মর্গে পড়ে থাকার ২৫দিন পর উপজাতি তরুণীর লাশ হস্তান্তর

fec-image

আইনি জটিলতায় দীর্ঘ ২৫দিন হাসপাতাল মর্গে পড়ে থাকার পর অবশেষে স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে আলোচিত লাকিংমে চাকমার লাশ।

সোমবার (৪ জানুয়ারি) বিকাল ৩টার দিকে পিতা লালা অং চাকমার হাতে লাশটি তুলে দেয়া হয়। লাশ গ্রহণকালে স্বজনদের মাঝে হৃদয়বিদরক দৃশ্য অবতারণা হয়।

এ সময় র‌্যাব-১৫ এর উপপরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অঞ্জন চৌধুরী, সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মোহাম্মদ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

লাশ বুঝে নেওয়ার পর টেকনাফ শিলখালী চাকমা পাড়ার লাকিংমের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবেনা বলে স্বজনেরা জানিয়েছে। সেখানে নিলে তারা লাশ তুলে ফেলার আশঙ্কা করছে। যে কারণে রামুতে নিয়ে যাবে। ওখানে নিয়ে পুড়াবে না। মাটিতে দাফন করবে।

গত বছরের (২০২০ সাল) ১৩ জানুয়ারি আদালতে করা মামলায় লাকিংমে চাকমার বাবা লালা অং চাকমা অভিযোগ করেন, সপ্তমশ্রেণি পড়ুয়া তার মেয়েকে অপহরণ করেছে টেকনাফের আতাউল্লাহ। সেই মামলার তদন্ত চলাকালে ১৫ ডিসেম্বর খবর পান, লাকিংমের লাশ পড়ে আছে হাসপাতালের মর্গে। মেয়ের লাশ নিতে গিয়েও পড়েন বিপত্তিতে। অপহরণ, নাবালিকা বিয়ে এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত আতাউল্লাহ বাদ সাধলেন।

নিজেকে লাকিংমে চাকমার স্বামী দাবি করে লাশ নেওয়ার আবেদন করেন তিনি। ফলে এই আবেদন গড়িয়েছে আদালতে। সেই পটভূমিতে তদন্ত সাপেক্ষে মৃতের ‘ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত’ হয়ে র‌্যাবকে মরদেহ সৎকার করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র‌্যাবকে।

বিস্তারিত অনুসন্ধান শেষে লাকিংমে চাকমাকে ‘শিশু’ হিসেবে চিহ্নিত করেন তদন্ত কর্মকর্তা অঞ্জন চৌধুরী। বিষয়টি তিনি আদালতে অবহিত করেন। পরে বিধি মোতাবেক লাশটি পরিবারের নিকট হস্তান্তরের প্রক্রিয়া করা হয়।

স্থানীয়রা বলছে, মূলতঃ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মেয়ে লাকিংমে চাকমাকে তুলে নিয়ে ধর্মান্তরিত করে আতাউল্লাহ নামের যুবক বিয়ে করেছেন বলে পরিবারের অভিযোগ, থানা মামলা না নিলে তার পরিবারের আদালতে যাওয়া, পুলিশের প্রতিবেদনে মেয়েটির স্বেচ্ছায় চলে যাওয়ার কথা, মেয়েটিকে নিজের স্ত্রী হালিমাতুল সাদিয়া দাবি করে লাশ ফেরত চাওয়া, জন্মদাতার দাবি নিয়ে মেয়ে লাকিংমের শেষকৃত্য করতে বাবার আবেদন সবকিছুর ঊর্ধ্বে এই নিথর দেহটি। আইনি জটিলতার পরও অন্তত লাশটি পেয়ে প্রশাসন ও গণমাধ্যকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে লাকিংমে চাকমার বাবাসহ স্বজনেরা।

বাবা লালা অং চাকমার দাবি, ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি তাঁর মেয়ে লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়। ওই দিন তিনি কক্সবাজারের টেকনাফে শীলখালীর চাকমাপাড়ায় নিজের বাড়িতে ছিলেন না। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ে স্থানীয় শামলাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। বাড়ি ফিরে জানতে পারেন মেয়েকে অটোরিকশায় করে তুলে নিয়ে যান টেকনাফের বাহারছড়া মাথাভাঙ্গার এলাকার আতাউল্লাহ, ইয়াসিন, ইসা, আবুইয়াসহ আরও চার-পাঁচজন। জন্মসনদ অনুসারে ওই দিন মেয়ের বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস। তিনি বিষয়টি ওই দিনই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোহাম্মদ হাফেজকে জানান। কিন্তু ইউপি সদস্য কোনো ব্যবস্থা নেননি।

তখন লালা অং চাকমা টেকনাফ মডেল থানায় মামলা করতে গেলে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ (অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় বরখাস্ত) মামলা নিতে রাজি হননি। ২৭ জানুয়ারি তিনি কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেন।

পিবিআই গত বছরের ৯ আগস্ট কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, লাকিংমে চাকমাকে অপহরণ করার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে অন্তত পাঁচজন সাক্ষী জবানবন্দিতে লাকিংমেকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন বলে মেয়েটির বাবার দাবি।

এমন দাবির বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই কক্সবাজার ইউনিটের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ক্যশৈনু মারমার ভাষ্য, ‘এজাহারে যে পাঁচজনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে, তাঁরা লাকিংমের আত্মীয়। সাক্ষী ছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। ওই পাঁচজন সাক্ষী ছাড়া এলাকার আর কেউ অপহরণের কথা বলেনি। ফলে আমি তদন্ত প্রতিবেদনে লাকিংমে নিজেই চলে গেছে বলে উল্লেখ করেছি।’

বাবা লালা অং চাকমার দাবি, ১১ মাস পর তিনি জানতে পারেন মেয়ে লাকিংমের লাশ মর্গে পড়ে আছে। তিনি লাশ নিতে গিয়ে জানতে পারেন অপহরণ, নাবালিকা বিয়ে ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার অভিযোগে যে আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছিলেন; সেই আতাউল্লাহ স্বামী দাবি করে লাশ নেওয়ার আবেদন করেছেন। এ আবেদন গড়িয়েছে আদালতে। তদন্ত সাপেক্ষে মৃতের ‘ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত’ হয়ে র‌্যাবকে লাশের শেষকৃত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন