উখিয়া-টেকনাফে নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনা: ক্ষুব্ধ গ্রাহক
উখিয়া-টেকনাফে মোবাইল কোম্পানীর থ্রিজি-ফোর-জি বর্তমানে জিরো জিতে পরিণত হয়েছে। রবি, বাংলালিংক, এয়ারটেল ও গ্রামীণের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা চরম হতাশায় পড়েছে। শুধুই ইন্টারনেট নয় কল পর্যন্ত যাওয়া-আসা করে না। করোনাকালে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনের ক্লাসেও যোগ দিতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। সিম কোম্পানীই সর্বত্র থ্রিজি-ফোরজি চালুর প্রচার করলেও শুধু মাত্র টু-জিতে সিমাবদ্ধ রয়েছে।
গ্রাহকরা অভিযোগ করে বলেন, সীমান্ত ও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় জন্মগ্রহণ করে পাপ করেছি। ২০১৭ সালের আগে থ্রি-জি ফোরজি থাকলেও পরে তাদের কারণে থ্রিজি ফোরজি বন্ধ করে দেয় সরকার। এর ফলে স্থানীয়দের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়ে যায়। বিশ্বমহামারী করোনায় পর্যন্ত কোন খবরাখবর দেখতে পারছে না মানুষ। সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলেও পুরো উখিয়া-টেকনাফে ওয়াইফাই সংযোগ চালু হয়ে গেছে। গ্রাহকের প্রশ্ন-সরকারের লাভ কি হল। ইন্টারনেট গতি বন্ধ করলেও ওয়াইফাই’র মাধ্যমে নেট ব্যবহার করছে মানুষ।
হ্নীলা রংগীখালীর ওমর ফারুক নামের একজন গ্রাহক বলেন, ইন্টারনেট নির্ভর কাজ করতে গিয়ে প্রচণ্ড বেগ পেতে হচ্ছে। এখন যেখানে ওয়াইফাই সেখানে ছুটে চলি। দ্বারস্থ হয় পাসওয়ার্ড নিতে মালিকদের। বলতে গেলে, রোহিঙ্গাদের কারণে আমরা নেট হারিয়েছি। অথচ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের গতি আরও শক্তিশালী। বর্তমানে কোম্পানীগুলো শুধু প্রতারনা মূলক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে থ্রীজি-ফোরজি সিম বলে বিক্রি করলেও তার সুফল পাচ্ছেনা গ্রাহকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘গ্রামীণ ফোন থ্রিজি-ফোরজি, ইচ্ছা হলেই চলো বহুদূর!’ রবি জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে” গণমাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে নজর কাড়তে সক্ষম হলেও কাঙ্খিত সেবা দিতে পারছে না এ কোম্পানি গুলো। প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। নিম্নমানের সেবায় ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের অনেকে। অথচ সেবার নামে নির্ধারিত অর্থ কেটে নিতে এতটুকু কার্পণ্য নেই তাদের। গ্রামীণ ফোন ও রবি সিম ব্যবহার করেন, এমন কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
রবি কোম্পানীর সিম ব্যবহারকারী রিফাত হোসেন বলেন, ফেসবুক বা কোনো ওয়েবসাইটে ঢুকতে চাইলে অপেক্ষা করতে হয় টুজি গ্রাহকদের মতোই। থ্রিজি ও ফোরজির কোনো পার্থক্য বুঝতে পারি না। কখনও থ্রিজি আবার কখনও ফোরজি’র সিম্বল ভেসে ওঠে। গতি খুবই কম।
শাখাওয়াত নামের একজন গ্রাহক বলেন, টেকনাফ উপজেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানী গ্রামীণ এর চেয়ে রবি’র গ্রাহক অনেক গুণ বেশি হলেও সেবার দিকে রবি অত্যান্ত পিছিয়ে। রবি’র টাওয়ার প্রায় সময় পাওয়ার শূন্য হয়ে থাকে। ভাসা ভাসা নেটওয়ার্ক দিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনার শিকার হয় গ্রাহকরা। বার বার নেটওয়ার্ক বিপর্যয়, অবাঞ্চিত বিল, অপ্রত্যাশিত কোম্পানী নম্বর থেকে কল ও ম্যাসেজ এর ভারে নুজ্ব্য হয়ে পড়ে রবির গ্রাহকরা। এসব বিষয় নিয়ে কোম্পানীর দেয়া হেল্প লাইনে অভিযোগ জানাতে গেলে গুণতে হয় প্রায় অর্ধশত টাকা এবং দীর্ঘ সময়। এ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতে টেকনাফে আশংকাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে রবির গ্রাহক। রবি সিম বদলে গ্রাহক হচ্ছে অন্যান্য অপারেটরের।
তবে রোহিঙ্গাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের দোহাই দিয়ে সরকার কিছু এলাকায় নেট বন্ধ করে দিলেও সর্বত্রই ওয়াইফাই সংযোগ হয়ে গেছে এখন। মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানীর অসহনীয় প্রতারনা থেকে মুক্তি ও উন্নত নেটওয়ার্কিং এর আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল। শাখাওয়াত নামের এই গ্রাহক ক্ষুব্ধ হয়ে তার পেইসবুক পাতায় লিখেছেন, রবি-গ্রামীন নামে প্রতারণা, ভোগান্তিতে আছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা। এখন সময় ওয়াইফাই’র। আছে দেশ-দেশান্তরে আপনজনের সাথে যোগাযোগের অনেক সহজ মাধ্যম।
তারেক নামে একজন কলেজ ছাত্র লিখেছেন, শপথ করে ফেলেছি, রবি সিম নিয়ে আর কোন কাজ করব না, বেস এতটুকু আর বলার কিছুই নেই। এখন কেউ করোনায় আক্রান্ত বা মারা গেলে খবরও পাবে না।
টেকনাফের সিনিয়র সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন বলেছেন, প্রতিটি কোম্পানি সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারনা করছে। অনেক সময় দেখা গেছে এমবি নেওয়ার পর এমবি উধাও। সে ব্যাপারে কথা বলতে গেলে আরও টাকা ব্যয় হয়। কথা হচ্ছে এদেশের মানুষ হল হালের গরু।
সরওয়ার কামাল নামের একজন ব্যবসায়ী লিখেছেন, লেখা আছে, পড়া নেই। ফোরজি আছে চালু নেই।
এভাবেই গ্রাহকরা তিক্ততা তুলে ধরে এই কোম্পানীগুলোর বিরুদ্ধে ফুসে উঠেছে যার ফলে যে কোন মুহুর্তে থ্রিজি নামে প্রতারনা বন্ধে ও নেটওয়ার্ক কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করতে আন্দোলনে যেতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করেছেন। তাই দ্রুত পুনরায় ফোর-জি সার্ভিস এর মাধ্যমে গ্রাহক সেবা বৃদ্ধি ও নেটওয়ার্ক সবসময় সচল রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন গ্রাহকরা।
তথ্যঅনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফে মোবাইল কোম্পানীর থ্রিজি-ফোরজি নেটওয়ার্ক থাকলেও বর্তমানে ইন্টারনেট গতি জিরো জিতে পরিণত হয়েছে। এমনকি সাধারণ কল পর্যন্ত যায় না। অনেক চেষ্টা করে কল গেলেও এক মিনিটের অধিক কথা বলা যায় না। এভাবেই উখিয়া-টেকনাফের মানুষ বোবা হয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বাধিক গ্রাহক নিয়ে প্রথম থাকা রবি ও এয়ারটেল কোম্পানির ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা চরম হতাশায় পড়েছে। গত গত কয়েকমাস ধরে এ কোম্পানীই সর্বত্র থ্রিজ-ফোরজি নেটওয়ার্ক আপন শক্তি জ্বলে উঠার প্রচারে দাবিদার রবি ও এয়ারটেল ইন্টারনেট দামাকা অফার খামাকা অফার নানাবিধ লোভনীয় ম্যাসেজে অতিষ্ট নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনা থেকে রেহায় নেই গ্রাহকের।
অনেকে উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দামি দামি ব্রান্ডের মোবাইল ব্যবহার করেও নেটওয়ার্ক সিগন্যাল নামে মাত্র থ্রিজি-ফোরজি দেখালে চলেনা ইন্টারনেট। বিশেষ করে, টেকনাফ উপজেলার রোহিঙ্গা ইস্যুতে যদিও হোয়াইক্যং, হ্নীলা দু’ইউনিয়নে সরকার কর্তৃক নেটওয়ার্ক গতি সীমিত রাখার নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া টেকনাফ সদর, সাবরাং, বাহারছড়া, সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের অন্তত ৭০% মানুষ অভিযোগ করে জানান ইন্টারনেট নির্ভর কাজ করতে গিয়ে করোনা চলাকালেও প্রচণ্ড বেগ পেতে হচ্ছে। এমন কি টেকনাফ পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রে শীলবনিয়া এলাকায় বসবাসরত এক ব্যবসায়ী বলেন, করোনাকালে বাসা থেকে বের না হওয়ার চেষ্টা করলেও ইন্টারনেট গতি না পাওয়াই ইন্টারনেট নির্ভর কাজ করতে আমাকে আলো শপিংমলে আসতে হয়।
এখানে নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট গতির কোন পরিবর্তন নেই যেখানে রয়েছে (আলো শপিংমলে) রবি ও এয়ারটেল কাস্টমার কেয়ার এবং কোম্পানির সেলস অফিস। রবি ও এয়ারটেলের প্রচার বিজ্ঞাপনে দেখা যায়,“জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে” প্রতারনার এ বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকের নজর কাড়তে সক্ষম হলেও কাংখিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত গ্রাহকরা।
করোনাকালে হোম কোয়ারান্টাইনের মত দুঃসময়েও নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনা থেকে রেহাই নেই মানুষের। সেবার মান না থাকলেও তাদের দেওয়া ক্রয়কৃত ইন্টারনেট অফার ব্যবহারে অক্ষম বান্ডিল মিনিট ও ইন্টারনেট বান্ডিলের মেয়াদ ঠিকই শেষ হয়ে যায়। সেবার নামে নির্ধারিত অর্থ কেটে নিতে এতটুকু কার্পণ্য নেই তাদের। ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ গ্রাহক। কিন্তু এ নিয়ে রবি ও এয়ারটেল কাস্টমার কেয়ারে সরাসরি এবং ফোনে বারবার অভিযোগ করার পরও কোন সুরাহা হচ্ছে না বলে ক্ষুব্ধ হয়ে জানান ভুক্তভোগীরা।
কোম্পানির এসব বিষয়ে অবগত নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, চলমান মহামারি করোনার দোহাই দিয়ে টেকনিক্যাল টিম ঢাকা থেকে টেকনাফ না আসায় এখানকার নেটওয়ার্কের মান উন্নয়ন করা হচ্ছেনা।
এদিকে ইন্টারনেট বিড়ম্বনার শিকার অনেকে জানান, যেকোন সময় সেবার নামে প্রতারণা বন্ধে ও নেটওয়ার্ক কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করতে গ্রাহক সমাবেশ কিংবা রবি ও এয়ারটেল সিম পুড়িয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনে যেতে পারে তারা। তাই দ্রুত সময়ে ইন্টারনেট সেবায় থ্রিজি-ফোরজি গতি বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রাহক সেবা বৃদ্ধি ও নেটওয়ার্ক সচল রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন টেকনাফে কর্মরত এনজিও ও স্থানীয় গ্রাহকরা।
বিশেষ করে টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে নেটওয়ার্ক নিয়ে গ্রাহকদের ভোগান্তি এখন চরমে। পুরো উপজেলায় নেটওয়ার্ক ধীরগতির। অন্য দিকে হ্নীলা ইউনিয়ন ছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নের চিত্র আরো ভয়াবহ। ঘর থেকে বাইরে, বাইরে থেকে আরও খোলামেলা জায়গায়; এমনকি টাওয়ারের নিচে কোথায়ও চাহিদা অনুযায়ী নেটওয়ার্ক নেই। টেকনাফ সদরসহ কয়েকটি এলাকায় থ্রি এবং ফোরজি শুধু নামেমাত্র। ইন্টারনেটের ভারী কাজ তো দূরের কথা, এমনকি সাধারণ কাজ নিয়েও পড়তে হয় মুশকিলে।
আবার লোডশেডিং হলেই মোবাইলে ইমারজেন্সি নেটওয়ার্ক। নেট ব্রাউজিং শুধু নয়, মোবাইলে কথা বলতে ছোটাছুটি করে নেটওয়ার্ক খুঁজতে হয়। সাধারণ মানুষ নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে এ পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে একমাত্র রোহিঙ্গাদের কারণে। দেশের এই ক্রান্তিকালে টেকনাফের মানুষ এই করোনায় পর্যন্ত গুটিকয়েক ওয়াইফাই ছাড়া কোন খবর জানতে পারছেন না।
বিশেষ করে চরম ভোগান্তি হ্নীলা ইউনিয়নের রংগীখালী, আলীখালী, লেদা, নাটমোরাপাড়া, ফুলেরডেইল, মৌলভীবাজার, জাদিমোরা, দমদমিয়া। করোনার এই ছোবলে মানুষ এমনি মরে গেলেও কাউকে সংবাদ দিতে পারবে না। জরুরী কোন মানুষকে কল দিলেও ১০/১২ বার দেয়ার পর সংযোগ পাওয়া যায়। তারপরেও ভালো করে কথা বলা যায় না। এমন ভোগান্তি থেকে দ্রুত পরিত্রাণ দেয়া উচিত বলে মনে করেন হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, নেটওয়ার্কের বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করা হয়েছে আশা করি দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।