বাবু চুনীলাল দেওয়ানের স্ত্রী রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিলেন
রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার চেঙ্গী নদীর উপর নির্মিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল সেতুর নামকরণ করা হয়েছে চিত্রশিল্পী ‘বাবু চুনীলাল দেওয়ান সেতু’। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে সেতুটির এ নামকরণের প্রজ্ঞাপন জারির খবর জানাজানি হলে পাহাড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদ (পিসিসিপি) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ (পিসিএনপি)’র পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে নানিয়ারচরে সেতুটির অদূরে চির নিদ্রায় শায়িত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে নামকরণের জোর দাবি জানানো হয়।
বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ (পিসিএনপি) রাঙামাটি জেলা শাখা। মানববন্ধন থেকে নানিয়ারচর সেতুটি ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ’র নামকরণের দাবি জানানো হয়েছে। মানববন্ধনে নাগরিক পরিষদ রাঙামাটি জেলা সহ-সভাপতি কাজী জালোয়ার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মজিবর রহমান, কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও বান্দরবান জেলা সভাপতি, আলীকদম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম, মহাসচিব আলমগীর কবির, রাঙামাটি জেলা সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সোলায়মান, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি মো. হাবীব আজম প্রমুখ। এর পাশাপাশি সামাজাকি যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নামকরণ নিয়ে সাধারণ মানুষকে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
ইতিপূর্বে নানিয়ারচরসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ সেতুটির নাম বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে নামকরণের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। প্রধানমন্ত্রীকে একাধিক স্মারকলিপিও দেয়া হয়েছে। সেসব কিছু আমলে না নিয়ে হুট করে সেতুর নাম বাবু চুনীলাল দেওয়ানের নামে নামকরণকে মেনে নিতে পারছে না তারা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, সাধারণ মানুষের দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে হঠাৎ এমন কী ঘটে গেল, যার কারণে সেতুটির নাম এমন একজনের নামে করা হলো যাকে এ প্রজন্মের কেউ চিনেই না।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ’ এর তথ্য মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবু চুনীলাল দেওয়ানের স্ত্রী বসুন্ধরা দেওয়ান নানিয়ারচরের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিলেন। এ খবর জানাজানি হওয়ার পর মানুষের মনে সেতুর নামকরণের পেছনের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্ট করতেই কৌশলে এমন কাজ করা হয়েছে সুচতুর কোনো মহলের পক্ষ থেকে।
২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে নানিয়ারচরে চেঙ্গী নদীতে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে ২০ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন ও সওজ সেতুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে। ৫০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ দশমিক ২ মিটার প্রস্থের এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২২৭ দশমিক ৬১ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুন মাসে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি বুধবার সকাল ১১টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
সেতুটির নির্মাণকালেই এর নামকরণের দাবি উঠতে থাকে নানিয়ারচরে মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করে শহীদ হওয়া বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে। সেতুটির অদূরে এখনো যার সমাধি বিদ্যমান রয়েছে। সে সময় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে সেতুর নামকরণের দাবির প্রতি বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও সংহতি জানানো হয়।
২০২০ সালের ২৬ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড নানিয়ারচর শাখার ব্যানারে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে সেতুর নামকরণের দাবিতে মানববন্ধন করা হয়। তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে এতে নানিয়ারচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াব হাওলাদারসহ গণ্যমান্য আরো অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। মানবন্ধন শেষে নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলি রহমান তন্নীর কাছে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়।
একই সংগঠনের উদ্যোগে পরের দিন ২৭ জুলাই সেতুটির নাম বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে নামকরণের দাবিতে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আরো একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি উদ্বোধনের এক বছর পর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে ৩ জানুয়ারি ২০২৩ জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেতুটির ‘বাবু চুনীলাল দেওয়ান সেতু’ নামকরণ করা হয়। ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার সেতুর এই নামকরণের ফলক উন্মোচন করেন।
বাবু চুনীলাল দেওয়ানের নামে সেতুর নামকরণ প্রসঙ্গে নানিয়ারচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াব হাওলাদার জানান, এই নামকরণের ব্যাপারে আমাদের মতামত কেউ জানতে চায়নি। তাই এ ব্যাপারে কিছু জানি না। তবে আগে আমরা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে সেতুর নামকরণের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা তো আর হলো না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চুনীলাল দেওয়ানের স্ত্রী বসুন্ধরা দেওয়ানের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি সামনে আসায় এখন এই সেতুর নামকরণ নিয়ে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে রাঙামাটি সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার জানান, ‘বাবু চুনীলাল দেওয়ানের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী বা পরিবারের সদস্যরা কে কী করেছেন তার দায় তো উনার না।’
এই প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অভিমত জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বিস্তারিত তথ্যের জন্য জেলা প্রশাসক রাঙামাটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় মতামত নেয়া সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, পিতা শশীমোহন দেওয়ানের কর্মসূত্রে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় জন্ম নেওয়া চিত্রশিল্পী চুনীলাল দেওয়ান (১৯১১-১৯৫৫ খ্রি.) মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নানিয়ারচর এলাকার ছয়কুড়ি বিল মৌজা ও মাইচছড়ি মৌজার হেডম্যান ছিলেন। পাশাপাশি তিনি নানিয়ারচর বাজারের চৌধুরীও ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে মৃত্যুর সময় তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী, পাঁচ ছেলে, এক কন্যা রেখে যান।
চুনীলাল দেওয়ানের মৃত্যুর পর স্ত্রী বসুন্ধরা দেওয়ান ছয়কুড়ি বিল মৌজার হেডম্যান এবং নানিয়ারচর বাজার চৌধুরীর দায়িত্ব পান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায়ের নির্দেশে নানিয়ারচরের অন্যান্য হেডম্যান-কারবারিদের নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়, যার প্রধান ছিলেন বসুন্ধরা দেওয়ান। মুক্তিযুদ্ধের সময় চুনীলাল দেওয়ানের ছেলেমেয়েরা সবাই ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের ছিলেন। কিন্তু সে সময় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণায় কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বসুন্ধরা দেওয়ান জেএসএস’র সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে জানা গেছে। বহুল আলোচিত-সমালোচিত ডকুমেন্টারি ‘কর্ণফুলীর কান্না’র অন্যতম সূত্রও ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে বসুন্ধরা দেওয়ানকে মরণোত্তর সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়েছিল।