নিষিদ্ধ গাইড বই সিন্ডিকেটের কা‌ছে জি‌ম্মি মা‌টিরাঙ্গার শিক্ষাঙ্গন

fec-image

খাগড়াছ‌ড়ির মা‌টিরাঙ্গায় পরগাছার মতো নিষিদ্ধ গাইড বইয়ে ভর ক‌রে চল‌ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, কিনতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। প্রতি বছর সরকার বিনামূল্যে নতুন বই দি‌লেও পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নিষিদ্ধ গাইড বই কেনার জন্য শিক্ষার্থীদের নানাভাবে চাপ দেওয়ার অভিযোগ রয়ে‌ছে।

‌নি‌জেদের স্বার্থ রক্ষা ব্যর্থতা ঢাক‌তে গাইড বইয়ের প্রয়োজন না হলেও প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু শিক্ষক ও প্রকাশনার বিক্রয় প্রতি‌নি‌ধি‌দের সিন্ডিকেট নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীদের। প্রাথমিক, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক সবখানেই এ সিন্ডিকেটের লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য চলছে।

অনুসন্ধা‌নে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে সমন্বয় রাখেন বিভিন্ন প্রকাশনীর রিপ্রেজেন্টেটিভরা। বছর শেষে শিক্ষক/সমি‌তি আর প্রকাশনার কর্তৃপক্ষ সমন্বয় করিয়ে স্কুলভিত্তিক একটি প্রকাশনীর বই চাপিয়ে দেওয়া হয়।

বইয়ের গুণগত মান নির্ভর করে ডোনেশনের ওপর। বিনিময়ে বি‌শেষ ক‌রে প্রধান শিক্ষকদের দিতে হয় বড় অংকের অর্থ।

বছ‌রের ন‌ভেম্বর-ডি‌সেম্বর থে‌কে শুরু স্কু‌লে স্কু‌লে প্রকাশ‌না কোম্পানীর নি‌য়োগকৃত বিক্রয় প্রতি‌নি‌ধি‌দের চরে দৌড় ঝাঁপ। চলে দর কষাক‌ষি। জানুয়ারীর দি‌কে এ‌সে হয় ধফারফা। শুরু হয় নিম্নমা‌নের কাগজে মুদ্রিত গাইড বই কিন‌তে শিক্ষার্থী‌দের হা‌তে হা‌তে ধ‌‌রিয়ে দেয়া হয় প্রকাশনা কোম্পানীর তা‌লিকা। সে মোতা‌বেক শিক্ষার্থী‌দের গাইড বই কিন‌তে তা‌গিদ দেয়া হয়।

কৌশ‌লে চড়া দা‌মে নিম্নমা‌নের বই কিন‌তে বাধ্য করা হয় শিক্ষার্থী‌রা। ক্লা‌সে হা‌তে হা‌তে ধ‌রি‌য়ে দেয়া হয় গাইড বই‌য়ের নাম সম্ব‌লিত বিজ্ঞাপন। এ‌তে নতুন উদ্যোমে শুরু হয় নিষিদ্ধ নোট-গাইড বইয়ের অবাধ বাণিজ্য। যার ফলে বইয়ের মূল্য চলে যায় সাধারণ শিক্ষার্থীর হাতের নাগালের বাইরে।

সম্প্রতি সম‌য়ে খুচরা বই বি‌ক্রি কর‌ছে না স্থানীয় বই দোকানগু‌লো। পু‌রো সেট গাইড বই এক সা‌থে কিন‌তে বাধ্য করা হ‌চ্ছে। মা‌টিরাঙ্গায় মা লাই‌ব্রেরীর স্বত্বা‌ধিকারী মোস্তফা কামাল জানান, ৬ষ্ঠ থে‌কে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত গাইড বইগু‌লো প্রকাশনার নি‌র্দেশনা মোতা‌বেক এক সা‌থে বি‌ক্রি কর‌তে হয়। খুচরা বি‌ক্রির কোনো অপশান নাই।

এ‌তে প্রকাশনা প্রতি‌নি‌ধি, শিক্ষক ও স্থানীয় লাই‌ব্রেরীর সি‌নডিকে‌টের কা‌ছে অসহায় হ‌য়ে পড়ে শিক্ষার্থী ও অ‌ভিভাবক গন। শিক্ষকদের সহায়তায় অসাধু সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

সরকারিভাবে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হলেও থামানো যায়নি অবৈধ এই ব্যাবসা। ১৯৮০ সালে বই নিষিদ্ধকরণ আইনে এসব বই ছাপা ও বাজারজাত করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও সরকার প্রকাশনাকে বন্ধ করতে পারেনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন তদার‌কি না থাকায় দিন‌দিন মা‌টিরাঙ্গায় জমজমাট হ‌য়ে উট‌ছে নি‌ষিদ্ধ গাইড বই ব্যবসা।

অভিযোগ রয়েছে, মা‌টিরাঙ্গা উপ‌জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ প্রধান শিক্ষক মোটা অং‌কের ডো‌নেশান গ্রহ‌নের মাধ্যমে প‌রোক্ষভা‌বে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের হা‌তে ধ‌রি‌য়ে দি‌চ্ছে প্রকাশনার তা‌লিকা। ফ‌লে বাধ্য হ‌য়ে এসব বই কিনতে হ‌চ্ছে শিক্ষার্থী‌দের। নির্ধারিত করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক কোন গাইড বই ব্যবহার করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের ভাষ্য-ক্লাসে বুকলিস্ট দিয়ে নির্দিষ্ট প্রকাশনার নোট, গাইড, গ্রামার ও ব্যাকরণ বই কিনতে বলা হয়। ফলে কিছু করার থাকে না। বাধ্য হয়েই কিনতে হয়।
অপর দি‌কে বই‌ দোকানীরা খুচরা বই বিক্রী না করায় এক সা‌থে সব কয়‌টি নোট বই কিন‌তে হ‌বে। এ‌তে আ‌রো বিপ‌দের সম্মুখীন হ‌তে হ‌চ্ছে পাহা‌ড়ি জনজপদ মা‌টিরাঙ্গার দ‌রিদ্র অ‌ভিভাবক‌দের।

সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মা‌টিরাঙ্গার বইয়ের দোকানগুলোতে পাঞ্জেরি, লেকচার, প‌পি, অনুপম, গ্যালাক্সি, জুপিটার, নিউটন, ব্যাতিক্রম, এটম পাবলিকেশন্সসহ বিভিন্ন প্রকাশনীর ছাপানো নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই ফ্রি-স্টাইলে বিক্রি হচ্ছে।

ত‌বে পাঞ্জেরি, লেকচার, প‌পি, অনুপম ও কমন নোট-গাইড প্রকাশনার বি‌ক্রয় প্রতি‌নি‌ধিগণ প্রতিষ্ঠান প্রধা‌নের সা‌থে সমন্বয় ক‌রে কোমলম‌তি শিক্ষার্থী‌দের হা‌তে কৌশ‌লে বই তু‌লে‌ দেন।
দীর্ঘ দিন ধ‌রে অবৈধভাবে নোট ও গাইড বই বিক্রির সিন্ডিকেটের বাণিজ্য বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই প্রশাসনের।

মা‌টিরাঙ্গা উপজেলার শতা‌ধিক (১ম থে‌কে উচ্চ মাধ্যমিক) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির শিক্ষক ও প্রকাশক এ অবৈধ বইবাণিজ্যে জড়িয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মুখস্থ বিদ্যার দিকে। ফ‌লে তাদের সৃজনশীলতা ধ্বংস করা হচ্ছে।

অনেক শিক্ষক অভিজ্ঞ না হওয়ায়, তারাও নোট ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এ‌তে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মেধার বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে অবৈধ নোট ও গাইড বই।

মা‌টিরাঙ্গা পৌর এলাকার এনামুল হক নামে এক অবিভাবক বলেন, নোট ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের মৌলিক শিক্ষাগ্রহণ ও ভিত্তি গঠনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ অন্তরায় হয়ে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যার দিকে ধাবিত করে তা তাদের সৃজনশীলতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসব বইয়ে তাদের মেধা বিকাশের কোনো উপাদান থাকে না। তাই এসব গাইড বই বন্ধের জোর দাবি জানাচ্ছি।

অপর অভিভাবক আবু রা‌সেল বলেন, স্কুল থেকে দেয়া বইয়ের তালিকায় ‘গাইড বই ও গাইড কোম্পানির নাম’ উল্লেখ থাকে। শিক্ষকদের নির্ধারিত গাইড বই না কিনলে তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। বলতে গেলে শিক্ষার্থীদের তাদের নির্ধারিত কোম্পানির গাইড বই কিনতে বাধ্য করে।

অভিভাবক আবুল হা‌শেম বলেন, শিক্ষার্থীরা গাইড বই পেয়ে মুখস্থ করা শুরু করে। এতে তাদের সৃজনশীলতার কোনোই চর্চা হয় না। গাইড বই বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের সুদৃষ্টি আকর্ষণ ক‌রেন তি‌নি।

টাকা বিনিময়ের কথা অস্বীকার ক‌রে মা‌টিরাঙ্গা মিউ‌নি‌সিপল স্কুল এন্ড ক‌লেজের সহকারী প্রধান ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দীপ্তি রাণী হাজা‌রি বলেন, শিক্ষকেরা গাইডবই পাঠ্য করে- এটা সম্পূর্ণ অসত্য।

প্রতিষ্ঠা‌নের পক্ষ থে‌কে কোনো শিক্ষার্থী‌কে গাইড বইয়ের নাম উল্লেখ করে দেয়া হয় না। যারা ব্যবসা করে তারা পাঞ্জেরি, ‌লেকচারসহ বিভিন্ন গাইডের নাম উল্লেখ করে দেন। শিক্ষার্থীরা তা‌দের মত ক‌রে বিভিন্ন গাইড বই কিনছে। বইয়ের তালিকায় কোনো গাইড বইয়ের নাম উল্লেখ নেই। তালিকার বাইরে নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকার চাইলে একদিনের মধ্যে বন্ধ করতে পারে ব‌লে জানান তি‌নি।

মা‌টিরাঙ্গা প্রাথ‌মিক শিক্ষক সমিতি সাধারণ সম্পাদক না‌দের আহাম্মদ জানান,‘সহায়ক গ্রন্থ’র নামে বাজারে এখন নোট ও গাইড বই বিক্রি হচ্ছে। বাচ্চারা তা‌দের মতো ক‌রে গাইড বই কিন‌ছে। আমি মনে করি এটা শিক্ষকদের নৈতিকতার অবক্ষয়। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সচেতন থাকা ও প্রশাসনের তদারকি খুব জরুরি।

প্রাথ‌মিক সহকারী শিক্ষা অ‌ফিসার অংহ্লাপ্রু মারমা ব‌লেন, ই‌তি পূর্বে এ সংক্রান্ত অ‌ভি‌যোগ পে‌য়ে‌ছি। ত‌বে স‌রেজ‌মি‌নে প‌রিদর্শন কা‌লে তা চো‌খে প‌রেনি।

উপ‌জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শ‌রিফল ইসলাম বিদ্যুৎ জানান, সরকারের নির্ধারিত বই ছাড়া অন্যগুলো পড়ানোর সুযোগ নেই। এ ব্যাপা‌রে অ‌ভিভাবক‌দের স‌চেতন হ‌তে হ‌বে। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে যদি শিক্ষার্থীদের গাইডবই কিনতে বলা হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মা‌টিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনজুর আলম জানান, এ ধরনের অভিযোগ সত্য হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে ব‌লে জানান তি‌নি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: খাগড়াছড়ি, মাটিরাঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন