কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে নৌ যোগাযোগ ব্যাহত, হুমকির মানুষের জীবন জীবিকা
আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:
এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদের পানি অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। বৃষ্টি কম হওয়ায় ক্রমাগত নামছে পানির স্তর। খরা এবং ভূমিধসে কাপ্তাই হ্রদ নাব্যতা হারাচ্ছে। অনাবৃষ্টি, খরা, তলদেশ ভরাটসহ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়ে কাপ্তাই হৃদ এখন প্রায় জীর্ণ জলাশয়। অসংখ্য চর জেগে উঠেছে এর নৌ-চলাচল পথে। উজানে শুকিয়ে গেছে কর্ণফুলি ও কাচালং নদী। ফলে পানিপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ নানা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবহনে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে রাঙ্গামাটির দুর্গম পার্বত্য এলাকায়। এসকল কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিরূপ প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলে। একই কারণে কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কাপ্তাই হ্রদে পানি সঙ্কটের কারণে কেপিএমের কাগজ উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল বাঁশ পরিবহনে বিঘ্নতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে কাগজ উৎপাদনও কমতে শুরু করেছে। জেলার হাজার হাজার একর জলে ভাসা জমিতে বোরো চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পাশাপাশি হ্রদের পানি পর্যাপ্ত না থাকায় বনজ সম্পদ ও মৎস্য সম্পদ আহরণ কমে গেছে। বিঘ্নিত হচ্ছে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও উৎপাদন। রাঙামাটিতে চলছে মাছের আকাল। কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর ৭৫ প্রজাতির মাছ উৎপাদন হলেও ইতোমধ্যে বহু প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। বর্তমানে মাত্র ৩২ প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে হ্রদ এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিষয়টি মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ছোট নৌকা বা বোট দিয়ে কিছু পথ পার হওয়া গেলেও পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। যোগাযোগ সঙ্কটের কারণে প্রত্যন্ত এলাকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত ও এলাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে কয়েক লাখ মানুষ। মালামাল পরিবহন সংকটে জেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে প্রতিটি জিনিষের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রত্যন্ত এলাকার খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রায়। নৌ-পথ নির্ভর এসব অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দাভাব চলছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে খাদ্য সঙ্কটের। এ ছাড়াও জরুরি চিকিৎসা, লেখাপড়া, উন্নয়ন কর্মকান্ড ও প্রশাসনিক কাজেও সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
প্রতি মৌসুমে জানুয়ারি মাস থেকে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমতে শুরু করে। পানি শুকিয়ে গেলে নৌ চলাচলের পথ ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠে ছোট ছোট ডুবোচর। এ কারণে বাঘাইছড়ি, লংগদু, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, কাপ্তাই, নানিয়ারচর উপজেলায় নৌ চলাচলে ব্যঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিটি উপজেলা সদর থেকে অন্তত ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরত্বে নেমে এসেছে নৌযান বা জলযানের ঘাট।
রাঙামাটি লঞ্চ মালিক সমিতি সুত্র জানায়, গত প্রায় একমাস আগেই বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি উপজেলায় যাত্রিবাহী লঞ্চ চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে লংগদু উপজেলার লঞ্চ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিঃ মিঃ দুরে বৈদ্যটিলা পর্যন্ত গিয়ে আটকে যায়। সেখান থেকে প্রায় ৩০ কিঃ মিঃ পথ নৌকা বা বোটে এবং পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। একইভাবে জুরাছড়ি উপজেলার লঞ্চ বড়ইতলী পর্যন্ত যেতে পারে, ঐ উপজেলার মানুষ বাকি ৩০ থেকে ৩৫কিঃ মিঃ পথ কিছু অংশ নৌকায় দিয়ে বাকি পথ পায়ে হেটে পাড়ি দিচ্ছে। বরকল উপজেলার মানুষের জীবনযাত্রা যেন থেমে গেছে যোগাযোগ সঙ্কটের কারণে। এ উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী ছোট হরিনা, বড় হরিনা বাজর, ঠেগা পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে। যোগাযোগ সঙ্কটের কারণে সঠিকভাবে মিলছে না সাপ্তাহিক বাজার।
সুত্র জানায়, ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় শহর থেকে মাত্র ২৫ কিঃ মিঃ দুরে শুভলং চ্যানেলে গিয়ে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যোগাযোগের এ দুরাবস্থা চলবে আরো দুই মাস। প্রতি বছর এসব উপজেলার মানুষ বছরের প্রায় অর্ধেক সময় যোগাযোগ সঙ্কটে দুর্ভোগ পোহায়।
বরকল উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, যোগাযোগ সঙ্কটের কারণে এলাকার জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা যাচ্ছে না। ব্যবসা বাণিজ্যে চলছে মন্দাভাব। তিনি জানান, বরকল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিঃ মিঃ রাস্তার কিছু অংশ নৌকা দিয়ে এবং বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে দূর্গম এলাকার মানুষ।
জুরাছড়ি উপজেলার জুরাছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অনিল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা জানান, যোগাযোগ সঙ্কটের কারেণ উপজেলার মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। তিনি জানান, উপজেলার কেংড়াছড়ি থেকে প্রায় ১০ কিঃ মিঃ নৌকায় করে মালামাল পরিবহন করে নিয়ে আসতে হয়। এতে করে এলাকায় নিত্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিকের অনেক বেশি। হ্রদের পানি নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলের পানি উঠছে না।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, তলদেশ ভরাট হয়ে পানির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় হ্রদের এ দুরাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৬২ সালে হ্রদ সৃষ্টির পর থেকে পাহাড় ও মাটি ধস, পাহাড়িদের জুম চাষের ফলে মাটি ক্ষয়, ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অপরিকল্পিত হ্রদের ব্যবহারের কারণে পলি জমে হ্রদের তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময়েও খনন না হওয়ায় হ্রদের নাব্যতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে এশিয়ার বৃহত্তম এ কৃত্রিম হ্রদ। প্রতি বছর বিভিন্ন সভা সেমিনারে কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিংয়ের উপর গুরুত্বারোপ করা হলেও হ্রদ ড্রেজিংয়ের কোনো উদ্যোগ নেই।
এবিষয়ে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল জানালেন, পানি যখন শুকিয়ে যায় তখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিকট কাপ্তাই লেক সংস্কারের একটা প্রকল্প আছে বিশেষ করে নৌ-যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য। কাপ্তাই লেকের বর্তমান অবস্থায় প্রায় আট কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওযা হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, কাপ্তাই লেকে আমাদের যে নদীপথ গুলো আছে সে গুলোর ৬ টি পয়েন্টে ড্রেজিং করা হবে এবং এটা খুব শিঘ্রই হবে।
বিশেষত এখানে সাজেক নদীপথকে লঞ্চ চলাচলের উপযোগী রাখা আরেকটা হল বরকল থেকে ছোট হরিণা যে ৫ কিলোমিটার জায়গা নদী পথ রয়েছে সেটাও ড্রেজিং করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা এবিষয়ে গত মাসে একটি ওয়ার্কশপ করেছিলাম, তার মাধ্যমেই দায়িত্বপ্রাপ্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এই সিদ্বান্ত নেওয়া হয়েছে।
সব কিছুরই একটা আয়ুঃস্কাল থাকে৷ কাপ্তাই লেকেরও আছে৷ কিন্তু নানাবিধ পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপ, বন ধ্বংসের ফলে এখানে বিশেষ করে ভূমিধসের মতো ঘটনা ঘটছে৷ এসব কারণে এই লেকটি এখন একটি অগভীর লেকে পরিণত হয়েছে৷ আজ হোক আর কাল হোক এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল৷