“সামরিক বাহিনী যে কোনো উস্কানির জবাব দিতে সবসময় প্রস্তুত”

fec-image

‘বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার অভাব নেই, তবে তারা যুদ্ধ চায় না। ‘আন্তঃসীমান্ত গোলাগুলির মধ্যে একথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমার বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না, তবে তার সামরিক বাহিনী সবসময় যে কোনো উস্কানির জবাব দিতে প্রস্তুত। ঢাকায় বর্তমান অনুপ্রবেশ নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করার পর বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও কোস্টগার্ড এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিয়ানমারকে নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন।

সেখানে তিনি বলেন, ‘আমরা বেশ কিছু উস্কানিমূলক কার্যকলাপ দেখেছি। আমরা মনে করি আরাকান আর্মি (মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী) অভ্যন্তরীণ সংঘাতে লিপ্ত, এবিষয়ে বাংলাদেশের এখনই কোনো ভূমিকা নেই।” বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ বুধবার একটি পৃথক কর্মসূচিতে বলেছেন যে, তার কর্মীরা প্রয়োজনে মিয়ানমারকে জবাব দিতে প্রস্তুত রয়েছে। মিয়ানমারের ক্রমাগত মর্টার শেলিং, গুলিবর্ষণ এবং ড্রোন হামলার জেরে বান্দরবান জেলায় একজন রোহিঙ্গার মৃত্যু এবং বেশ কয়েকজন আহত হবার পর শফিউদ্দিন বলেছেন যে, তিনি ইতিমধ্যেই তার মিয়ানমারের প্রতিপক্ষকে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছেন।

ঢাকা সেনানিবাসে এক বক্তৃতায় জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন -”প্রয়োজনে আমরা সাড়া দিতে প্রস্তুত। এটা সত্যি, আমি আমার সকল স্টেকহোল্ডারের সাথে যোগাযোগ করছি’। মিয়ানমার বাহিনী সীমান্তে বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই করছে বলে সম্প্রতি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে গোলা বর্ষণ হয়েছে। মিয়ানমারের বিমান ও হেলিকপ্টারও বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে আশ্রয় নেওয়া এক রোহিঙ্গা কিশোর শেল বিস্ফোরণে মারা যায় এবং ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে একজন বাংলাদেশি একটি পা হারান।

বান্দরবানের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা বলেছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শান্ত থাকার আহ্বান সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় তারা আতঙ্কে রয়েছেন। গত বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আরাকান রাজ্যে দুটি হামলা চালায় মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী। যার ফল ভালো হয়নি। আরাকান বাহিনীর হাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ১৯ সেনা নিহত হয়েছে। ধাওয়া খেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় মিয়ানমার বাহিনী। মিয়ানমারও থাই সীমান্তে দুটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে। থাই সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে।

কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সীমান্তে মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে মিয়ানমার। বাংলাদেশ সরকার দুই দফায় এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে। আরাকানের প্রসঙ্গে আসা যাক। আরাকান আর্মি (AA) রাখাইন রাজ্য (আরাকান) ভিত্তিক একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। ১০ এপ্রিল ২০০৯-এ প্রতিষ্ঠিত, AA হলো ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান (ULA) এর সামরিক শাখা। বর্তমানে এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন কমান্ডার ইন চিফ মেজর জেনারেল তোয়ান মারাত নাইং এবং ভাইস ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিও তোয়ান অং। কাচিন সংঘাতে, এএ কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) এর সাথে তাতমাডো (মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী) এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। বেশিরভাগ AA সৈন্যরা মূলত কেআইএ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষিত ছিল। ২০১৪ সাল থেকে AA রাখাইন রাজ্যে নিজস্ব প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেছে।

মায়ানমার পিস মনিটরের মতে, AA-এর ২০১৪ সালে ১,৫০০এরও বেশি সৈন্য ছিল, যার মধ্যে মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে রাখাইন রাজ্যে নিযুক্ত কর্মীও ছিল। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে AA-এর বেসামরিক শাখায় ২,৫০০ এরও বেশি সৈন্য এবং ১০,০০০ কর্মী ছিল। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে AA প্রধান দাবি করেছিলেন যে, এই গোষ্ঠীর ৩০,০০০ এরও বেশি সৈন্য রয়েছে। আরাকান আর্মি (AA) গঠিত হয়েছিল ১০ এপ্রিল ২০০৯-এ তার রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান (ULA) নিয়ে। এটি কাচিন রাজ্যকে লাইজাইয়ের ‘অস্থায়ী সদর দফতর’ হিসাবে গড়ে তোলে।

১১ ডিসেম্বর ২০১১-এ তরুণ আরাকান আর্মি সৈন্যদের প্রশিক্ষণের পর দলটি আরাকান রাজ্যে ফিরে যাওয়ার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করার পরিকল্পনা করেছিল। ২০১১ সালের জুনে কাচিন রাজ্যে যুদ্ধের প্রাদুর্ভাব তাদের অক্ষম করে তুলেছিল। ফলে কেআইএর সমর্থনে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। ২০১৪ সালে, AA বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে রাখাইন রাজ্যে এবং থাই-মিয়ানমার সীমান্তের কাছে আরেকটি অভিযান শুরু করে। ফলস্বরূপ এটি অনেক শক্তিশালী হয়েছে এবং এর যুদ্ধ ক্ষমতা ক্রমেই বেড়েছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে AA মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনালিটিজ ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (MNDAA) এবং তার সহযোগী তাইং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (TNLA) এর সাথে লড়াই করেছিল। সংঘর্ষে শত শত তাতমাদ সৈন্য নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

২০১৫-র ২৭ অগাস্ট AA এবং বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ফোর্সের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। বান্দরবান জেলার থানচির বড় মোদক এলাকায় মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়েছে। ২০১৫-এর ২০ আগস্ট আরাকান আর্মি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তখন তাদের দশটি ঘোড়া আটক করে বিজিবি। আরাকান আর্মি স্পষ্টতই বহু-জাতিগত আরাকানি জনসংখ্যার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ, আরাকান জনগণের জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষা এবং প্রচার, আরাকান জনগণের ‘জাতীয় মর্যাদা’ এবং সর্বোত্তম স্বার্থকে সমর্থন করে।

২০২১ সালের আগস্ট মাসে পরিচালিত আরাখা মিডিয়া (AKK) এর সাথে একটি সাক্ষাত্কারে, আরাকান সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হলো আরাকানের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা। এ বিষয়ে কোনো দর কষাকষি হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। মিয়ানমার একটি অস্থিতিশীল দেশ। সেখানে বারবার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের চিত্র মিয়ানমারের বুকে বারবার লেখা হয়েছে। মিয়ানমারে সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের ইতিহাসও পুরনো। ১৯৯০ সাল থেকে চীন, রাশিয়া ও ইউক্রেনসহ বেশ কয়েকটি দেশ মিয়ানমারকে সামরিক সহায়তা দিতে শুরু করে। ভারতকে চাপে রাখতে মিয়ানমারের কাছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি করছে চীন।

‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ এবং ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ডটকম’ সূত্র বলছে যে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আকার ৫ লক্ষ ১৬ হাজার। যার মধ্যে ৪৬,০০০ নিয়মিত এবং ১ লক্ষ ১০ হাজার রিজার্ভ সৈন্য রয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের কাছে ১২৭টি যুদ্ধবিমানসহ মোট ২৬৪টি সামরিক বিমান, ৯টি অ্যাটাক হেলিকপ্টারসহ ৮৬টি হেলিকপ্টার, ৮৮৬টি অত্যাধুনিক ট্যাংক, ৪ হাজার ২১২টি বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র, ১ হাজার ২০০টি সাঁজোয়া সামরিক যান, আকাশ প্রতিরক্ষায় কমপক্ষে ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এছাড়াও ১২০০টি অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক অস্ত্র, ২৭ টি নৌ ফ্রিগেট, ৪০ টি টহল ক্রাফটসহ মোট ১৫৫টি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে ।

বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রতিরক্ষা খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। বর্তমানে বাংলাদেশ তার সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ একটি সেনানিবাস সম্প্রসারণ করেছে, সাবমেরিন অধিগ্রহণ করেছে এবং কক্সবাজারে একটি বিমান ঘাঁটি তৈরি করছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে মিয়ানমার অস্ত্র সংগ্রহের দিকে মনোনিবেশ করেছে। নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি স্বাক্ষরের পরও তারা অস্ত্র কেনা বন্ধ করেনি। ২০১২ সাল থেকে মিয়ানমারের জন্য অস্ত্র কেনা সহজ হয়েছে। এরই মধ্যে রাশিয়া, চীন, ইসরাইল, ইউক্রেন, ভারত, বেলারুশ, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি করেছে। সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে চীন ইতোমধ্যে মিয়ানমারকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা দিয়েছে। তারা মিয়ানমারের কাছে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ ও গোলাবারুদ বিক্রি করেছে। পিছিয়ে নেই রাশিয়া ও ইউক্রেনও। মিয়ানমারের কাছে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধজাহাজ বিক্রি করেছে। অন্যদিকে, ইসরাইল ট্যাঙ্ক এবং সাঁজোয়া কর্মী বহনকারী বাহন বিক্রি করেছে। এ নিয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে আল জাজিরা। তাদের তথ্য অনুযায়ী চীন থেকে সবচেয়ে বেশি বিমান কিনেছে মিয়ানমার ১২০টি, রাশিয়া ৬৪টি এবং পোল্যান্ড ৩৫টি। রাশিয়া (২৯৭১), চীন (১০২৯) এবং বেলারুশ (১০২) মিয়ানমারের কাছে সবচেয়ে বেশি ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে। চীন (২১), ভারত (৩) এবং সাবেক যুগোস্লাভিয়া (৩) মিয়ানমারের কাছে নৌ যুদ্ধজাহাজ বিক্রি করেছে। চীন (১২৫), সার্বিয়া (১২০) এবং রাশিয়া (১০০) বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ, কামান বিক্রি করেছে। মিয়ানমারের কাছে সাঁজোয়া যান এবং ট্যাংক চীন (৬৯৬) , ইসরায়েল (১২০) এবং ইউক্রেন (৫০ ) বিক্রি করেছে।

মিয়ানমারের উগ্র মনোভাব থাকলেও তাদের সামরিক কৌশল নিম্নমানের। শক্তির ভিত্তিও দুর্বল। অনেকেই বলছেন, মিয়ানমার যুদ্ধের খেলায় মেতেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তারা এই খেলায় অংশ নিতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চায় না। বাংলাদেশের নীতি হলো- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখা। তাই বাংলাদেশকে দুর্বল ভাবা ঠিক নয়। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এখন বিশ্বমানের। বাংলাদেশের পদাতিক বাহিনী এতটাই উন্নত যে, এটি বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি হবার যোগ্যতা রাখে । আর তাই বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে দুর্বল মনে করলে মিয়ানমার অত্যন্ত বোকামি করবে।

সূত্র : eurasiareview.com
অনুবাদে : সেবন্তী ভট্টাচার্য্য

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন