রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব?

fec-image

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মর্মে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে তো বটেই, জনমনেও ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সঙ্গত কারণে এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠাও কম নয়। (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন, ২৯ জুলাই, ২০২১ ও দৈনিক যুগান্তর, ৩০ জুলাই, ২০২১)।

এরই প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের তরফে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের কাছে এরকম সুনির্দিষ্ট কোনো সুপারিশ উপস্থাপন করেনি অর্থাৎ বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে স্পষ্টভাবে কিছু বলেনি; বরং রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশকে সহায়তায় বিশ্বব্যাংক কাজ করছে; তবে ‘রিফিউজি পলিসি রিফর্ম ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে যেটি শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশের শরণার্থী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত; এই প্রতিবেদনে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশগুলোতে সমাজে অন্তর্ভূক্ত করে নেবার ব্যাপারেও বেশ কিছু প্রস্তাব রয়েছে। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৩ আগস্ট, ২০২১)।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিবৃতির কূটনীতিসূলভ ভাষ্য (Diplomatic Jargon) এবং আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনায় এ কথা বলা যায় না যে, বিশ্বব্যাংক আদপেই শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশে নাগরিকত্ব দেয়ার প্রস্তাবনা ওই ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে রেখেছে।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার দাবী আকস্মিকভাবে উত্থাপিত হয়েছে বলে মনে হলেও বিষয়টি আদৌ তা নয়; এটি আন্তর্জাতিক মহলসহ দেশীয় অপরিণামদর্শী কিছু রাজনীতিক আর খোদ রোহিঙ্গাদেরও পুরনো দাবী।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার তরফে ১৯৯৭ সালেই ১৪,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অনুমতি অর্থাৎ নাগরিকত্ব দিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছিল। (সূত্র: Amnesty International, Rohingyas-The Search for Safety, September, 1997)। এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও কম যান না; তাঁরাও মিয়ানমারে তাঁদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা না থাকার অজুহাতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দাবী করেছেন বিভিন্ন সময়। (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ জুন, ২০১২)। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত মর্মে কিছু বেসরকারি সংস্থা আর এক শ্রেণির রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যেই অভিযোগ করা হয়। (সূত্র: ডেইলি স্টার, ২ মার্চ, ২০০৮)। ১১ জুলাই,২০১৯ তারিখে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ নামক একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত তাঁদের দলীয় অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার দাবী করেছিলেন সরকারের কাছে। (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ১২ জুলাই, ২০১৯)।

আশার কথা হলো এই, ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে এবং দেশীয় অর্বাচীন রাজনৈতিক দলের তরফে গোপনে বা প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার এই দাবী করা হলেও এ যাবত কোন সরকারই তাতে কর্ণপাত করেননি। এবারেও তা-ই হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগেভাগেই বিশ্বব্যাংকের ওই ফ্রেমওয়ার্ক প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এদেশে আত্মীকরণের কোন প্রশ্নই উঠে না। ( সূত্র: Daily Star, ৩১ জুলাই, ২০২১)।

বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের অনুসৃত তিন মূলনীতি হলো- প্রত্যাবাসন (শরণার্থীদের তাঁদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো), রিসেটলমেন্ট (শরণার্থীদের তাঁদের নিজ দেশ ও আশ্রয়দাতা দেশের বাইরে অন্য কোন তৃতীয় দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দেয়া) ও ন্যাচারালাইজেশান (শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশ কর্তৃক নাগরিকত্ব দেয়া)। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বেলায় বাংলাদেশ বোধগম্য কারণে বরাবরই প্রত্যাবাসনের উপর জোর দিয়ে এসেছে। মাঝে একটা সময় উন্নত নয়টি দেশে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে রিসেটলমেন্টের সুযোগ দেয়া হলেও এই সুযোগ নেবার আশায় সীমান্তের ওপার থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে এসে শরণার্থী হবে- এই আশংকায় রিসেটলমেন্ট প্রক্রিয়ার ইতি টানে বাংলাদেশ।

নাগরিকত্ব দেয়ার দাবী নাকচ করার পাশাপাশি অনাকাঙ্খিতভাবে আরও কয়েকটি বিষয়ে নজর দেবার প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশের। প্রথমত, ২০১৪ সালে নির্বাহী এক আদেশে নিষিদ্ধ করা হলেও এর আগে-পরে কালের পরিক্রমায় বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী নাগরিক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন; তাঁদের সন্তানাদিও হয়েছে, হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় বিবাহসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ আছে।দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা শরণার্থী দম্পতিরা বছরান্তে লাখো শিশুর জন্ম দিচ্ছেন আশ্রয়-শিবিরে, সেই শিশুদেরও জন্ম-সূত্রে নাগরিকত্বের বিষয়টি ভাবনার দাবী রাখে। কারণ, জন্ম-সূত্রে নাগরিকত্ব লাভের বিষয়টি আমাদের আইনে স্বীকৃত। (সূত্র: Daily Star, Star Weekend, ২০ অক্টোবর, ২০১৭)। তৃতীয়ত, অসংখ্য রোহিঙ্গা শরণার্থী ইতোমধ্যে উৎকুচের বিনিময়ে জন-প্রতিনিধি, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট হাতিয়ে নিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট বাগিয়ে কেবল সৌদি আরবেই পাড়ি জমিয়েছেন প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ জানুয়ারি, ২০২১)। এ নিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে একাধিক জেলায় মামলা দায়ের করা হয়েছে; স্বল্প সংখ্যক জাতীয় পরিচয়পত্রও করা হয়েছে বাতিল। এদিকে সৌদি কর্তৃপক্ষও গত মাস কয়েক ধরে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে সৌদিতে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চাপ দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। ফলে এই বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের সুস্পষ্ট নীতি ও দৃঢ় অবস্থান কাম্য।

মানবিক কারণে বারংবার নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিনিময়ে বিশ্ব মোড়লদের কৃপণ প্রশংসা আর অন্যায্য কূটনৈতিক চাপ ছাড়া বাংলাদেশের ভাগ্যে আর কিছু তেমন জুটেছে বলে মনে হয় না; বরং বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশের ভারসাম্য, জাতীয় কোষাগারের একটা বিশাল অংশ হারিয়ে আর শরণার্থীদের একাংশের নানাবিধ অপরাধ মোকাবেলা করে মূল্য চুকিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। তাই রোহিঙ্গাদের এদেশে স্থায়ী আবাসের যে কোন প্রস্তাবনার প্রতিরোধে সদা স্বক্রিয় থাকার পাশাপাশি দ্রুত প্রত্যাবাসনে সর্বপ্লাবী কূটনৈতিক কার্যক্রম হাতে নেয়াই এখন সময়ের দাবী।

মোহাম্মদ শাহজাহান: আইনজীবী, সুপ্রীম কোর্ট, বাংলাদেশ।
E-mail: [email protected]

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন