পাঠ্যপুস্তকে বিতর্কিত ‘আদিবাসী’ শব্দ; জড়িতদের শাস্তি চেয়ে সংবাদ সম্মেলন ঢাবি শিক্ষার্থীদের

fec-image

২০২৫ শিক্ষাবর্ষের দাখিল ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর ‘বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইয়ের কভার পৃষ্ঠায় সংবিধানবিরোধী, বিতর্কিত ও রাষ্ট্রদ্রোহী পরিভাষা ‘আদিবাসী’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত করায় জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের অপসারণ ও শাস্তি চেয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেছে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’।

বুধবার (৮ জানুয়ারি) বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতিতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি ৫ দফা দাবি তুলে ধরে। একই সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দ প্রত্যাহার করার ঘোষণা না আসলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ।

সংবাদ সম্মেলনে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির আহ্বায়ক মুহম্মদ জিয়াউল হক জিয়া বলেন, নতুন বছরের দাখিল নবম-দশমের বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইতে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংযোজন খুবই আপত্তিকর, অনাকাঙ্ক্ষিত, সংবিধান বিরাধী ও রাষ্ট্রদ্রোহী কর্ম, যা বিচ্ছিন্নতাবাদের পথ সহজ করবে। কারণ বাংলাদেশে একমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাদের দেশী-বিদেশী পৃষ্ঠপোষক ও দোসররাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে প্রচারণা চালায় ও স্বীকৃতি চায়। তাদের এই প্রচারণা ও স্বীকৃতি চাওয়ার পেছনে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেরকে দেশে ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন একটি তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্র ‘জুম্মল্যান্ড’ তৈরী হবে! জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সেই পৃষ্ঠপোষক ও দোসররাই ‘আদিবাসী’ শব্দটি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সরকারকে একটি তদন্ত কমিটি করে অতিদ্রুত এদেরকে চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এরা দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার জন্য হুমকি!

মুহম্মদ জিয়াউল হক জিয়া বলেন, বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেরকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী বলা হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ১৯ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলার নির্দেশনা দেয়। ২০১৯ সালের এক প্রজ্ঞাপনেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও সরকারি নির্দেশনা অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করে দেশী-বিদেশী একটা শ্রেণী দেদারসে বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিভাষা ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার ও প্রচার করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে ২০০৭ সালের পর থেকে এই প্রচারণা ব্যাপকভাবে চলছে। এর কারণ হচ্ছে- ২০০৭ সালে জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক একটি ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়, যার নাম “United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples.” বিশ্বব্যাপী বিতর্কিত আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রে এমন কিছু বিতর্কিত অনুচ্ছেদ রয়েছে যেগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে আদিবাসী অঞ্চলের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন ও অখণ্ডতা থাকে না। যেই কারণে বাংলাদেশ এ্ই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেনি। এই ঘোষণাপত্রের কয়েকটি বিতর্কিত গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ হচ্ছে-

ক. আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার (Self-determination) (অনুচ্ছেদ ৪)
খ. স্বায়ত্তশাসন ও নিজস্ব সরকার গঠনের অধিকার, (অনুচ্ছেদ ৪)
গ. ভূমির মালিকানা, ভূমির সীমানা নির্ধারণ ও এর সম্পদের অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৬) এবং এই ভূমির কৌশল নির্ধারণেরও অধিকার থাকবে তাদের ((অনুচ্ছেদ ৩২)
ঘ. আলাদা জাতীয়তার অধিকার, (অনুচ্ছেদ ৬),
ঙ. সেনাবাহিনী উচ্ছেদের অধিকার, (অনুচ্ছেদ ৩০),
চ. দেশী-বিদেশী আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়ার অধিকার (অনুচ্ছেদ- ৩৯)
ছ. জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ (অনুচ্ছেদ ৪২) ।

উপরের অনুচ্ছেদগুলো যদি রাষ্ট্র মেনে নেয় তাহলে আদিবাসী ও তাদের ভূমি এবং তাদের ইচ্ছার উপর রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রন থাকে না। আদিবাসীদেরকে এখানে এমন এক ধরণের সুপার রাইটস বা অতি অধিকার দেয়া হয়েছে যা রাষ্ট্রের অন্য নাগরিকদের দেয়া হয়নি। এই অতি অধিকার ও স্বশাসন -এর শেষ পরিণতি হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া ভেঙ্গে পূর্ব-তিমূর ও সুদান ভেঙ্গে দক্ষিণ সুদানের মত আলাদা রাষ্ট্র গঠন।

জিয়াউল হক বলেন, বিতর্কিত হলেও জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে বর্ণিত বিষয়গুলো শুধু আদিবাসীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা উপজাতিদের ক্ষেত্রে নয়। এই কারণেই বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা এবং তাদের দেশী-বিদেশী পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র, সংস্থা, এনজিও ও বেতনভুক্ত দোসররা ‘আদিবাসী’ প্রচারণা ও স্বীকৃতির মাধ্যমে একটা আন্তর্জাতিক আইনী বৈধতা (লেজিটিমেসি) পেতে চায়। এবং এর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক দাঙ্গা সৃষ্টি করে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের মত তথাকথিত স্বাধীন ‘জুম্মল্যান্ড’ নামে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করাই তাদের মূল লক্ষ্য।

সংবাদ সম্মেলনে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির আহ্বায়ক জিয়া আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বিদেশী প্ররোচণায় ২০০৭ সাল থেকে নিজেদেরকে আদিবাসী দাবী করলেও তাদের দাবী চরম ভণ্ডামী, জালিয়াতী ও মিথ্যা। ইতিহাস ও নৃ-তত্ত্ব অনুযায়ী- পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদি নিবাস হচ্ছে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার, ভারত, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি রাষ্ট্রসমূহ। তারা ওখানকার আদিবাসী বা আদি বাসিন্দা, বাংলাদেশের নয়। বাংলাদেশে তাদের মধ্যে একটা অংশ দখলদার (সেটেলার) যারা দস্যুবৃত্তি করতে করতে অবৈধভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে জোরপূর্বক বাঙ্গালীদের ভূমি দখল করে বসতী শুরু করেছিল। আরেকটা অংশ আশপাশের অঞ্চল থেকে নিপীড়নের শিকার হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের এই উভয় শ্রেণি-ই বাংলাদেশের আদিম কিংবা প্রকৃত অধিবাসী নয়। তাদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে প্রচার করা মানে একটি ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক সত্যকে অস্বীকার করা; যে প্রচারণার পেছনে আমেরিকা, ভারত, মিয়ানমার, খ্রিস্টান মিশনারি ও বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিওর যৌথ মদদ ও ফান্ডিং রয়েছে। এছাড়া তাদের বেতনভুক্ত কিছু দেশীয় তথাকথিত সুশীলও রয়েছে। যাদের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা। ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ তাদের এহেন অবৈধ খায়েশ পূরণ হতে দিতে পারে না, দিবে না। ইনশায়াল্লাহ!

আমরা দেশবাসীকে এই ব্যাপারে সচেতন হওয়ার অনুরোধ করছি এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদেরকে সম্মিলিতভাবে রুখে দেবার আহবান জানাচ্ছি। এজন্য স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি সরকারের নিকট নিম্নোক্ত ৫ দফা দাবী পেশ করছে-

১. শিক্ষা মন্ত্রণালয়/সরকার থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দ প্রত্যাহার করার ঘোষণা আসতে হবে; নইলে বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে শিক্ষার্থীরা,

২. পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দ প্রবেশ করানোর সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের অপসারণ ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে,

৩. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেরকে ‘আদিবাসী’ বলা ও প্রচারণাকে রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারী করতে হবে,

৪. শিক্ষার মানোন্নয়নের নামে দেশের শিক্ষাখাতে বৈদেশিক বা আন্তর্জাতিক সংস্থা বা এনজিও থেকে তহবিল নেয়া বন্ধ করতে হবে এবং বৈদেশিক তহবিলে আমাদের শিক্ষার্থীদের মগজ বিক্রী করা যাবে না,

৫. দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ‘শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও পরিমার্জনে বিদেশী সংস্থা বা তাদের দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিদের থেকে শতভাগ প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’র পরামর্শ ও প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে।

অতএব, আমরা ৫ দফা দাবী সরকারকে অতিদ্রুত বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানাচ্ছি। নইলে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার স্বার্থে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবো। ইনশায়াল্লাহ!

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাবি শিক্ষার্থী ও ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’র মুখপাত্র মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম, যুগ্ম আহ্বায়ক মুহম্মদ ইয়াকুব মজুমদার, রাফসান, সায়েদুল, বায়েজিদসহ আরো অনেক শিক্ষার্থী।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন