২০১৪ সালে উপজাতীয় সন্ত্রাসী দলগুলোর আন্তঃ সংঘাতে খাগড়াছড়িতে ১২ খুন গুলিবিদ্ধ ১০ অপহরণ ১৪

মংসজাই মারমা জাপান

মুজিবুর রহমান ভুইয়া :

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পরেও পাহাড়ী জনপদে প্রকৃত শান্তি সুচিত হয়নি। বরং চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে নতুন নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। একাধিক পাহাড়ী সংগঠনের দৌরাত্ম সবুজ-শ্যামল পাহাড়ী জনপদকে রক্তাক্ত করেছে। আধিপত্য বিস্তার, আভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে আন্তঃসংঘাতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে লাশের মিছিল। গেল বছরে ৬ ডিসেম্বর সিরিজ হামলাসহ সবচেয়ে বেশি সংঘাতের ঘটনা ঘটে পাহাড়ী জনপদ খাগড়াছড়িতে।

এর আগের বছর ২০১৩ সালে পাহাড়ী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর আন্তঃ সংঘাতে ২২জন খুন, ১৩ জন গুলিবিদ্ধ ও ১০জন অপহরনের শিকার হলেও গেল বছর খাগড়াছড়িতে আন্তঃসংঘাতে খুন হয়েছে ১২ জন, গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১০জন আর ১৪ জন অপহৃত হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৪ সালে চুক্তিবিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ‘র ৪ জন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি‘র-জেএসএস (সন্তু লারমা) ২ জন, আওয়ামীলীগ‘র ২ জন এবং ৪ জন নিরীহ মানুষ খুন হয়েছে। পৃথক পৃথক ঘটনায় ৪টি ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি‘র-জেএসএস (সন্তু লারমা) ১ জন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি‘র-জেএসএস (সন্তু লারমা) ১ জন, এবং সাধারণ মানুষ ৩ জন। আর বিভিন্ন সময়ে অপহরণে শিকার হন ১৪ জন।

0603

২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারী জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি নবরঞ্জন ত্রিপুরা (৪২)-কে বাড়ী থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর কিছুদিন পর ১৯ ফেব্রুয়ারী অপহরণের পর বাবুছড়া ইউনিয়নের রুকচন্দ্র কার্বারী পাড়ার মৃত দিবাকর চাকমার ছেলে মিন্টু বিকাশ চাকমা (৩৫) ওরফে মিনু চাকমা নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার ১১দিনের মাথায় ১ মার্চ শনিবার একটি জুম ক্ষেতের পাশে তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়।

গেল বছরের ৩ জানুয়ারী খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গিরিফুল এলাকা থেকে অপহরণ করার ৫ ঘন্টা পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) যুগ্ম-সম্পাদক ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মৃনাল কান্তি ত্রিপুরা‘র স্ত্রীসহ ৭ জনকে ছেড়ে দিয়েছে অপহরণকারীরা।

২৪ ফেব্রুয়ারী দীঘিনালার বাবু পাড়া এলাকায় নিহারু চাকমা (৩৫) নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) কর্মী ও চাঁদা কালেক্টর গুলিবিদ্ধ হয়।

১ মার্চ সকালে বাবুছড়া ইউনিয়নের জারুলছড়ি এলাকার শুকনাছড়ি গ্রামের শান্তিময় চাকমা‘র ছেলে চিগলু চাকমা (২২) নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

একই বছরের ৯ মার্চ দীঘিনালার বাবুছড়া এলাকায় মগ্যা কার্বারী পাড়া এলাকার মৃত নিতাই চাকমার ছেলে সুদৃষ্টি চাকমা (৩৭) নামে এক ইউপিডিএফ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একই ঘটনায় হৃদ্ধি চাকমা (৩৩) নামে এক ইউপিডিএফ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়।

৫ মার্চ খাগড়াছড়ির দূর্গম লক্ষীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ির এলাকা থেকে স্থানীয় হেডম্যান সাথোয়াই প্রু মারমা সহ তিনজনকে অপহরণ করে দূর্বৃত্তরা। অপহৃত অন্য দুই জলেন বসু মেম্বার ও তুফান চাকমা।

খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষীছড়ির বেলতলি এলাকায় প্রতিপক্ষের স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি‘র (জেএসএস-সন্তু গ্রুপ) নারায়ন মারমা (২৫) নামে এক সমর্থক নিহত হয় ৫ এপ্রিল। একই ঘটনায় জীতেন চাকমা (২০) নামে এক যুবক আহত হয়।

এ ঘটনার সাত দিনের মাথায় ১২ এপ্রিল খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোন ছড়া ইউনিয়নের বরইতলী এলাকায় পানছড়ি গ্রামের মৃত নলমনি চাকমার ছেলে নতুন কুমার চাকমা ওরফে কারণ (৪৮) ও রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নের মাচালং‘র বসন্ত চাকমার ছেলে প্রতুলময় চাকমা ওরফে রকেট (৩০) নামে দুই ইউপিডিএফ কর্মী নিহত হয়।

তার কয়েকদিনের মাথায় ১৯ এপ্রিল লক্ষীছড়ি উপজেলার জুর্গাছড়ি নামক এলাকায় অস্ত্রধারীদের গুলিতে জয়কুমার চাকমা (৪৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় কল্পরাণী চাকমা (১২) নমে এক স্কুল ছাত্রী গুলিবিদ্ধ হয়।

সালতামামি

২ জুন মহালছড়ির বড়ইছড়ি এলাকায় অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের বড়ইছড়ি গ্রামের মৃত সুর্য কুমার চাকমার ছেলে জ্যোতি ময় চাকমা (৩৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়।

গেল বছরের ৬ জুলাই মাটিরাঙ্গার ব্যাঙমারা থেকে নির্মানাধীন একটি ব্রিজের সাইট থেকে অপহরণ করা হয় ৪ নির্মান শ্রমিককে। অপহৃতরা হলেন, বোলড্রোজার চালক রাজু মিয়া, সহকারী হাসান, এস্কেলেটর চালক মো: ফারুক মিয়া, ও নির্মাণ শ্রমিক লিয়াকত আলী। অপহরণের ১১ দিন পর মহালছড়ি উপজেলার পঙ্খীমুড়া এলাকা থেকে অপহৃতদের উদ্ধার করা হয়।

১৮ জুলাই মানিকছড়ির কুমারী এলাকায় জেএসএস (সন্তু লারমা) ও ইউপিডিএফ‘র মধ্যকার বন্দুকযুদ্ধে ১জন নিহত ব্যক্তি নিহত হয়েছে। নিহত ব্যাক্তি ইউপিডিএফ সমর্থক বলে জানা গেছে। একই ঘটনায় শান্তি চাকমা (২০) ও আনন্দ চাকমা (৩০) নামে ২জন গুলিবিদ্ধ হয়। আহতরা জনসংহতি সমিতির কর্মী বলে জানা গেছে।

একই বছরের ৫ আগস্ট দীঘিনালার বাবুছড়ার ধনপাতা মৌজার হেডম্যান অজিত তালুকদার (৩৬)-কে নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে খুন করে সন্ত্রাসীরা। ঘটনার পর দিন সকালে পার্শ্ববর্তী সেগুন বাগান থেকে অজিতের গুলিবিদ্ব লাশ উদ্ধার করে তার স্বজনরা।

উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের আন্তঃসংঘাতের সর্বশেষ বলি হয়েছেন মানিকছড়ি কলেজিয়েট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও মানিকছড়ি উপজেলা আওয়ামলীগের সহ-সভাপতি চিংসামং চৌধুরী। গেল বছরের ৬ ডিসেম্বর রাতে মানিকছড়ি বাজারের রাজপাড়ায় জেএসএস সভাপতি মংসাথোয়াই মারমার বাড়িতে প্রবেশ করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা এলোপাথারি গুলি করলে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। একই ঘটনায় মানিকছড়ি উপজেলা জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সভাপতি মংসাজাই চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গেল ১৬ ডিসেম্বর তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

পানছড়িতে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের গুলিতে স্বামী-স্ত্রী গুরুতর আহত হয় রমজান আলী (৫৫) তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৪০)। রমজান আলী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের নেতা বলে জানা গেছে। এদিন ৮টার দিকে একদল অস্ত্রধারী তার বাড়ীতে ডুকে অতর্কিতভাবে গুলি চালায়। একই দিন জেলার মাটিরাঙ্গার অদুরে ধলিয়া ব্রিজের সন্নিকটে প্রতিপক্ষের অস্ত্রধারীদের গুলিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি‘র (এমএন লারমা) সংগঠক আশুতোষ চাকমা গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ আশুতোষ ত্রিপুরা মাটিরাঙ্গা উপজেলার তপ্তমাষ্টার পাড়ার অন্নশষী ত্রিপুরার ছেলে।

চুক্তিবিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ‘র প্রচার ও প্রকাশনা সেলের প্রধান নিরন চাকমা‘র দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি পার্বত্যনিউজকে বলেনন, এ বছর খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে আমাদের ১৩ জন কর্মী-সমর্থককে খুন করা হয়েছে। একই সময়ে ১০ জন গুলিবিদ্ধ এবং ৪ জনকে অপহরণ করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি‘র (সন্তু লারমা) সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা‘র দেয়া তথ্য মতে, খাগড়াছড়িতে চলতি বছর তাদের ৩ জন সমর্থক খুন, ৭ জন অপহরণ এবং ১জনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার শেখ মো: মিজানুর রহমান জানান, প্রতিটি হত্যাকান্ডই সংঘতি হয়েছে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার, চাদাঁবাজি, এবং মাঠ দখলের জন্যই। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে কোন অভিযোগ না করার কারণে এসব ঘটনায় পুলিশের করার কিছুই থাকেনা। এমনকি পুলিশ গেলেও তারা কোন তথ্য দিতে চায় না । আর নিহতদের অধিকাংশই সন্ত্রাস ও চাদাঁবাজির সাথে সম্পৃক্ত। তবে এ সব ঘটনাকে খাগড়াছড়ির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বলেও মানতে নারাজ জেলা পুলিশের এ শীর্ষ কর্তা ব্যাক্তি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন