পাহাড়ে সার্কেল চীফ প্রথার বাস্তবতা এবং সংবিধানের সাম্য ও ন্যায়-নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিকতা
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব ব্যবস্থা হলো সার্কেল চীফ প্রথা। এই প্রথা পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসছে এবং এটি তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে এই প্রথার বৈধতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিভিন্ন আইনগত ও সাংবিধানিক প্রশ্ন উঠেছে বারবার। পাশাপাশি, এই প্রথার কারণে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিরাও বেশ কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। আমার আজকের এই লেখাতে বাংলাদেশ সংবিধানের বিভিন্ন ধারা এবং গবেষকদের গবেষণার ভিত্তিতে সার্কেল চীফ প্রথার প্রাসঙ্গিকতা ও প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করবো।
সার্কেল চীফ প্রথা কী?
সার্কেল চীফ বা সার্কেল প্রধান হলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত নেতা, যিনি একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা সার্কেল পরিচালনা করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি প্রধান সার্কেল চীফ রয়েছেন— চাকমা, মং ও বোমাং। সার্কেল চীফ প্রথা স্থানীয় জনগণের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন এবং বিচার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই নেতারা স্থানীয় বিষয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, বিশেষ করে ভূমি বিতর্ক এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
কেন পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্কেল চীফ প্রথা চালু আছে?
এই প্রথা ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে চালু হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও এটি বহাল থাকে। এটি উপজাতি জনগোষ্ঠীর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রথা হিসেবে স্থানীয় সমাজে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, ১৯৯৭-এর মাধ্যমে এই প্রথাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় এবং চুক্তির ৪র্থ ধারা অনুযায়ী এই নেতৃবৃন্দের ভূমিকা আরও শক্তিশালী করা হয়। এটি উপজাতি জনগণের সামাজিক সংহতি রক্ষা এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সংবিধানের আলোকে সার্কেল চীফ প্রথার বৈধতা
সার্কেল চীফ প্রথা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে কীভাবে সাংঘর্ষিক হতে পারে তা বোঝার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারার আলোচনা প্রয়োজন:
সংবিধানের ২৭ ধারা: সাম্য ও ন্যায় বিচার
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ ধারা অনুযায়ী, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” এই ধারা অনুযায়ী, যদি বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হয়, তা অন্যান্য জনগণের অধিকার ও সংবিধানের সাম্যনীতির পরিপন্থী হতে পারে। সার্কেল চীফ প্রথায় নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ সুবিধা বা দায়িত্ব প্রদান করা হয়, যা সাম্যের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সংবিধানের ২৮(৪) ধারা: বৈষম্যরোধ নীতি
২৮(৪) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্র “নির্দিষ্ট অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।” এই ধারা সার্কেল চীফ প্রথার বৈধতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে, কেননা এটি একটি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেয়। তবে, এ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে সার্কেল চীফ প্রথাকে অনুমোদন দেওয়া হলে সংবিধানের অন্যান্য সমতার নীতির সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
সংবিধানের ২৩ ধারা: সংস্কৃতি ও ভাষা সংরক্ষণ
সংবিধানের ২৩ ধারা অনুযায়ী, “প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা সংরক্ষণের অধিকার রয়েছে।” সার্কেল চীফ প্রথা এই ধারা অনুযায়ী সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে, কারণ এটি পার্বত্য জনগণের নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। তবে এর বিচারব্যবস্থা ও পরিচালনা স্থানীয় প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
সার্কেল চীফ প্রথার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের অসুবিধা
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের জন্য সার্কেল চীফ প্রথা কিছু নির্দিষ্ট অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রথার কারণে সেখানে বসবাসরত বাঙালিরা নিম্নোক্ত সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়:
ভূমি অধিকারে সীমাবদ্ধতা: সার্কেল চীফ প্রথার মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয় এবং ভূমির মালিকানা ও ব্যবহার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সার্কেল চীফদের হাতে থাকে। এর ফলে, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিরা ভূমি অধিকার নিয়ে জটিলতার সম্মুখীন হন। তারা সাধারণত জমি ক্রয় ও ব্যবহার করতে আইনগত ও সামাজিক বাধার সম্মুখীন হন।
বিচার ব্যবস্থা ও ন্যায়বিচার: অনেক ক্ষেত্রে বাঙালিরা সরাসরি সার্কেল চীফের অধীনস্থ বিচার ব্যবস্থার অধিকার পায় না বা ভিন্ন বিচার পদ্ধতির মুখোমুখি হয়। এটি তাদের ন্যায়বিচারের অধিকার সীমিত করে, কারণ বিচার ব্যবস্থায় এই পৃথকীকরণ সাম্যের নীতির পরিপন্থী।
সংস্কৃতিগত ও সামাজিক পৃথকীকরণ: সার্কেল চীফ প্রথা উপজাতি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করে, কিন্তু এই পৃথকীকরণ প্রথা স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর সামাজিক একীকরণ বাধাগ্রস্ত করে। এটি পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত উপজাতি এবং বাঙালিদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
নিরাপত্তা ও সামাজিক সংহতি: পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক সংহতির অভাবে বাঙালিরা মাঝে মাঝে নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হন। সার্কেল চীফ প্রথার কারণে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা সীমিত হয়, যা সমাজে বিরোধ ও সামাজিক সংঘাতের কারণ হতে পারে।
গবেষকদের অভিমত
গবেষক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্কেল চীফ প্রথা সংস্কৃতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি স্থানীয় ও জাতীয় আইনের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে” আরেকজন গবেষক বলেন, “প্রথাগত নেতৃত্ব ব্যবস্থা একটি প্রাচীন ঐতিহ্য, যা ঐ অঞ্চলের মানুষের সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সাহায্য করে” (চৌধুরী, ২০২২)। তবে, তাদের মতে, এটি সমগ্র এলাকার সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে চালিত করার পথে বাধা তৈরি করে।
সার্কেল চীফ প্রথা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী প্রথা, যা স্থানীয় উপজাতি জনগণের জন্য ঐতিহ্যগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তবে, এটি বাংলাদেশের সংবিধান ও জাতীয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বিশেষ করে সাম্য ও ন্যায় বিচারের নীতি অনুসারে। পাশাপাশি, এটি পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি জনগণের ভূমি অধিকার, বিচার ব্যবস্থা এবং সামাজিক একীকরণে সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধা সৃষ্টি করছে, যা একটি সমন্বিত ও সাম্যের ভিত্তিতে প্রশাসনিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়ায়।
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক