কেএনএফের সঙ্গে খোলাই থাকছে সংলাপের দরজা
তিন ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) নাম আসার পর তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার রাস্তা বন্ধ করার কথা জানানো হয়। পাহাড়ের নৃগোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের নিয়ে গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে সেটি স্পষ্ট করেছিল। নতুন করে র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হলো, কেএনএফের সঙ্গে সংলাপের দরজা খোলা আছে। জলদস্যু ও মাদক কারবারিদের মতো চাইলে তারাও আত্মসমর্পণ করতে পারবে। এর পর প্রয়োজনে তাদের পুনর্বাসন করা হবে। তবে গতকাল পর্যন্ত সংলাপ বা আত্মসমর্পণের আহ্বান– কোনোটিতে সাড়া দেয়নি কেএনএফ।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল মাহাবুব আলম বলেন, আত্মসমর্পণ করে কেএনএফ আইনের পথে এলে সেই সুযোগ তারা পাবে। একই সঙ্গে আলোচনাও চলতে পারে। এর আগেও জলদস্যু ও মাদক কারবারিরা আত্মসমর্পণ করেছিল। কেএনএফ অস্ত্র সমর্পণ করলে পরবর্তী সময়ে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আত্মসমর্পণের সুযোগের পাশাপাশি অভিযান চলবে। কেএনএফের সন্ত্রাসীদের নির্মূল না করা পর্যন্ত যৌথ অভিযান চলমান থাকবে।
বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল করিম বলেন, জেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে টহল ও চেকপোস্ট। ব্যাংক ও থানায় হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে নানা জায়গায় অভিযান চলছে। কেএনএফ নেতা নাথান বম কোথায় রয়েছেন, সে ব্যাপারে তারা এখনও নিশ্চিত নন।
এদিকে কেএনএফ তাদের ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়ে দাবি করে– নাথান বম ভারত বা মিয়ানমারে অবস্থান করছেন না, তিনি পশ্চিমা দেশে আছেন। কেএনএফের মিডিয়া উইং থেকে কথিত ক্যাপ্টেন ফ্লেমিং ওই পোস্ট দেন। তবে নাথান পশ্চিমা কোনো দেশে রয়েছেন– এমন কোনো তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নেই। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, নাথান পশ্চিমা দেশে গেছেন– এমন তথ্য-প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। তাঁর পাসপোর্ট রয়েছে কিনা, সেটাও জানি না। পশ্চিমা দেশে গেলে পাসপোর্ট ব্যবহার করেই যেতে হবে।
কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে পাহাড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। ওই বছরের জুলাই ও অগাস্টে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের দুইবার ভার্চুয়াল আলোচনা হয়েছে। পরে ৫ নভেম্বর রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাই পাড়ায় প্রথমবারের মতো কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রথমবারের মতো প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ‘শান্তি আলোচনা’ শুরুর পর পাহাড়ে সহিংসতা থেকে মুক্তির আশা জাগতে শুরু করেছিল পাহাড়ের মানুষের মনে। এরই মধ্যে বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক লালথাং জেল বম বলেন, কেএনএফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। তবে এখনও নাথান বম বা সহযোগী কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। সরকার কোন প্রক্রিয়া অনুযায়ী আবার তাদের আলোচনার সুযোগ দিচ্ছে, এটা জানা নেই।
বান্দরবানে ডাকাতির পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়, নাথানকে ফেরাতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হবে। তবে গতকাল পর্যন্ত নোটিশ পাঠানো হয়নি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের ইন্টারপোলের শাখা কার্যালয় ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, নাথান বমের ব্যাপারে যে সংস্থা তদন্ত করছে, তাদের কাছ থেকে আবেদন এলেই সেটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় ইন্টারপোলে পাঠানো হবে। তারা এখনও সে ধরনের চিঠি পাননি।
২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের কথা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। এটি বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও, সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছু লোক রয়েছে। এ কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়। কেএনএফের ফেসবুক পেজে তারা জানায়, রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা, আলীকদমসহ ৯টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ গঠন করা হবে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালানোয় আতঙ্কে সেই সময় পালিয়ে ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নেয় পাঁচ শতাধিক বম নারী-পুরুষ। সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয় বলে ২০২২ সালের অক্টোবরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র্যাব।