প্রবারণা শেষ দিনে রথ বিসর্জনের বান্দরবানে বৌদ্ধদের ঢল


রথ বিসর্জন মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শেষ হয়েছে প্রবারণা পূর্ণিমা। পুরো আকাশ রঙ্গিনে মুখরিত ছিল বিভিন্ন রঙ-বেরঙের ফানুস। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব ছিল এই দিনটি। আলো আর প্রার্থনায় মুখরিত ছিল পুরো বান্দরবান শহর। প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আত্মশুদ্ধি ও ধর্মীয় প্রতিজ্ঞার দিন। ত্রিমাত্রিক রথযাত্রা, ধর্মীয় আলোচনা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করেছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। শেষ দিনে বান্দরবানে শহরজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। এই দিনে বৌদ্ধ জাতিরা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির প্রতিজ্ঞা করে থাকেন। যথাযোগ্য মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি হয়েছে এই প্রবারণা উৎসবটি।
আষাঢ়ী পুর্ণিমা তিথি থেকে আশ্বাঢী পুর্ণিমা তিথিতে তিনমাস বর্ষব্রত পালনের পর আসে এই অন্যতম ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। এই উৎসবকে ঘিরে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরে ছিল নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা। ছোয়াইং (আহার), ফলমুল, অর্থ দান, বুদ্ধস্নান, পিঠা তৈরি,পঞ্চমশীল গ্রহণ, ফানুস উত্তোলনসহ রথযাত্রার বিসর্জন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই দিনে নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে মেতে উঠেছিলেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ।
প্রবারণা শেষ দিনেও কমতি ছিল না আনন্দের। রথযাত্রা মাধ্যমে উৎসবের আমেজে মুখরিত ছিল পুরো বান্দরবান শহর। বিভিন্ন গ্রাম মহল্লায় থেকে হাজার হাজার বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা প্রধান সড়কের জড়ো হতে থাকেন। নিজস্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্য পোশাকে পরিধান করে সকলের প্রার্থনায় মেতে উঠেন ছোট- বড় সকল বয়সের মানুষ। শহরে মারমা বাজার, উজানী পাড়া, মধ্যম পাড়া,রাজার মাঠ ও সাঙ্গু নদীর খেয়া ঘাটে হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর ছিল। বেড়াতে আসা পর্যটকরাও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংস্কৃতি,ঐতিহ্য ও ধর্মের রীতিনীতি দেখতে ভীড় জমিয়েছেন অনেকেই।
রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার থেকে সন্ধায় পাঁচটায় বের হয় প্রবারণা পূর্ণিমা মুল আকর্ষণ রাজহংসী রথটি। রথের পাহাদার ও আনন্দ দিতে কাল্পনিক ভুত (পোছোহ মা) বের করা হয়। বৌদ্ধ বিহার থেকে বের হয়ে রাজার মাঠ, মধ্যম পাড়া,উজানী পাড়াসহ প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষীন করা হয়। রথযাত্রাকে ঘিরে প্রতিটি অলিগলি ও সড়কের পাশের বৌদ্ধ অনুসারীরা অপেক্ষায় মগ্ন ছিলেন। নিজেদের পাপ থেকে মুক্তি, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ, দেশ ও পাহাড়ের অশান্তি দূর করে শান্তি ফিরিয়ে আনার আশায় মোববাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন হাজার হাজার বৌদ্ধ অনুসারীরা। শেষ দিনের নেঁচে গেয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছিল হাজার হাজার মানুষ।
পুরো শহর প্রদক্ষিণ শেষে রাজহংসী রথটি পৌছায় উজানী পাড়া সাঙ্গু নদীর খেয়া ঘাটে। রথটিকে বিদায় ও বিসর্জন দিতে মোমবাতি হাতে নিয়ে সাঙ্গু নদীর তীরে উপস্থিত হন বৌদ্ধ অনুসারীরা। রথটি বিসর্জন পর বিভিন্ন রঙ বেরঙের ফানুস জ্বলে উঠে পুরো আকাশ। শতাধিক বিভিন্ন রঙের ফানুস চুলামনি উদ্যেশ্য উড়িয়ে দেশ ও পাহাড় মঙ্গল কামনায় করেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। সাঙ্গু পানিতে ভাসানো হয় বিভিন্ন রঙ্গের কাগজের তৈরী মোমবাতি। প্রবারণা পূর্ণিমা শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয় এটি মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য আর সহাবস্থানের উৎসব। যা প্রতিবছর পালন করে আসছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা।
বৌদ্ধ অনুসারী উমংসিং ও হিমু মারমা বলেন, রথ বিসর্জন মধ্য দিয়ে আজকে প্রবারনা শেষ হবে। আমরা খুব খুশি এবং আনন্দিত। রথ বিসর্জন মাধ্যমে অশুভ দিনটি মুছে গিয়ে পাহাড়ে সুখ শান্তি ফিরে আসুক এইটা আমাদের কামনা ।
সাঙ্গু নদী ঘাটে ফানুস উড়াতে এসেছেন ঢাকা থেকে বেড়া আসা দম্পতির ঈশিকা ও আবির রহমান। তারা জানান, পাহাড়ের বৌদ্ধদের যে সংস্কৃতি ঐতিহ্য সেটি আমাদেরকে অবাক করে তোলে। প্রতিটি নারী-পুরুষ নিজেদের ঐতিহ্য পোশাকে পরিধান করে রথযাত্রায় অংশ নিচ্ছে। এইটা দেখে আমরা মনোমুগ্ধকর। আমরাও চাই দেশ ও পাহাড়ের শান্তি ফিরে আসুক আর সম্প্রীতি সৌন্দর্যবর্ধন বজায় রাখুক এইটা কামনা।
প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব উদযাপন পরিষদের সহ-সভাপতি লুবু প্রু মারমা বলেন, প্রবারণা দুইদিন ঘিরে নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছিল। আজ শেষ দিন। রথটি বিসর্জন মাধ্যমে দেশে ও পাহাড়ের অশুভ মুছে যাক এই আশা ব্যক্ত করছি।
প্রবারণা শেষ দিনকে ঘিরে প্রতিটি অলিগলিতে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত রয়েছে বলে সদর থানা উপ-পরিদর্শক আবিদ বলেন, পুলিশ সুপার ও সদর থানা ওসি নিরাপত্তা রোডম্যাপ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা দ্বায়িত্ব পালন করছেন। যাতে এই উৎসবের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। আর আমরা আশাবাদী শেষ দিনেও সবাই আনন্দের মুখর হয়ে উঠবে পুরো জেলা।

















