শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে মুরংদের দুঃসাহসী অভিযান
আশির দশকে পার্বত্য লামা ও আলীকদম উপজেলা ছিল শান্তি বাহিনীর অভয়ারণ্য। শান্তি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা-লুণ্ঠন ও চাঁদাবাজিতে এতদাঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙ্গালীদের জীবনমান ছিল ওষ্ঠাগত। রাত-বিরাতে শান্তিবাহিনী হানা দিতো পাহাড়ি-বাঙ্গালী পাড়াগুলোতে। এ সময় সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শান্তিবাহিনীকে রুখে দেয় মুরুং উপজাতির একটি সাহসী অংশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষিত ও উচ্চাবিলাসী কতিপয় উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা অঞ্চল ঘোষণার দাবি তুলেছিলেন। তারা ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্যাঞ্চলকে নিয়ে আলাদা একটি জাতি অঞ্চল গঠন ও পৃথক শাসনবিধির দাবি-দাওয়া নিয়ে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাত করেন।
সদ্যস্বাধীন দেশে আলাদা একটি জাতি অঞ্চল গঠন ও পৃথক শাসনবিধি পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলে ১৯৭২ সালের ২৪ জুন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ গঠিত হয়। যা সংক্ষেপে ‘জেএসএস‘ বলে পরিচিত। এ সংগঠনের সশস্ত্র শাখার নাম ‘শান্তিবাহিনী’।
শান্তিবাহিনী শুধু বাঙ্গালীদেরকেই নয় মুরংদেরও নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতন করতো। বাঙ্গালীর পাশাপাশি হত্যা, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির শিকার হতে হতো মুরংদের।
আলীকদমের সাবেক মুরং বাহিনী কমান্ডার প্রয়াত মেনলে মুরংয়ের বক্তব্যে শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে মুরংদের দুঃসাহসী অভিযানের কথা প্রথম জানা যায় সাংবাদিক আতিকুর রহমানের লেখা অনুসন্ধান: তৈনছড়ি ও আলীকদম এর ধারাবাহিক প্রতিবেদনে।
মেনলে মুরং জানান, ‘১৯৮৫ সাল। কাচিপিয়ার (কচ্ছপ্যা) লোংরা (রংরাও) পাড়ার ঝিন ঝিরিতে শান্তিবাহিনীর একটি আস্তানা ছিলো। আমরা গোপনে অনুসন্ধান করে পথঘাট ও আক্রমণের সুযোগ সুবিধা নির্ধারণ করে ওঁৎ পেতে থাকলাম। আমাদের অস্ত্র হলো দা, কুড়াল, লাঠিসোটা ও গাদা বন্দুক।
রাত শেষ প্রায়। অমনি ঝাঁপিয়ে পড়লাম শান্তিবাহিনীর ওই আস্তানায়। গাদা বন্দুকের একটি আওয়াজ হলেই শান্তিবাহিনীর সদস্যরা জেগে উঠে যে যেদিকে পারে দিলো ছুট। অল্পক্ষণে সবাই উধাও।
আমাদের দখলে এসে গেলো আস্তানাটি। তাতে পাওয়া গেলো ১টি রাইফেল, ২টি এসএলআর, ১টি এলএমজি ও ৭৫০টি গুলি। আমাদের প্রাথমিক অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে উঠলো। এই সাফল্যে উৎসাহিত হলেন অনেকে। তাতে আমাদের সদস্য সংখ্যাও বেড়ে গেলো।
মেনলে মুরংয়ের ধারণা, ‘মুরংদের এ অভিযানকে শান্তিবাহিনী সেনা আক্রমণ বলেই মনে করেছিলো। কিন্তু পরে তারা নিশ্চিত হয় যে, মুরংরাই এর হোতা। ফলে মুরংদের ওপর তাদের উৎপীড়ন বেড়ে যায়। আমরাও তা প্রতিরোধে দৃঢ় সংকল্প হই।’
আমাদের এই অভিযান ও সাফল্যের কথা পরে সেনাবাহিনীর গোচরীভূত হয় এবং তারা আমাদের সহযোগিতা দান শুরু করে। আমরা কাপিচিয়া (কচ্ছইপ্যা ঝিরি) অভিযানে অস্ত্র ছাড়াও শান্তিবাহিনীর গুদামজাত করা প্রায় ৫/৬ হাজার মন চাউল পেয়েছিলাম। আমাদের দ্বিতীয় অভিযানক্ষেত্র হলো মধুতে অবস্থিত শান্তিবাহিনীর আস্তানা।
মেনলে মুরং জানান, আমরা খবর পাই যে, সেখানে এতদাঞ্চলীয় শান্তিবাহিনীর সদস্যরা একটি মিটিং উপলক্ষে সমবেত হয়েছে। মুরং বাহিনীর ৯৩ জন সদস্য নিয়ে আমি ওই এলাকাটি ঘেরাও করে ফেলি। ফলে উভয় দলে সংঘর্ষ হয়। দু’জন শান্তিবাহিনীর সদস্য মারা যায় ও বাকিরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। এবারও আমরা দু’টি অস্ত্র হস্তগত করি।
এরপর মধু রেংক্রং পাড়ায় শান্তিবাহিনীর সাথে আমাদের তৃতীয় মোকাবেলা হয়। সেখানে আমি নিজে হাতে, পায়ে ও মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হই। আমার দলের অপর একজন যোদ্ধা নিহত হন। তবে শত্রুপক্ষের দু’জন নিহত আর আহতের সংখ্যা অনেক।
আহত অবস্থায় চিকিৎসার জন্য আমাকে চকরিয়ার মালুমঘাটে অবস্থিত ক্রিশিয়ান হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যেখানে আমার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। এই কাটা পা-ই বিদ্রোহী ও অত্যাচারী শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে এবং দেশ ও জাতির পক্ষে পরিচালিত আমার সশস্ত্র সংগ্রামের সাক্ষী। পঙ্গু হলেও এই কাটা পা’র জন্য আমি গর্বিত। তবে আমি অতৃপ্ত এই কারণে যে, শারীরিক অক্ষমতা আমাকে শান্তিবাহিনী দমনে অধিক এগুতে দেয়নি।
ওই সাক্ষাতকারে মুরং নেতা মেনলে আক্ষেপ করে বলেন, সরকার মুরংদের অবমূল্যায়ন করছে দেখে আমি দুঃখ পাই। চুক্তি অনুযায়ী সরকার পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে মুরংদের নয়, তাদেরই ক্ষুদ্র শাখা সম্প্রদায় ম্রোদের উপজাতি ঘোষণা করেছেন। এটা কি জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধ প্রভাবের ফল?
আমরা দেশপ্রেমিক ও বাংলাদেশী জাতির স্বপক্ষ। শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে স্ব-উদ্যোগে পরিচালিত সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা তার প্রমাণ রেখেছি।
যদি প্রকৃত চরিত্রের ভিত্তিতে উপজাতি নির্ধারণ করা হয়, তাহলে অন্য অনেকের চেয়ে বাস্তব উপজাতি আমরাই। আমাদের সরাসরি উপজাতি স্বীকৃতি না দিয়ে ম্রোদের দলে ব্রেকেটভূক্ত করা সঠিক মূল্যায়ন নয়। সরকারের কাছে আমাদের আরো দাবি হলো, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়া হোক।