পুনর্বাসনের তালিকা থেকে পার্বত্য বাঙালি উদ্বাস্তুদের বাতিলের পাঁয়তারা চলছে

fec-image

বিগত শতাব্দীর আশির ও নব্বই  দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান অশান্ত পরিস্থিতির কারণে পার্বত্য অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। পাশাপাশি এই সময়ে বিরাজিত অস্থিতিশীল ও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বিশাল সংখ্যক পার্বত্যবাসী নিজ বাস্তভিটা ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। ভারতে আশ্রিত উপজাতীয় শরণার্থীদের দেশে ফেরত আনতে বাংলাদেশ সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৯৭ সালের ৯ মার্চ জাতীয় সংসদের তৎকালীন চীফ হুইপের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির সাথে জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির নেতৃবর্গের কয়েক দফা সংলাপের পর শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনের জন্য ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি বাস্তবায়নে সহায়তা ও পর্যবেক্ষণে এবং আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সহায়তা দেয়ার নিমিত্তে তৎকালীন স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ কর্তৃক ১৯৯৭ সালের ৮ এপ্রিল ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এ টাস্কফোর্সের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের নির্দিষ্টকরণ এবং তাদের যথাযথভাবে পুনর্বাসনের মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন সাধন করা।

বর্তমান টাস্কফোর্স কমিটিতে আছেন চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমা (সিনিয়র সচিব পদমর্যদায়), পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা প্রতিনিধিগণ, তিন পার্বত্য জেলা প্রশাসক, তিন সার্কেল চিফ, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের একজন প্রতিনিধি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একজন প্রতিনিধি, প্রত্যাগত শরণার্থীদের একজন প্রতিনিধি, একজন বাঙ্গালী প্রতিনিধি এবং সদস্য সচিব রয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার।

এ টাস্কফোর্সের কার্যক্রমের আওতায় ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় ১২ হাজার ২২৩টি শরণার্থী পরিবারের মধ্যে প্রতিবছর ১৫,৫১৪.২৬৯ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়। দেশে ফেরত আসার পর প্রত্যাগত শরণার্থীদের এ রেশন বিতরণ ছয় মাসের জন্য নির্ধারিত থাকলেও গত ২৮ বছর ধরে এই রেশন বিতরণ কার্যক্রম চলছে উপজাতীয় শরণার্থীদের মাঝে। ২০ দফা প্যাকেজের আওতায় গৃহ নির্মাণ, কৃষি অনুদান, হালের গরু ও ঢেউটিন প্রদান, ভূমিহীনদের গাভী প্রদান, কৃষি ঋণ মওকুফ, অন্যান্য সরকারি ব্যাংক, বোর্ড, সংস্থার ঋণ মওকুফ, জমি ফেরত, চাকরিতে পুনর্বহাল ও ক্ষতিপূরণ প্রদান, চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারসহ বয়স শিথিল করা, ফৌজদারী মামলা প্রত্যাহার ও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাসহ অধিকাংশ দাবি পূরণ করা হয় প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থীদের।

এ টাস্কফোর্স অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের বিষয়ে উপজাতীয় উদ্বাস্তু পরিবারদের তালিকা অন্তর্ভুক্তকরণ ছাড়া তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। মূলত ভূমি কমিশন কর্তৃক ভূমি জটিলতা নিরসন করলে এই টাস্কফোর্স অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন কাজে উদ্যোগী হতে পারবে বলে সচেতন মহল মনে করেন। তবে এ টাস্কফোর্স বাঙালি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পরিবারদের পুনর্বাসনের বিষয়ে আগ্রহী নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে। এ টাস্কফোর্সের প্রাক্তন চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, এমপির সভাপতিত্বে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে গত ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর টাস্কফোর্স সভায় ৮৯,২৮০ উপজাতীয় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত পরিবার এবং ৫৭,৬৯২ অ-উপজাতীয় তথা বাঙালি উদ্বাস্তু পরিবারের তালিকার সংখ্যার বিষয়ে পুনর্বাসনের নিমিত্তে উপস্থাপন করা হয়।

বাঙালি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত্তদের বিষয়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সভায় জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি লক্ষ্মীপ্রসাদ চাকমা দ্বিমত পোষণ করে উক্ত বাঙালি পরিবারগুলোকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করার আহ্বান জানান। যদিও এ সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, তৎকালীন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক ও জিওসির প্রতিনিধি অ-উপজাতীয়দের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত করে এর প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব তুলে ধরে তাদের অন্তর্ভুক্তি যথাযথ হয়েছে মর্মে অভিমত প্রদান করেন। তারা আরো বলেন, ‘যিনি বাস্তু থেকে উৎখাত হয়েছেন তিনিই উদ্বাস্তু। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয় সকলকে অন্তর্ভুক্ত রাখা বাঞ্ছনীয়’। তারপরও এ সভায় ১১(চ) সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ‘অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা কী হবে সে বিষয়ে নির্দেশনার জন্য বিষয়টি আগামী শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণ কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হবে’।

২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরার ৩য় সভায়ও অ-উপজাতীয় পরিবারগুলোকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করার ব্যাপারে পুনরায় আহ্বান জানান জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি লক্ষীপ্রসাদ চাকমা। পরপর টাস্কফোর্স দুটি সভায় জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধির আপত্তির পর ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরার ৪র্থ টাস্কফোর্স সভায় জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্ত্ত লারমা ) উপস্থিত থেকে পূর্ববর্তী ৩য় সভার সিদ্ধান্ত ১২(ঘ) ‘অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু এর সংজ্ঞা কী হবে সে বিষয়ে নির্দেশনার জন্য বিষয়টি  শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হবে’  সিদ্ধান্তটি বাতিল করেন। এই সভায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত্ত সংজ্ঞা নির্ণয়কল্পে সিদ্ধান্ত ৬(ক) মতে বলা হয়, ‘আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত্ত নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের ১৯৯৮ সালের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হবে।’

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্স সভার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত ‘ক’-তে বলা হয়, ‘১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট হতে ১০ আগস্ট ১৯৯২ পর্যন্ত (অস্ত্র বিরতির শুরুর দিন) সময়কালে পার্বত্য চট্টগ্রামে (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান) বিরাজিত  অস্থিতিশীল ও অশান্ত পরিস্থিতির কারণে যে সকল উপজাতি নিজ গ্রাম, মৌজা, অঞ্চল ত্যাগ করে স্বদেশের মধ্যে অন্যত্র চলে গেছেন বা চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন তারা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে যে সকল অ-উপজাতীয় ব্যক্তিরা উপরোক্ত সময়ে বিরাজিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি একই সাথে ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হবে।’ এই সংজ্ঞার আওতায় অ-উপজাতীয় তথা বাঙালি উদ্বাস্তু পরিবার যারা উক্ত অশান্ত ও অস্থিতিশীল সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে এ ৪র্থ টাস্কফোর্স সভায় ৬(খ), ৬(গ) মতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, অ-উপজাতীয় ক্ষতিগ্রস্ত  পরিবারগুলোকে (এ সভার কার্যবিবরণীতে মুদ্রণ বিভ্রাটজনিত কারণে অউপজাতীয় শরণার্থী উল্লেখ করা হয়) সরকার ভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যবস্থা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।’

কিন্তু ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় আবারো সন্তু লারমা উপস্থিত হয়ে ৪র্থ টাস্কফোর্স সভার ৬(খ) এবং ৬(গ) সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে উক্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করান। অর্থাৎ ৮৯,২৮০ উপজাতীয় উদ্বাস্তু পরিবারের পুনর্বাসনের বিষয়টি বহাল থাকবে পাশাপাশি ৫৭,৬৯২ অ-উপজাতীয় তথা বাঙালি পরিবারের পুনর্বাসনের বিষয়টি বাতিল করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম সভাগুলোতে বাঙালি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিষয়ে নানা অপকৌশলে আর কোন আলোচনা করতে দেয়া হয়নি। তবে ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা এমপির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের ১০ম সভায় জিওসির প্রতিনিধি মেজর মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ৫ম সভায় বাদ দেয়ার বিষয়টি উত্থাপন করলে তাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে মানবিক কারণে আলাদাভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে মর্মে এ সভায় ১১(খ) সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের ১১তম সভায় আবারো অ-উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পদক্ষেপের প্রশ্নে যৌক্তিকতা উপস্থাপিত হলে এই সভার সিদ্ধান্ত ১-এ বলা হয়, ‘… অ-উপজাতীয়দের নতুন করে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত আগামী সভায় সকল সদস্যদের উপস্থিতিতে চূড়ান্ত করা হবে।’

এখন আগামী ২২/১০ /২০২৫ তারিখে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সকাল ১১টায় বিগত সরকারের আমলে নিয়োগকৃত চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পরবর্তী টাস্কফোর্স সভা। ১৬ সদস্যের এই টাস্কফোর্সে বাঙালি সদস্যের পদটি পদত্যাগজনিত কারণে বর্তমানে শূন্য রয়েছে। বাঙালি সদস্যের অনুপস্থিতিতে বাঙালি উদ্বাস্তুর অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কীভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তা দেখার অপেক্ষায় আছে পার্বত্যবাসী। নাকি সন্তু লারমা গংদের প্রবল আপত্তি, বিরোধিতায় ও অপকৌশলে বাদ যাবে বাঙালি উদ্বাস্ত্তদের পুনর্বাসনের বিষয়টি?

 

লেখক: ইউসুফ হায়দার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: টাস্কফোর্স, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাঙালি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন