রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪ মাসে ১৩ খুন: বেশি সক্রিয় ‘আরসা’, মাথাচাড়া দিচ্ছে ‘আরএসও’

fec-image

উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে অবস্থানকারী সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করতে এক ডজনের বেশি ছোট-বড় অদৃশ্য ‘দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী’ উপস্থিত থাকলেও সবচেয়ে বেশি ছেয়ে গেছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এদিকে গত কয়েক বছর কিছুটা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ থাকলেও আবারও নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চাচ্ছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, ক্যাম্পে অন্য কোনও সংগঠনকে সক্রিয় দেখলেও আপাতত কোনও পাবলিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে না ‘আরসা’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গত দুই মাস ধরে চলমান অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে সংগঠনগুলো ক্যাম্পে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছে। তবে তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করছে না তারা। বাংলাট্রিবিউনের উখিয়া প্রতিবেদক উদিসা ইসলামের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।

ক্যাম্প এলাকায় সক্রিয় নানা রোহিঙ্গা সংগঠন নিয়ে বরাবরই উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে। বিকাল ৪টার মধ্যে ক্যাম্পে সব ধরনের বেসরকারি কর্মকাণ্ড শেষ করে সবাই ক্যাম্প ত্যাগ করলে শুরু হয় সংগঠনগুলোর তৎপরতা। ক্যাম্পে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, গ্রুপে-গ্রুপে গোলাগুলি, আধিপত্য বিস্তার, মাদক, অস্ত্রসহ নানা সহিংসতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেলো ৪ মাসে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে খুন হয়েছেন অন্তত ১৩ জন রোহিঙ্গা। বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা বলছেন, সংগঠনের মধ্যে অন্তর্কলহ এবং এক সংগঠনের সঙ্গে আরেক সংগঠনের বিভেদের কারণে পরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে।

ক্যাম্পের ভেতরে ঘোরাফেরা যাদের!
নব্বই দশকের শুরুতে রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন থেকে আজ পর্যন্ত ক্যাম্পগুলোতে ‘আরসা’ নামের সংগঠনটি সক্রিয় রয়েছে। এই গ্রুপের নেতারা সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছেন। বালুখালি ক্যাম্প-৮ ইস্টের এক রোহিঙ্গা অধিবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আরসা’ ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে। হয়তো ভাইয়ে-ভাইয়ে কোনও পরিবারে দ্বন্দ্ব আছে, সেই সুযোগ নিয়ে কোনও এক ভাইয়ের হয়ে আরেক ভাইকে আক্রমণের কাজেও ‘আরসা’র সম্পৃক্ত হওয়ার অভিযোগ আছে। আপনি এখানে এসেছেন সেটার খবরও তারা ঠিকই পেয়ে গেছে। সব জায়গায় তাদের লোক আছে। প্রায় ক্যাম্পে যেসব এনজিও কর্মী আসেন, তাদের ছাড়া বাইরের কাউকে দেখলেই খবর পৌঁছে যায়। এই রোহিঙ্গা পুরুষ জানান, আরেকটি সংগঠনের নাম খুব কম হলেও শোনা যায়, তারা হলো ‘আল ইয়াকিন’। যদিও সুস্পষ্ট বিবৃতি না থাকায় ধরেই নেওয়া হয়—এরা ‘আরসা’র সঙ্গে নানা বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ এবং সহযোদ্ধা বন্ধু সংগঠন হিসেবে টিকে আছে।

রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার বিরুদ্ধে ‘ইসলামি মাহাত’ নামে আরও একটি সংগঠন শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে তৎপর রয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে বালুখালির ক্যাম্প-১৮তে ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় ঘুমন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে তিন শিক্ষক ও একছাত্রসহ ৬ জন নিহত এবং কমপক্ষে ১২ জন আহত হন। কয়েকজনকে গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে হামলাকারীরা।

এই ঘটনা উল্লেখ করে ক্যাম্পের ভেতরের এক বাঙালি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মুহিবুল্লাহর হত্যার সঙ্গে ‘আরসা’ জড়িত। ক্যাম্পে তারা যে ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছে, সেটা আমরা দেখতে পাই। কখনও কখনও আমাদের উঠানেও কোনও রোহিঙ্গাকে টেনে এনে পেটানোর দৃশ্য দেখেছি।’

কেন এবং কাদের মারধর, এমন প্রশ্নে ‘আরসা’ থেকে ফেরত বলে চিহ্নিত এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘এই সংগঠন কোনোভাবেই চায় না যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের প্রচারণা করুক। কয়েকটি ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা ‘আরসা’র সেই হুমকি উপেক্ষা করে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল গঠন ও কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করলে, নানা রকমের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এখন যারা ‘আরসা’ না, তারাও ক্যাম্পের মধ্যে ‘আরসা’র নাম ভাঙিয়ে খায়। যেহেতু এসব জেনেও অফিসিয়ালি কোনও বিবৃতি দেয় না সংগঠনটি, সেহেতু ধরেই নেওয়া যায়, এমনটা ঘটুক সেটাও তারা চায়।’’

রোহিঙ্গাদের ঘর বিক্রিও হয়:
ক্যাম্পের ভেতরে বিভিন্ন সংগঠনের ‘দুর্বৃত্তরা’ আস্তানা গড়তে রোহিঙ্গাদের টাকা দিয়ে তাদের ঘর কিনে নেয় বলে জানা গেছে। একেকটি ঘর দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়ে ঘরের মালিক অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হয়েছেন—এমন খবরও আছে, উল্লেখ করে ক্যাম্প-৯-এর এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘আমার পাশের ঘর ছেড়ে দিতে হয়েছে। অনেক সময় ক্যাম্পের লোকদের টাকার দরকার হয়। তখন বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যদের কাছে তারা ঘর বিক্রি করে দেয়। এই খবর ক্যাম্পের অনেকের জানা। কিন্তু কেউ মুখ খোলে না।’’ তবে ‘আরসা’ তাদের অধিকার রক্ষা করে বলে মনে করেন উল্লেখ করে এই ক্যাম্পেরই এক রোহিঙ্গা বলেন, তারা কোনও খারাপ কাজ করে না। আমাদের হয়ে তারা লড়াই করে।

ক্যাম্পভিত্তিক আধিপত্য সংগঠনগুলোর:
এসব ক্যাম্প সরেজমিন জানা গেছে, সব ক্যাম্পে সব সংগঠনের প্রকাশ্য উপস্থিতি নেই। এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে উল্লেখ করে রোহিঙ্গারা বলছে, দুই একটা ক্যাম্প বাদে সব কয়টিতে আরসা প্রকাশ্যে নিজেদের কার্যক্রম চালায়। তারা এতটাই প্রকাশ্য যে অনেককেই তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। ভৌগোলিক কারণে লম্বাশিয়ার ক্যাম্প-১-এর মধ্যে বাস করছেন কয়েক বছর ধরে এমন একজন বাঙালি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্যাম্পে সবাই এখন আরসা। খোঁজ নিয়ে দেখেন কেউ আর অন্য কোনও সংগঠনের নাম বলবে না। ক্যাম্প পরিচালনা করতে রোজ যারা বাইরে থেকে আসেন তারা চারটার দিকে ক্যাম্প ত্যাগ করার পরে আরসার সদস্যদের ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। সবাই চেনে কে কার লোক। এরা অনেক বেশি সংগঠিত। এখন সাধারণ রোহিঙ্গা পরিবারগুলো এদের নিয়ে ভয়ও পায়। কেননা, পারিবারিক নানা ইস্যুতেও আরসা নাক গলানো শুরু করেছে। তবে অনেক ঘটনায় আরসা সম্পৃক্ত না, তাদের নাম ব্যবহার করছে কোনও মহল্লাভিত্তিক দল বলেও অভিযোগ আছে। আরসার যে অফিসিয়াল টুইটার আছে সেখানে সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে কোন বিবৃতি চোখে পড়ে না।

এখন আরএসও একটু সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় আছে কিনা প্রশ্নে কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়েছুর রহমান রোহিঙ্গারা নানা কায়দায় নিজেদের জানান দেয়। কোনটা আরএসও, কোনটা আরসা বাইরে থেকে আলাদা করা মুশকিল। ওদের নিজেদের মধ্যে অনেক দলীয় উপদলীয় কোন্দল আছে। মাদক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়। এখন আবার প্রত্যাবসনবিরোধী একটা গ্রুপ আবারও শক্তিশালী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্যাম্পে চলমান অস্থিরতা নতুন করে বেড়েছে নাকি আগেও এরকম ছিল প্রশ্নে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, অস্থিরতা বেড়েছে এরকম বলা যাবে না। তবে গত এক মাসে পর পর কয়েকটি ঘটনার কারণে এমনটা মনে হতে পারে। মূলত মিয়ানমারে চলমান অস্থিতিশীলতার কারণে যেসব দুর্বৃত্ত জিরো পয়েন্টে ছিল তারা ক্যাম্পে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। তবে সেটা তারা করতে পারেনি। কয়েকটি ক্যাম্পে ইসলামী মাহাদ বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ওদের মধ্যে যে বিভাজনগুলো রয়েছে সেগুলো মিয়ানমারকেন্দ্রিক। তারা এখানে সেটা করার চেষ্টা করে, পারে না। জিরো পয়েন্টেই থাকে সাধারণত, মাঝে মাঝে ঢোকার চেষ্টা করে। রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের ঘর সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করে থাকার জায়গা করে দিচ্ছে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোন তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে আমার এখানে আসা খুব বেশি দিন হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আরএসও, আরসা, খুন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন