রাখাইনের প্রায় পুরোটাই আরাকান আর্মির দখলে

fec-image

রাখাইনের পর্যটন এলাকা এনগাপালি বিচের নিকটবর্তী শহর থান্ডওয়ের বিমানবন্দরটি গত মাসের শেষদিকে দখল করে নেয় আরাকান আর্মি। এর সঙ্গে সঙ্গে দখলে নেয় ওই এলাকার বিলাসবহুল হোটেলগুলোও। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় থান্ডওয়ে শহরে দেশটির সামরিক জান্তার অনুগত সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে।

আরাকান আর্মি সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবির বরাত দিয়ে মিয়ানমারের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহে ওই এলাকায় ১৫টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ধ্বংস করে দিয়েছে বিদ্রোহীরা। পরাজিত করেছে আয়রাওয়াদ্দি অঞ্চল থেকে আসা অতিরিক্ত সৈন্য ও থান্ডওয়েভিত্তিক মিলিশিয়াদেরও। শহরটি দখলের লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছে জান্তা বাহিনীর চার শতাধিক সৈন্য। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদের দখল নিয়েছে বিদ্রোহীরা।

আরাকান আর্মির দাবি, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নয়, রাখাইনে তাদের লড়াইয়ের উদ্দেশ্য হলো রাখাইনের জন্য ‘কনফেডারেশনের’ মর্যাদা পাওয়া। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে বছর শেষ হওয়ার আগেই এখান থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে। তবে এক্ষেত্রে তাদের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হবে বর্মি সামরিক বাহিনীকে রাখাইন থেকে দূরে রাখা।

বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অনুগত বাহিনীর অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, রাজ্যটি এখন পুরোপুরিই বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে বলা চলে। কয়েকটি স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক জান্তার অনুগত বাহিনী প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তাদের শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। যেমন থান্ডওয়ে এলাকায় এখন বর্মি সামরিক বাহিনীর একটি মাত্র ব্যাটালিয়ন কোনোমতে টিকে রয়েছে।

এখন পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান চালিয়ে আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছে আরাকান আর্মি। এরই মধ্যে রাখাইনের প্রতিবেশী চিন রাজ্যের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পালেতওয়া দখল করে নিয়েছে তারা। প্রাচীন আরাকান রাজ্যের রাজধানী ম্রাক উসহ রাখাইনের মধ্যাঞ্চলীয় প্রায় সব শহরই তাদের দখলে। রাখাইনের দক্ষিণাঞ্চলও পুরোপুরি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে আন শহরে অবস্থিত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তর বেশ নাজুক অবস্থানে পড়ে গেছে। যেকোনো সময় এ শহরের দখল নিতেও অভিযান শুরু করতে পারে আরাকান আর্মি

‘মানবিক কারণ’ দেখিয়ে ২০২২ সালের শেষদিকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে সাময়িক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল আরাকান আর্মি। এ যুদ্ধবিরতি ভেঙে তারা লড়াইয়ের পথে ফিরে আসে গত বছরের শেষদিকে। সহযোগী দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে গড়ে তোলে মিত্রজোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। এ জোট অক্টোবরে একযোগে শুরু করে বহুল আলোচিত ‘অপারেশন ১০২৭’। ঝটিকা এ সমরাভিযানে তারা চীন সীমান্ত থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মান্দালয়ের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয়। এর সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব সেনাবল পুনর্গঠন ও অন্যান্য অভিযানের সঙ্গে দ্রুত সমন্বয়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলেও অভিযান শুরু করে আরাকান আর্মি

বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহর অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। মে মাসের শেষদিকে বুথিডং শহরের দখল নেয় তারা। কিছুদিন আগে দখলে নেয় মংডু। আশঙ্কা রয়েছে, আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক সাফল্য স্থানীয় রাখাইনদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। মংডু ও বুথিডং—এ দুই শহরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্ত্র ও নগদ অর্থের বিনিময়েও তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর মধ্যে বুথিডংয়ের বড় একটি অংশ মে মাসের দিকে অগ্নিকাণ্ডে একপ্রকার ধ্বংস হয়ে যায়। কোনো কোনো অসমর্থিত সূত্রে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে, এ আগুনে আরাকান আর্মির হাত রয়েছে। আবার বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি বলছে, জান্তা বাহিনীর বিমান হামলাই এ অগ্নিকাণ্ডের কারণ। এরপর গত মাসে মংডুর বাসিন্দাদের উদ্দেশে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে দেয়া আরাকান আর্মির এক সতর্কবার্তায় বলা হয়, সামরিক বাহিনী এখানে তীব্র নগরযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় এখন ‘স্কর্চড আর্থ পলিসি’ বা পোড়ামাটির নীতির ব্যাপক প্রয়োগ করছে জান্তা বাহিনী। বেদখলের পথে থাকা এলাকা ছাড়ার আগে সেখানে বিপুল মাত্রায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই তাদের মধ্যে এ প্রবণতা ক্রমেই বাড়তে দেখা গেছে। পাকতাও ছেড়ে যাওয়ার আগে শহরটিতে ব্যাপক মাত্রায় গোলাবর্ষণ করে জান্তা বাহিনী। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ, স্থলবাহিনীর কামান আর বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান দিয়ে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালানো হয়। একই সঙ্গে স্থানীয়দের ওপরও ব্যাপক নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। পালানোর সময় সিত্তের উত্তরে বাইন ফিউ গ্রামে ৭০-এর বেশি স্থানীয় নাগরিককে নির্যাতন ও হত্যা করে তারা। গত মাসেও এনগাপালি বিচের নিকটবর্তী সিন গুয়াং গ্রামকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে তারা।

চলতি বছরের শুরু থেকেই মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা ব্যবস্থা একপ্রকার ধসে পড়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলো একটির পর একটি বেদখল হয়ে পড়েছে। পালিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে আশ্রয় নিয়েছে সীমান্তরক্ষী সৈনিকরা। বিপুলসংখ্যক সৈনিকের প্রাণহানির পাশাপাশি জান্তা বাহিনীর অনুগতদের অনেকেই আরাকান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বলে মিয়ানমার পিস মনিটরের তথ্যে উঠে এসেছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন