সম্প্রীতির বান্দরবানে এখন অশান্তির কালো মেঘ
সম্প্রীতির বান্দরবানে এখন অশান্তির কালো মেঘ। পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে বান্দরবান ছিল তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ অঞ্চল।
১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির আগে থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়ি জেলাটিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ বসবাসের কারণে পর্যটন শিল্প বিকশিত হতে থাকে। শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা কম ছিল।
এখন চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক পাচারে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বান্দরবানের দিকে বেশি ঝুঁকছে।অরক্ষিত সীমান্তে অবাধে ঢুকছে অস্ত্র। মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবার মতো যুব সমাজ ধ্বংসের মাদক।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিবাদমান গ্রুপগুলো বান্দরবানে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এতে করে হানাহানির সূচনা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনী বান্দরবানে নিরাপত্তা জোরদার করছে ।
বান্দরবানে ১৩ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাস রয়েছে। তাদের মধ্যে মারমা সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় তাদের আধিপত্য বেশি।
অবশ্য বান্দরবানে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশ বাঙালি। তবে সবগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করার কারণে বান্দরবানকে বলা হতো ‘সম্প্রীতির বান্দরবান’। এখন বান্দরবানে রাজনৈতিক হত্যার পাশাপাশি চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে।
সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে চাঁদা না দিয়ে সড়ক নির্মাণসহ কোনও উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া যায় না। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সাধারণ নাগরিক, যানবাহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মালিকাধীন বিভিন্ন বাগান, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারি, ঠিকাদার প্রমূখের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে।
বান্দরবানে প্রতি বছর একশ’ কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। যে কোনও উন্নয়ন কাজ করতে গেলে তারা বাধা দেয়। চাঁদার জন্য ঠিকাদার কাজ করতে পারে না।
বান্দরবানে উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি বিপুল সম্পদের সমাহার রয়েছে। বিপুল পরিমাণ বাঁশ, কাঠ, পাথর এ অঞ্চলে থাকায় এসবের ব্যবসাতেও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে হানাহানি হচ্ছে।
অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে বান্দরবানে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এখানে রয়েছে নীলগিরি, আলীকদম, চন্দ্রমুখি পাহাড়, চিম্বুক, স্বর্ণমন্দির প্রভৃতি সুন্দর স্থান।
এসব স্থান দার্জিলিংসহ বিশ্বের অনেক পর্যটন স্থানের চেয়ে বেশি সুন্দর। কিন্তু ভালো পর্যটন অবকাঠামো নেই। নীলগিরিতে প্রতিদিন এক হাজার পর্যটক আসেন। কিন্তু সেখানে রিসোর্টে মাত্র ২০ জন পর্যটক রাত্রিযাপন করতে পারেন।
এমন বাস্তবতায় ২০১৫ সালে নীলগিরির পাশে চন্দ্রপাহাড়ে ২০ একর জায়গাজুড়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬ সালের ১২ জুন আর্মী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সঙ্গে আরএনআর গ্রুপ পাঁচ তারকা ম্যারিয়ট হোটেল স্থাপনে চুক্তি করে।
হোটেলটিতে প্রায় ২০০ জন অতিথি থাকতে পারবেন। সম্প্রতি হোটেলের নির্মাণ কাজ শুরু হলে পাহাড়ি গ্রুপগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে। পাহাড়ি গ্রুপগুলো যেসব অভিযোগ তুলে বিরোধিতা করছে; নিরাপত্তা কর্মকতারা এসব অভিযোগকে কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ে উন্নয়ন হলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে বিধায় তারা পাঁচতারা হোটেল নির্মানে বাধা দিচ্ছে ।
পার্বত্য অপর দুই জেলায় মধ্যে চাকমা সম্প্রদায়ের জনসংখ্যায় প্রাধান্য থাকলেও বান্দরবান প্রধানত মারমা সম্প্রদায়ের আধিপত্য রয়েছে।
এখন চাকমা গোষ্ঠী ওই জনপদে আধিপত্য নেয়ার লক্ষে নতুন বসতি স্থাপনসহ সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু করেছে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস বান্দরবানের কাছে চাকমাদের ৪০ পাড়া গড়ে তোলে বসতি স্থাপন করছে।
এ নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। মারমাদের মগ লিবারেশন পার্টি চাকমাদের চ্যালেঞ্জ করছে। বান্দরবানের সঙ্গে মিয়ানমারের ১৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ভারতের আছে ৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত।
বান্দরবানের সঙ্গে সীমান্তের মধ্যে ২৮ কিলোমিটার সীমান্ত অরক্ষিত আছে। এখানে কোনও প্রহরা নেই। ফলে এ পথে অবাধে অস্ত্র বান্দরবানে ঢুকছে। পাহাড়, জঙ্গল, খাল হওয়ার কারণে দুর্গম এলাকায় টহল দেয়া যায় না।
রোহিঙ্গা সংকটের কারণেও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত থাকায় বান্দরবান অঞ্চলটি নিরাপত্তার দিক দিয়ে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।
সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় সরকার বান্দরবানে নিরাপত্তা জোরদার করছে। ইতোমধ্যে এক প্লাটুন র্যাব মোতায়েন করেছে। মোতায়েন হচ্ছে এপিবিএন।
আরও কীভাবে নিরাপত্তা জোরদার করা যায় তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামের গোটা সীমান্তে ১০৩৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে।এতে সীমান্তে টহল জোরদার করা যাবে।
সূত্র : দৈনিক যুগান্তর