প্রবারণা পূর্ণিমায় মহালছড়ির চেঙ্গী নদীতে জাহাজ ভাসা উৎসব

fec-image

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত তিন মাস বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাবাস শেষে এই প্রবারণা উৎসব পালন করা হয়। প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে এক মাসব্যাপী দেশের প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে শুরু হয় বৌদ্ধদের কঠিন চীবর দানোৎসব।

এই প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়িতে রবিবার (১৩ অক্টোবর) বিকাল দুইটার সময় মহালছড়ি প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন কমিটির আয়োজনে সারাদিন ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মহালছড়ির চেঙ্গী নদীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ঐতিহ্যবাহী রিছিমি (কল্প জাহাজ) ভাসা উৎসব।

সকাল ৬ টার সময় বুদ্ধ পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়ে পঞ্চশীল প্রার্থনা ও গ্রহণসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদী সম্পন্ন করা হয়। এরপর সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে এক রিছিমি মঙ্গল শোভাযাত্রা কার্টুন ও ফেস্টুন সহকারে মহালছড়ির বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

অনুষ্ঠানের শেষে দুপুর আড়াইটার দিকে মহালছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কান্তি চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী কর্তৃক মোমবাতি জ্বালিয়ে রিছিমি (কল্প জাহাজ) ভাসা উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এর আগে অতিথিদের সৌজন্যে একটি মারমা নৃত্য পরিবেশন করা হয়।

এই সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য অতিথি মহালছড়ি জোন অধিনায়কের পক্ষে জোন উপ অধিনায়ক আসিফ ইকবাল, বিশেষ অতিথি খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য জুয়েল চাকমা, মহালছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা দত্ত, মহালছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ নুরে আলম ফকির, মহালছড়ি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুইনুচিং চৌধুরী, মহালছড়ি সদর ইউপি চেয়ারম্যান ও মহালছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রতন কুমার শীল ও ২ নং মুবাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান বাপ্পি খীসা।

সংক্ষিপ্ত আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন ধর্ম যার যার উৎসব সবার, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রীতির বন্ধন ঘটেছে, ভগবান বুদ্ধের বাণী অহিংসা পরম ধর্ম, এই বাণীকে বুকে লালন করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

উল্লেখ্য যে, কথিত আছে এক সময় বৈশালীতে দূর্ভিক্ষ, মহামারি ও অমনুষ্যে এই ত্রি-বিধ উপদ্রবে রাজ্যে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। তাতে প্রজারা চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন এবং রাজার কাছে সেই বার্তা পৌঁছালেন। রাজাও প্রজাদের এমন অবস্থা দেখে চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সহসায় এই দুরবস্থা থেকে পরিত্রান লাভের জন্য রাজ্যের রাজা প্রমূখ অমাত্যের উপদেশে বুদ্ধের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

বুদ্ধ তখন রাজগৃহে বিম্বিসার রাজার দানকৃত পূর্বারাম বিহারে অবস্থান করছিলেন। বৈশালীবাসীগণ মহালি লিচ্ছবি ও রাজা পুরোহিত পুত্রকে রাজা বিম্বিসারের কাছে পাঠালেন এবং বিনীত ভাবে এই বিষয় অবগত করলেন। বিম্বিসার রাজা এবং মহালি লিচ্ছবি সকলেই বুদ্ধকে ফাং করলেন বৈশালীতে গমন করার জন্য। বুদ্ধ সেই ফাং ( আমন্ত্রন) গ্রহণ করে বিম্বিসার রাজার সাথে বৈশালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

বিম্বিসার রাজা বুদ্ধের গমনা-গমনের সকল রাস্তা সজ্জিত করে দিল। গঙ্গা নদীতে রাজা বিম্বিসার ২টি নৌকা সজ্জিত করে বুদ্ধের জন্য সুব্যবস্থা করে দিলেন, যাতে বুদ্ধ তার পাঁচশত শিষ্যসহ সুন্দর ভাবে বৈশালী পৌঁছতে পারেন।

বুদ্ধ প্রমুখ পাঁচশত শিষ্যসহ বৈশালীতে উপস্থিত হলে আনন্দ স্থবিরকে বলেছিলেন, আনন্দ রতন সূত্র পাঠ করে সমস্ত বৈশালী রাজ্যে মঙ্গলাজল সিঞ্চন কর! যাতে করে রাজ্যের সমস্ত উপদ্রব দুরীভুত হয়। আনন্দও বুদ্ধের উপদেশে তা প্রতিপালন করলেন। জল সিঞ্চনের সাথে সাথে সারা বৈশালী থেকে সমস্ত মহামারি দুরীভুত হয়ে গিয়েছিল। বৈশালী আবার সেই পুরনো পরিবেশকে ফিরে পেয়েছিল। বৈশালী রাজারা বুদ্ধকে আবারও যথাযোগ্য পূজা দিয়ে রাজগৃহের পথে যাত্রা করলেন।

এদিকে, নাগলোকের মহাঋদ্ধিমান নাগেরা চিন্তা করলেন মনুষ্য পুত্ররা বুদ্ধকে কতই পূজা করছে। আমরাও এই সুযোগে বুদ্ধকে স্বশরীরে পূজা করতে যাব। সাথে সাথে তারাও নাগলোক থেকে পাঁচশত নাগরাজ বিমাণের (জাহাজের) মত ঋদ্ধিময় ফণা বিস্তার করে বুদ্ধ প্রমূখ পাঁচশত শিষ্যের মাথার উপরে স্থাপিত করলেন। এই ভাবে নাগরাজের এই ঋদ্ধিময় বিমাণের (জাহাজের) রূপ ধারণের মাধ্যমে পূজা দর্শন করে স্বর্গের দেবতাসহ ব্রহ্মলোকের ব্রহ্মারাও তা অবলোকন করে বুদ্ধকে পূজা করতে এসেছেন। সেই দিবসটি ছিল বর্ষাবাসের সমাপ্তি দিবস “প্রবারণা”।

সেই দিবসে বুদ্ধ প্রমুখ পাঁচশত শিষ্যকে মনুষ্যগণ, নাগগণ, দেবগণ, ব্রহ্মাগণ শ্বেতছত্র ধারণ করে ধর্মীয় পতাকা উন্ডীয়ন করে ঋদ্ধিময় পূজা করেছিলেন। বুদ্ধ সেই পূজা লাভ করে রাজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এই মহান চিরসত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বেশেষে বৌদ্ধরা সকলেই জাহাজ ভাসা উৎসব উদযাপন করে থাকে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আশ্বিনী পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, বৌদ্ধ ধর্ম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন