চকরিয়ায় গ্রামীণ জনপদে ফিরেছে ঐতিহ্যের সংস্কৃতি: চলছে হারবাংয়ে ঘোড়দৌড় মেলা

চকরিয়া প্রতিনিধি:

কক্সবাজারের চকরিয়ায় উপজেলার হারবাংয়ে ব্যাপক আয়োজনে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যের পুরানো সংস্কৃতি ঘোড়দৌড় মেলা। ৩ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এ মেলা শুরু হয়েছে, চলবে সপ্তাহব্যাপী। মেলায় যদিও জীবন্ত কোন ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা নেই, তবু শতবছরের পুরানো ঐতিহ্যের সংস্কৃতির মেলবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন গ্রাম বাংলা নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। মেলায় বসেছে নাগরদোলা, মাটির তৈরি খেলা সামগ্রী, খাবার ও কসমেটিক বিক্রির একাধিক দোকান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে এসব দোকানে বিপুল ক্রয়বিক্রয়। ছোট্ট শিশুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে নাগরদোলা।

চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহি ঘোড়দৌড় মেলার ইতিহাস এতদাঞ্চলের মানুষের কমবেশি জানা। ইতিহাস মতে, প্রকৃতির লীলা নিকেতন সাগরতনয়া কক্সবাজার জেলার বন-বনানী পাহাড় বেষ্টিত প্রাকৃতিক সম্পদের ভরপুর চকরিয়া উপজেলার কাকারা একটি এতিহ্যবাহী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের প্রপার কাকারার মরহুম মাওলানা বদিউজ্জামান চৌধুরী ১৯০৬ সালে বিনোদনের জন্য ঘোড়দৌড় মেলার প্রবর্তন করেন।

মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামীবাদী ঘনিষ্ট সহযোগী চকরিয়া, উপজেলা কাকারা গ্রামে এক ধর্নাঢ্য পরিবারে ১৮৪৬ খিষ্টাব্দে আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ বদিউজ্জামান চৌধুরী আলকাদেরী জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপান্তে বদিউজ্জামান আলকাদেরী ভারতের উত্তর প্রদেশের রামপুর আলেয়া মাদ্রাসায় টাইটেল ডিগ্রি অর্জন করেন। এলাকার লোকজনকে চিত্র বিনোদনের জন্য মরহুম মাওলানা আল কাদেরী ১৯০৬ সালে ইসলামী বাজার নামে একটি মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী এই ইসলামী বাজার ঐতিহাসিক ঘোড়দৌড় মেলা নামে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিবছর এই মেলা চট্রগ্রাম ও কক্সবাজারের লোকদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে উঠে। রাত্রে বহু দুর দুরান্ত থেকে ছেলে/মেয়েরা এই মেলায় এসে বছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে।

জানতে চাইলে মেলার পুরানো দিনের স্মৃতি তুলে ধরে বর্তমান কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত ওসমান বলেন, তখনকার দিনে প্রচুর ঘোড়া ছিল এবং মেলায় ঘোড়ার উপস্থিতি ও দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল একটি বিষ্ময়কর ব্যাপার। হাজার হাজার লোক বিশেষ করে আশপাশের পাহাড়ি রাখাইন, চাকমা , বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন মেলায় আসতে বেশি উৎসাহী ছিলেন। পাহাড়ের চূড়া, গাছের ডালে ও উচুঁ জায়গায় দাঁড়িয়ে এই দৌড় প্রতিযোগিতা দৌড় প্রত্যক্ষ করত। তিনি বলেন, তখনকার সময়ে এলাকার প্রতাপশালী ব্যক্তি মোস্তাক মিয়া নিজে শুধু একটি ছোট বেত নিয়ে পুরা মেলা এলাকার লক্ষাধিক লোকের সমাগমে পুরাপুরি নিয়ন্ত্রন করত। ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে বড় বড় দোকান পাট কাকারা ঘোড়দৌড় মেলায় এসে দু’তিন দিন আগে থেকে জমা করা হত। বর্তমানে মেলাটি প্রায় আট-দশবছর ধরে বন্ধ রয়েছে। সেই কারণে মেলার জৌলুসও হারাতে বসেছে নতুন প্রজন্মের লোকজন।

জানা গেছে, কাকারা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় মেলায় একসময় বেশি বিক্রি হতো বড় বড় তামার ডেস্কি, কম্বল, বাসন-কোসন, কাপড়-চোপড়, বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। মেলায় বসতো সার্কাস, পুতুল নাচসহ বিভিন্ন রকমের বিনোদনমুলক প্যাভলিয়ন। পাশপাশি কাকারা, চিরিঙ্গা, মহেশখালীর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরি করে মেলায় বিক্রি করতো। অন্তত শতাধিক মিষ্টান্ন দোকানে ভরপুর থাকতো মেলা প্রাঙ্গণ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে প্রতিজনের হাতে দেখা যেত মিষ্টান্ন ভর্তি পাতিল নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যেতে। প্রচার আছে, মিষ্টান্ন ভর্তি এই পাতিল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অষ্ণলের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট পাঠানো হতো। এমনকি মেলা উপলক্ষে ছয়মাস আগে ছেলে- মেয়েরা বাড়িতে বাঁশের পুলের মাঠির টোয়াশায় (ব্যাংক) তৈরি করে বা অন্যখানে টাকা-পয়সা জমা করে রাখত। যাতে ওই টাকা নিয়ে তারা মেলায় আসতে পারে। মেলা উপলক্ষে স্থানীয় কাকারা শাহ ওমর (রা:) মাজারে মিলাদ, ওরশ ও তবারুক বিতরণ করা হতো। সারারাত চলতো জিকির, কাউয়ালী গান।

উদাহরণ আছে, মেলা চলাকালে চকরিয়া উপজেলা ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা কাকারা ইউনিয়নে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আগে থেকে মেহমান হিসেবে উপস্থিত হতো। ওইসময় মেহেমানদের জন্য যাবতীয় খাবার যোগাড় করে রাখত স্থানীয় পরিবার গুলো। এলাকায় প্রবাদ আছে, কাকারা ইউনিয়নের কোন মেয়ে অনত্র বিয়ে দিলে মেলার সময় তাকে অবশ্যই নাইয়র (বাপের বাড়িতে বেড়াতে পাঠাতে) দিতে হবে এবং এই কথাটি বিয়ের সময় কাবিননামায় লিখা থাকতো। প্রতিবছর শীতকালের শুরুতে পৌষমাসের মাঝামাঝি সময়ে অন্তত সাত দিন ধরে চলতো এই মেলা।

গ্রামীণ জনপদের অসম্ভব জনপ্রিয় এই আয়োজনটির ফলে মেলার ঐতিহ্য ও গুরুত্ব নতুন প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত। শতবছরের ঘোড়দৌড় মেলাটি না হওয়ার ফলে দিনদিন জৌলুসও হারাতে বসেছে। এ অবস্থায় বিগত কয়েকবছর ধরে চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের স্থানীয় সংস্কৃতিপ্রেমী কিছু মানুষের বদৌলতে প্রবর্তন করা হয়েছে হারবাংয়ের ঘোড়দৌড় মেলাটি। প্রতিবছর শীতকালের শুরুতে পৌষ মাসের মাঝ সময়ে শুরু হয় মেলার আনুষ্ঠানিকতা। তবে হারবাংয়ের মেলাটি অপেক্ষাকৃত ছোট ও লোক সমাগম ঘটে অপ্রতুল।

হারবাংয়ের ঘোড়দৌড় মেলা বিষয়ে মেলার আয়োজক কমিটির সমন্বয়ক লিটন ও মুজিবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে বলেন, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে শীতকালের শুরুতে পৌষমাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে এই মেলা শুরু করা হয়। প্রতিবছর ন্যায় চলতি বছরেও অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশের মধ্যদিয়ে এ মেলা আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। মেলাটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানে কোন ধরণের অশ্লীল নাচ-গানের অনুষ্ঠান ব্যতিত সপ্তাহব্যাপী চলে এ মেলা। এটা পৌষ মেলা হিসেবে প্রথমে চালু করলেও বর্তমানে ঘোড়দৌড় মেলা হিসেবে গ্রামীণ জনপদে খুবই পরিচিত। মেলায় বৃদ্ধা থেকে শুরু করে শিশু-কিশোরসহ সকল শ্রেণি পেশার লোকজন এ মেলায় কেনা কাটা করতে বিপুল পরিমাণ সমাগম ঘটে বলে জানান।