থানচি কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাহাড় সমান অভিযোগ
গরীব, হত-দরিদ্র পরিবারের উচ্চ শিক্ষার একমাত্র ভরসা বান্দরবানের থানচি কলেজ। কলেজের অধ্যক্ষসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নানা অনিয়মের কারণে থানচিবাসীর উচ্চশিক্ষা লাভের স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে। এছাড়াও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে শিক্ষার্থী ও অভিভাকদের মাঝে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে।
সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে নতুনভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত রবি-সোমবার দুইদিন ধরে পাঠদান বন্ধ করে রেখেছে কলেজ অধ্যক্ষ। শিক্ষার্থীরা কলেজের উপস্থিতির হলেও শিক্ষক অনুপস্থিত কারণে পাঠদানের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
সোম-মঙ্গলবার এ প্রতিবেদক সরেজমিনের গেলে এ চিত্র দেখা মেলে।
কলেজের কেরানি নির্মল ত্রিপুরা জানান, কলেজ খোলা থাকলেও অধ্যক্ষসহ শিক্ষকরা কেউ উপস্থিত না থাকায় পাঠদানের ব্যাহত হয়েছে। আমি একাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। অনেক শিক্ষার্থী এসেছিল। বন্ধ থাকায় চলে গেছে। সম্ভাবনা আছে কাল বা পরশু চলতে পারে। তবে অধ্যক্ষ স্যার আসতে হবে।
আইসিটি শিক্ষক উথোয়াইম্যা মারমা বলেন, গত দুই দিন আমরা কয়েকজন শিক্ষক কলেজে এসেছিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থী ও অধ্যক্ষ স্যার ছিলেন না। আজ মঙ্গল ১৫ জন শিক্ষার্থী ও অধ্যক্ষ স্যারসহ আমরা মোট ৫ জন শিক্ষক উপস্থিত থেকে তিন বিষয়ে ক্লাস করে ছেড়ে দিয়েছে। অধ্যক্ষ অফিসের এখন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছবি সরানো হয়নি। কলেজে সাংবাদিক আসছে দেখে অধ্যক্ষ ধমিনীক ত্রিপুরা তাড়াহুড়ো করে চেয়ারম্যান স্যার ডেকেছেন বলে কলেজ ত্যাগ করেন।
কলেজের আশেপাশের বাসিন্দারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিভাবক বলেন, হঠাৎ সরকার পরিবর্তনের মন খারাপ হয়ে অধ্যক্ষ স্যার বান্দরবান বাসায় অবস্থান করছেন কবে আসবেন জানা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালে থানচি কলেজ স্থাপিত হয়। এরপর শুরু হয় শিক্ষার কার্যক্রম। বিভিন্ন দূর্গম এলাকা থেকে ভর্তি হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। সেসব শিক্ষার্থীরদের নিয়ে কলেজে শিক্ষার আলো দিকে পথচলা। শুরুতেই কলেজের চাকরিরত ছিলেন অধ্যক্ষসহ শিক্ষকের সংখ্যা ১৩ জন ও কর্মচারী- কর্মকর্তা ৫ জন।
অধ্যক্ষ ধমিনীক ত্রিপুরা অপর ১২ জন শিক্ষকের ২০১৭ সালে ২ মাস, ১৮ সালে ১২ মাস, ১৯ সালে ১০ মাস, ২১ সালে ৭ মাস, ২৩ সালে ১ মাস ২৪ সালে ৭ মাস মোট ৩ বছর ২ মাসের বেতন বকেয়া থাকায় পরিবার নিয়ে সংসার চালাইতে অক্ষমতা দেখা দেয়ার কলেজে অনুপস্থিতির বৃদ্ধি পেয়েছে।
এরই মধ্যে যুক্তিবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ভিত্তিক দুই শিক্ষককে বিনা দোষের বহিষ্কার করার অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। ইংরেজি শিক্ষকের অন্যত্র চাকরি হওয়া স্বচ্ছাই চলে যাওয়া তিন শিক্ষককে পদ শূন্য হয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে অনিয়মতান্তিকভাবে বহিষ্কৃত শিক্ষককের স্থলে ৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দিলেও একজন শরীরচর্চা শিক্ষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান শিক্ষক দুইজন যোগদান করেছে অপর তিনজন শিক্ষক যোগদান করেননি। ফলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি, হিসাব ব্যবস্থাপনা ও দর্শনের তেমন শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি। ২০২৪ সালে এইচ এস সি পরীক্ষা অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা ওই সব বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কলেজ প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষক কর্মচারীদের তিন বছর দুই মাস কোনো বেতন-ভাতা না দিয়ে নানান নির্যাতন নিপীড়ন অবহেলা, কথা বলার মুখ বন্ধ করে রেখেছে বলে অভিযোগ করেছে শিক্ষক কর্মচারীরা। মূল্যস্ফীতির চাপে ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন শিক্ষকরা। তাদের মুখে নেই কোনো হাসি। আছে অনেক অবহেলা ও বঞ্চনার কথা। বিগত দিনের ক্লাস নিচ্ছেন অভুক্ত পেটে। অথচ বড় আশা করে কলেজের শিক্ষায় দীক্ষা নিয়েছিলেন এসব মানুষ গড়ার কারিগর। তাছাড়া থানচি কলেজের অধ্যক্ষ নিজের স্বার্থ ছাড়া দায়িত্বকে অবহেলা করে বেতন না পাওয়াসহ পাহাড় সমান অভিযোগ কলেজ শিক্ষকদের।
অভিযোগ আছে, থানচি কলেজের অধ্যক্ষ ধমিনী ত্রিপুরা ২০২৩ সালে নিয়োগ প্রাপ্ত নতুন শিক্ষকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হতিয়ে নেয়া অদ্যবধি যোগদান না করার পিছনের অনেক কারণ রয়েছে। কলেজে অনুপস্থিত থাকা শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সুযোগ দিয়েছেন। ফলে সেসব শিক্ষকরা কলেজে শুরু থেকে অনুপস্থিত থেকেছেন। তাদের বিরুদ্ধে নিচ্ছে না কোন ব্যবস্থা।
থানচি বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা কিলোমিটার ভিতরে ইউনিয়ন পরিষদের সংলগ্ন দুই তলা বিশিষ্ট ভবনে থানচি কলেজ। সেখানে ব্যবসা ও মানবিক শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছে শিক্ষকরা। সেই আটজন শিক্ষকদের হাজিরা খাতায় প্রতিদিন উপস্থিত রেখেছেন অধ্যক্ষ। কলেজের পাশের আরেকটি নতুন ভবন। সেটি দীর্ঘ বছরের পর বছর মেয়াদী উত্তীর্ণ শেষ হলেও ভবন কাজ মাত্র এক শতাংশ। চারিপাশে ভবনের পিলার ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই ভবনের সমাপ্তির না হওয়ার পিছনেও থানচি কলেজের অধ্যক্ষ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজস থাকার অভিযোগ রয়েছে। অধ্যক্ষ নিজের স্বার্থ ছাড়া দায়িত্বকে অবহেলা করে বেতন না পাওয়াসহ পাহাড় সমান অভিযোগ কলেজের শিক্ষকদের। এতে ভুক্তভোগী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধানে অধ্যক্ষকে অপসারনে দাবি জানান।
যোগাযোগ করা হলে অধ্যক্ষ ধমিনীক ত্রিপুরা বলেন, আপনারা সাংবাদিক যা লেখতে চান তাই লেখুন। এখন আমার মা নেই মাথা খারাপ আছে।
কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতি থোয়াইহ্লামং মারমার ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়ার সম্ভব হয়নি।