতি বছরের ৩ এপ্রিল দুই দল আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে রাজস্থলীতে ৭ সন্ত্রাসী নিহত হবার খবর জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ডেড বডি বা নিহতের চিহ্ন খুঁজে পায়নি।

এরপর ২৩ এপ্রিল একই উপজেলার গাইন্ধ্যা ইউনিয়ন মেম্বার ও জেএসএস ইউনিয়ন শাখা সাধারণ সম্পাদক মংক্যসিং মারমাকে অপহরণ করা হয় বলে এক বিবৃতিতে জেএসএস দাবি করে। ৩ মার্চ জেএসএস দাবি করে তাদের ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন নেতা শান্ত লাল তঞ্চঙ্গাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করেছে সন্ত্রাসীরা। তিনি পালিয়ে যাওয়ায় প্রাণে রক্ষা পান। গত ৯ অক্টোবর প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন আরেক জেএসএস নেতা অং সুই অং মারমা। নিহত হওয়ার সময় তিনি সামরিক পোশাক পরিহিত ছিলেন এবং তার লাশের পাশ থেকে একটি দেশীয় এলজি উদ্ধার করা হয়।

অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখে রাজস্থলী উপজেলার হেডম্যান দীপময় তালুকদারকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হলেও অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। স্থানীয়ভাবে ধারণা করা হয়, রাঙামাটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন আইনশৃঙ্খলা মিটিং বয়কট করার জন্য স্থানীয় একটি আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা ও বৈঠকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান তুলে ধরায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে ১৮ নভেম্বর রাজস্থলী উপজেলার গাইন্ধ্যা ইউনিয়নের বালুমোড়া এলাকায় অন্তর্দলীয় বন্দুকযুদ্ধে জেএসএসের তিন সদস্য নিহত হয়। অবশ্য জেএসএস এক বিবৃতিতে অন্তর্দলীয় বন্দুকযুদ্ধের কথা অস্বীকার করেছে। ২০ নভেম্বর রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দা ইউনিয়নের লংগদু পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একদল সন্ত্রাসী চাঁদার টাকা না পাওয়ায় বিদ্যালয় ভবন কাজে কর্মরত শ্রমিকদের বেধড়ক পিটিয়ে একজন সাব-ঠিকাদারসহ দু’জন শ্রমিককে আহত করেছে।

এদিকে সন্ত্রাসীরা চাঁদা না পেয়ে নভেম্বর মাসের ২১ তারিখে বিকেলে কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নের কৃষিফার্ম ভালুকিয়া সড়ক উন্নয়ন কাজে জড়িত ১০ জন শ্রমিকদের পিটিয়ে আহত করেছে। ২০ নভেম্বর দিনগত রাতে একই ইউনিয়নের হাফছড়ি এলাকায় তিনটি বাড়ি এবং একটি দোকান লুট করে সন্ত্রাসীরা। ২১ নভেম্বর দিনগত গভীর রাতে একই ইউনিয়নের মতিপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীরা ব্যাংক কর্মকর্তা উচিং মারমা এবং সেনা কর্মকর্তা সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার ক্যসুই অং মারমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে নগদ ২৫ লাখ টাকা, ৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করে পালিয়ে যায় এবং বাড়ির মালিক উচিং মারমাকে পিটিয়ে জখম করে।

মতিপাড়া এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা উচিং মারমা বলেন, সন্ত্রাসীদের প্রতিনিয়ত হুমকিতে ভয়ে থাকি। কখন প্রাণটা কেড়ে নিবে। বৃহস্পতিবার দিনগত গভীর রাতে সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতে ডাকাতি করতে আসলে তিনি বাধা দেওয়ায় সন্ত্রাসীরা তাকে বেধড়ক মারপিট করে। তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে আমরা মুক্তি চাই। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করতে পারছি না ভয়ে। সরকার যদি এ এলাকায় সুনজর দেয় এবং নিরাপত্তা জোরদার করে তাহলে সন্ত্রাসীরা এ এলাকায় অবস্থান নিতে পারবে না বলে যোগ করেন তিনি।

রাইখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এনামুল হক শামীম বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলা, নগদ টাকা ও মালামাল লুট করায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বারবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলার পরও কোনো কাজ হচ্ছে না। ঠিকই এসব সন্ত্রাসীরা রাতের বেলায় এসে হামলা করবে। তাই স্থানীয়রা মামলা করতে ভয় পাচ্ছে।

কাপ্তাই উপজেলার অধীন চন্দ্রঘোনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আশরাফ উদ্দীন জানান, আমরা যেখানে তথ্য পাচ্ছি সেখানে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। তবে এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একটু বেগ পেতে হয়। তিনি আরও জানান, মূল সমস্যা হলো সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এখানে কেউ মামলা দায়ের করে না। মামলা করলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো আরও সহজ হবে। মামলা করলে জীবনের নিরাপত্তা কে দেবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি ১০০ ভাগ

নিরাপদ থাকবে এটা কেউ বলতে পারবে না। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাহলে সন্ত্রাসীরা কোথায় আশ্রয় পাবে না। রাজস্থলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মফজল আহম্মেদ খান বলেন, সন্ত্রাসবাদ কোনো জাতির জন্য আর্শিবাদ নয়। আমরা প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং অভিযান অব্যাহত রেখেছি। পুলিশের এ কর্মকতা আরও বলেন, যেসব ঘটনায় কেউ মামলা করে না সেসব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করছে। তবে এজন্য স্থানীয় জনগণকে সচেতন এবং সহযোগিতা করার মনোভাব থাকতে হবে বলে যোগ করেন ওসি।

রাজস্থলী উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগের সভাপতি উবাচ মারমা বলেন, আমরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বলে যাচ্ছি এবং স্ব স্ব এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছি। সন্ত্রাসীরা এতো শক্তিশালী হয়নি যে রাষ্ট্রের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। চেয়ারম্যান আরও বলেন, প্রশাসনের একার পক্ষে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়; এজন্য স্থানীয়দের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে বলে যোগ করেন চেয়ারম্যান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক উপজাতীয় আওয়ামী লীগ নেতা পার্বত্যনিউজকে বলেন, যে আঞ্চলিক সংগঠনটি শান্তিচুক্তির ছাতা তলে থেকে রাজস্থলী-কাপ্তাই অঞ্চলকে দীর্ঘদিন আধিপত্য বিস্তার, সন্ত্রাসবাদ পরিচালনা ও চাঁদাবাজির অভয়াশ্রমে পরিণত করেছিলো, সাম্প্রতিক কিছু প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলে তাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাই মরিয়া হয়ে নানা নাশকতামূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ারও আহ্বান জানান এই নেতা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন