আরাকান রণাঙ্গনে নতুন যুদ্ধ: মিয়ানমারকে চাপে রাখতে হবে

fec-image

ডেটলাইন। ওয়ালিটং পাহাড়, উত্তর মংডু, আরাকান। ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২। সকাল ৮ ঘটিকা। মিয়ানমারের ম্যাগওয়ে এয়ার বেজ থেকে দুটি জেট ফাইটার মিগ-২৯ মিশনের জন্য এইমাত্র টেকঅফ করল…। ফ্লাইট ব্রিফিং চলাকালে, মিয়ানমার এয়ার ফোর্সের (তাতমাদো লে) এ তরুণ পাইলটদের মংডু জেলার উত্তরাংশে আরাকান আর্মি ও সরকারি বাহিনীর (তাতমাদো) মধ্যকার যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানো হয়। গতকাল অর্থাৎ ৩১ আগস্ট, আরাকান আর্মির গেরিলারা মংডু জেলার ওয়ালিটং পাহাড়ি এলাকায় সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) একটি ক্যাম্প দখল করেছে। এতে ১৯ জন সীমান্তরক্ষী নিহত হন। এটির অবস্থান বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। সাহায্যকারী সেনাবাহিনীর (তাতমাদো কি) দলও পথের মাঝে অ্যাম্বুুশে বিধ্বস্ত হয়েছে। তাই আজ থেকে বিমান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলো।

মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান দুটি সুউচ্চ আরাকান ইয়োমা পর্বতমালা পেরিয়ে উত্তর মংডুর দিকে ছুটছে। লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি এসে পাইলট দুজন তাদের আর্মামেন্ট সিস্টেম চেক করে নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেলে ডাইভ শুরু করল। এইমিং ডিভাইসে লক্ষ্যবস্তু ভেসে এল—‘আরাকান আর্মির দখল করা বিজিপি ক্যাম্প’। লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান সুনিশ্চিত করে নির্দিষ্ট উচ্চতায় এসে ক্যাম্পের ওপর যুদ্ধবিমান থেকে রকেট নিক্ষেপ করা হলো। টার্গেটে তৃতীয়বার আক্রমণের পর পশ্চিম দিকে ম্যানুভার করে বিমান দুটি এখন বেজে ফিরছে। পাইলট ততক্ষণে বুঝতে পারলেন যে তারা বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছেন। নাফ নদী ডানে রেখে বিমান দুটো ম্যাগওয়েতে ফিরছে। পাইলটের চোখে পড়ে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সারি। এ সময় দুটি রাশিয়ান হেলিকপ্টার গানশিপ (এমআই-৩৫) সিথওয়ে (আকিয়াব) থেকে ওয়ালিটং পাহাড়ের মিশনে টেকঅফ করল।

রাশিয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বর্মি পাইলটরা জানে না, আরাকান আর্মির ওপর এ বোমাবর্ষণ আরাকানে (বর্তমানে রাখাইন) নতুন যুদ্ধের সূচনা করবে। পরবর্তী প্রায় ১৫ দিন বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলটি বিশেষত ওয়ালিটং ও খা মং সেক পাহাড়ি এলাকা মিগ-২৯ ও হেলিকপ্টার গানশিপের ভয়াবহ আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হবে। আরাকানের যুদ্ধসীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের তমব্রু, ঘুমধুম, পালংখালী, উখিয়ার সীমান্ত এলাকায় ছড়াবে গৃহযুদ্ধের হিংসার আগুন। আরাকানের আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে নতুন হতাশায় ভুগবে ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।

ব্যাংককে এখন সন্ধ্যা নেমেছে। লক্ষণীয়, যুদ্ধ হচ্ছে আরাকান রণাঙ্গনে। অথচ মিয়ানমার যুদ্ধের সংবাদের ঘাঁটি হলো থাইল্যান্ডের এ প্রমোদ নগরী। ব্যাংককভিত্তিক মিয়ানমার সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার অফিসে আরাকানের নতুন যুদ্ধের খবর আসছে। ইরাবতী, নারিনজারা, মিজ্জিমাসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে বর্মি সাংবাদিকরা ইংরেজি ও মিয়ানমারের বিভিন্ন ভাষায় যুদ্ধের রিপোর্ট লেখায় ব্যস্ত। এএফপির ব্যুরো প্রধান প্রতিবেদন লেখার আগে আরাকান আর্মির টুইটারে চোখ রাখলেন। ‘ফ্রনটিয়ার মিয়ানমারের’ নিউজ-ক্রেজি তরুণ মার্কিন প্রতিবেদক আরাকান যুদ্ধের বিশেষ প্রতিবেদন মুসাবিদা শুরু করলেন। দেখে নিলেন ঢাকা ও কক্সবাজারের সাংবাদিকরা কী লিখছেন, কী সংবাদ পাঠাচ্ছেন। ফ্রনটিয়ার মিয়ানমারের প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘আরাকান দ্য নিউ ফ্রন্ট’। ‘আরাকান নতুন রণাঙ্গন’। সত্যি সত্যিই আরাকান নতুন ফ্রন্ট বা রণাঙ্গন হয়ে উঠল। পরবর্তী এক মাস ধরে সংবাদপত্রের পাতায় জুড়ে থাকল ভয়ংকর যুদ্ধের খবর।

প্রায় ৪৪ বছর আগে ব্যাংকক পোস্ট রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি স্মরণীয় নিউজ করেছিল। ১৯৭৮ সালে বার্মিজ বাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছিল। প্রত্যাবাসনের আলোচনার একপর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা মিয়ানমার প্রতিনিধি দলকে বেশ কড়া কথা শুনিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ব্যাংকক পোস্ট একটি নিবন্ধ ছেপেছিল—‘বাংলাদেশ ওয়ার্নস বার্মা’। ‘বাংলাদেশ বার্মাকে সতর্ক করল’। (১৭ মে, ১৯৭৮) উল্লেখ্য, আমাদের কিংবদন্তিময় সাংবাদিক এসএম আলী একসময় (১৯৬৬-৭০) ব্যাংকক পোস্টের ম্যানেজিং এডিটর ছিলেন।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমার বাহিনীর বেপরোয়া ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ ও বিশ্ববাসী। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যা ঘটেছে তা মূলত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন তত্পরতার অংশ। তবে মিয়ানমার এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়লেও মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। বাংলাদেশকে তাই প্রদর্শনমূলক এমন কিছু করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ করতে মিয়ানমার নিরুত্সাহিত হয়। বাংলাদেশকে অবশ্যই ডেটেরান্স-সামর্থ্য বাড়াতে হবে। মিয়ানমারকে চাপে রাখতে হবে, কারণ জান্তা সরকার শক্তের ভক্ত।

আরাকানের স্বাধীনতা/স্বাধিকারের জন্য যুদ্ধরত আরাকান আর্মি (ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের সামরিক শাখা) বর্তমানে আরাকানের রাখাইন জনগণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষত গত প্রায় দুই বছরে আরাকান আর্মি আরাকান রাজ্য ও চীনের পালেটোয়া অঞ্চলে অত্যন্ত শক্তিশালী রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-আর্থিক ও সামরিক সংগঠন গড়ে তুলেছে। যাদের সৈন্যবল ২৫-৩০ হাজার বলে মনে করা হয়। গত আগস্ট থেকেই তরুণ জেনারেল ওয়াং ম্রা নাইংয়ের নেতৃত্বে আরাকান আর্মি নতুন উদ্যোগে যুদ্ধ শুরু করেছে। বিশেষত ৩১ আগস্ট বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা চৌকি দখল করে আরাকান আর্মি গেরিলা যুদ্ধের নবপর্যায়ের কথা জানান দিল। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তাতমাদো-আরাকান আর্মির অলিখিত অস্ত্রবিরতিও ভেঙে যায়।

আরাকান স্টেটটি সামরিক দিক থেকে তাতমাদোর (সামরিক বাহিনী) ওয়েস্টার্ন কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত। এর সদর দপ্তর আরাকানের আন শহরে। এটি নেপিদো থেকে পরিচালিত ‘ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশন- ৬’-এর মধ্যে পড়েছে। আরাকানে তাতমাদোর তিনটি মিলিটারি অপারেশন কমান্ড (ডিভিশন) মোতায়েন করা আছে। নতুন যুদ্ধের বাস্তবতায় কয়েকটি লাইট ইনফেন্ট্রি ডিভিশনও আনা হয়েছে এ অঞ্চলে। উল্লেখ্য, তাতমাদোর ডিভিশনগুলো জনবল বিবেচনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ব্রিগেডগুলোর প্রায় সমপর্যায়ের। আরাকানের চকপিউতে নৌবাহিনীর (তাতমাদো-ইয়াং) নৌঘাঁটি রয়েছে। আন ও সিথওয়েতে তাদের সামরিক বিমানবন্দর রয়েছে। ম্যাগওয়ে বিমানঘাঁটি থেকে বর্তমানে আরাকানে ফিক্সড উইংবিমানের আক্রমণ পরিচালনা করা হচ্ছে। পালেটোয়া, মংডু, বুধিডং, রাচিডং ও ম্রাউক-উ অঞ্চলে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। আরাকান আর্মি যুদ্ধ করছে দুর্ধর্ষ তামিল টাইগারদের মতো। এদিকে গণহত্যাকারী তাতমাদো যেকোনো উপায়ে গেমচেঞ্জার আরাকান আর্মিকে ধ্বংস করতে আক্রমণ চালাচ্ছে নির্মম ও বেপরোয়াভাবে। এতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আরাকানের সাধারণ জনগণ। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। তবে আরাকান আর্মির আক্রমণে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে তাতমাদো। তাতমাদোর সামরিক ডকট্রিন হলো—আধুনিক সময়ে জনযুদ্ধ (পিপলস ওয়ার আন্ডার মডার্ন কনডিশন)। কৌতুককর হলো, গণহত্যাকারী, দুর্ধর্ষ তাতমাদো এখন নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরভাবে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে শুরু হওয়া এ নতুন যুদ্ধের গুরুত্ব বোঝা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ যুদ্ধের প্রভাব পড়বে মিয়ানমার কেন্দ্রিক বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভাবনা ও কৌশলে। সমগ্র মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী যুদ্ধের গতি বাড়ছে। মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে ভেঙে পড়লে এ অঞ্চলে নতুন সংকটের সৃষ্টি করবে। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী তা আগে থেকেই ঠিক করতে হবে।

মিয়ানমারের চলমান সংকটের কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একটি সুযোগ নতুন করে তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন মিয়ানমারের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেরেক মিচেল। এ সুযোগ বাংলাদেশ কীভাবে কাজে লাগাবে সেটা এখন দেখার বিষয়। ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) গত সেপ্টেম্বরে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছে, আরাকানের যেকোনো বিষয়ে বিশ্বের সবাইকে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হবে। ইউএলএ সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে ইউএলএ এবং আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তারপর আলোচনায় বসতে হবে। এ ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে সুযোগ এবং ঝুঁকি দুটোই তৈরি করেছে। আরাকান আর্মি ও ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্মেন্ট’-এর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে এবং কোন পর্যায়ে হবে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণপূর্বক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে তাতমাদো। জাতীয় ঐক্য সরকারের নেতৃত্বে তাদের সহযোগী সামরিক সংগঠন ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ (পিডিএফ) ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে। পিডিএফের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা গোষ্ঠীগুলো তাদের সামরিক তত্পরতা জোরদার করছে। ফলে সে দেশে তাতমাদোর বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। জান্তা বাহিনীর ঘুম কেড়ে নিয়েছে মিয়ানমারের তরুণ বিদ্রোহীরা। এর জন্য আন্তর্জাতিক মনোযোগ আবার এ অঞ্চলে ফিরে এসেছে। আরাকান ঘিরে চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিযোগিতা তীব্র হতে চলেছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কূটনৈতিক ফ্রন্টে লড়ছে বাংলাদেশ। গত ২৩ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বিশ্বসভায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তুলে ধরেন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন।

সাম্প্রতিক কালের মিয়ানমার সীমান্তের ঘটনাগুলো পুরনো কিছু প্রশ্ন উসকে দিয়েছে: প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? মিয়ানমারকে কতটুকুই বা বুঝতে পারি? মিয়ানমারের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেলে দেশটিকে আমাদের বুঝতে হবে এবং তার মনস্তত্ত্ব পড়তে, জানতে হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে আমাদের উদ্যোগ বেশ হতাশাজনক। আমাদের মিয়ানমারচর্চা অবশ্যই বাড়াতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারকে চেনা, জানা ও জানানোর নতুন এক বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযান শুরু করা প্রয়োজন। এতে জনগণকেও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে ২০১৭-এর পর, বিশেষত রোহিঙ্গা বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান, গবেষণা ও লেখালেখির উদ্যোগ তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়েছে। এক্ষেত্রে একাডেমিক প্রচেষ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে কিছু সুসংবাদও আছে। গত সেপ্টেম্বরে লেখক মাহবুব সাবেরের রোহিঙ্গাদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত্ বিষয়ে গবেষণা কর্ম ‘ব্যালাড অব রোহিঙ্গা’ প্রকাশিত হয়েছে পাঠক সমাবেশ থেকে। ‘মিয়ানমারের পুনরুত্থান ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক’ শীর্ষক থিসিস লিখে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) থেকে ২০১৮ সালে পিএইচডি লাভ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ মেধাবী সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাফাত আহমেদ। যত দূর জানি, জেনারেল সাফাত আহমেদই আধুনিক মিয়ানমারের ওপর প্রথম পিএইচডি সম্পন্ন করার অনন্য গৌরবধারী। প্রতিবেশী একটি দেশের ঘটনাবলির ওপর সর্বোচ্চ পর্যায়ের একাডেমিক গবেষণা কর্ম পেতে আমাদের প্রায় ৪৭ বছর অপেক্ষা করতে হলো। ভাবা যায়?

এদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরেকজন চৌকস সেনা কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবু নাইম আশফাক চৌধুরী ২০২১ সালে ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক ও রোহিঙ্গা সংকট’ শীর্ষক থিসিস লিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন। এটি সম্ভবত রোহিঙ্গা সংকটের ওপর প্রথম পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণাকর্ম। তবে প্রকাশকদের আগ্রহ ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় এই থিসিসগুলো আগ্রহী পাঠকদের হাতে বই আকারে পৌঁছতে হয়তো আরো হাজারো দিন লেগে যেতে পারে!

বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আরাকান রণাঙ্গন কিছুটা শান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনপরিসরে ও মিডিয়ায় আরাকান যুদ্ধ ও রোহিঙ্গা সংকটবিষয়ক আলোচনা হঠাৎ করেই যেন কমে গেল। মিয়ানমার কি আবার ‘ক্লোজড চ্যাপটার’? পত্রিকায় নেই আরাকান যুদ্ধের তেমন বিবরণ। নেই নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষকদের সুচিন্তিত মতামত। টক শো ও সেমিনারে আমন্ত্রিত বক্তাদের প্রাণবন্ত বাকযুদ্ধও প্রায় থেমে গিয়েছে। বাইরে থেকে আরাকান এখন শান্ত রণাঙ্গন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ভূমি পর্যায়ে পরিস্থিতি এর ঠিক বিপরীত। মিয়ানমারকে আমাদের আলোচনায় সবসময় রাখতেই হবে। এটাই দেয়ালের লিখন।

ব্যাংককভিত্তিক মিয়ানমার ও বিদেশী সাংবাদিকরা, বিশ্লেষকরা আরাকান যুদ্ধ নিয়ে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ ও গভীর বিশ্লেষণে মেতে আছেন। আরাকান প্রসঙ্গই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। মোট কথা, আরাকানসহ মিয়ানমার থেকে একের পর এক দুঃসংবাদ আসছেই। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে আরাকান আর্মির নতুন ঘোষণা, সীমান্তে সামরিক উসকানি, গৃহযুদ্ধে মিয়ানমারের ভেঙে পড়ার আশঙ্কা, আরাকানের নাফ উপকূলে পরাশক্তিদের নতুন প্রতিযোগিতার আলামত…।

আগামীতে বাংলাদেশের সামনে আরো বড় কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জও তৈরি হতে চলেছে। এসব বিষয়ে আমাদের সঠিক কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও মিয়ানমার গৃহযুদ্ধপ্রসূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের সামনে এখন অনেক কাজ। এ দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়। গণমাধ্যম, একাডেমিয়া, সিভিল সোসাইটি, থিংক ট্যাংক, বুদ্ধিজীবী মহল, অর্থনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষকসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়েই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের একত্রে পথ হাঁটতে হবে। আমরা প্রস্তুত হচ্ছি তো?

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবসরপ্রাপ্ত)।
[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আরাকান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন